মাংস-ডিমের মিশেলে সাহেবদের জন্য তৈরি এই পদের স্বাদ আজও অটুট
ডাকবাংলোর চৌহদ্দির মধ্যে দিশি মুরগির দেওয়া অপর্যাপ্ত ডিমও থাকত। প্রথমে চড়া আঁচে বসিয়ে তারপর ঢিমে আঁচে অনেকটা সময় ধরে রান্না হতো বলেই বুঝি এত সুস্বাদু ছিল সেই রান্না। এভাবেই ডাকবাংলোর কর্মীদের তৈরি মাংসের একটি সাধারণ পদই...
গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খাসির মাংস আর সরু চালের ভাত। এরকম লোভনীয় খাবার! কিন্তু বাঙালির কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। দিন দিন খাসির মাংসের দাম যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে বাঙালি আর সাধ করে গাইতে পারে না ‘আমার মতে তোর Mutton কেউ নেই’। এখন মধ্যবিত্ত বাঙালির পাতে রসিয়ে খাওয়ার জন্য খাসি না হোক, মুরগির মাংস বেশ জাঁকিয়েই আছে। আর তাই এক্সপেরিমেন্ট-প্রিয় বাঙালি চিকেনকেও নানা আইটেমে তৈরি করে পাতে নিয়ে চেটে-পুটে খাচ্ছে। চিকেন ডাকবাংলো তার মধ্যে অন্যতম এক পুরনো রান্না।
কলকাতার কাছেই রয়েছে উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতের ডাকবাংলোর মোড়। সে যুগে ছিল এমন অজস্র ডাকবাংলো। বাংলার পুরনো বা হারানো মাংস রান্না নিয়ে লিখতে বসলেই বেশ কিছু অনুষঙ্গ এসে পড়ে। বুদ্ধদেব গুহর শিকারকাহিনি-তেও একই সঙ্গে জঙ্গলে ভ্রমণ এবং সেখানে মজাদার খাবারের আস্বাদ পাওয়া যেত। সেখানেই শোনা বাংলার জঙ্গুলে মাংস রান্নার কথা।
ডাকবাংলো কারি নামকরণের কারণ
ব্রিটিশ আমলে চিঠিপত্র পাঠানোর জন্যই শুরু হয়েছিল ডাকব্যবস্থা। চিঠি বইবার জন্য ছিল ঘোড়ার পিঠ। ঘোড়ার পিঠে চেপে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ব্রিটিশ কর্মচারীদের পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক সময়ই সন্ধে ঘনিয়ে আসত। তাদের রাত্রিবাসের জন্য তৈরি হল ডাকবাংলো। এল আব্দুল কিংবা গফুরদের মতো ডাকবাংলোর কেয়ারটেকাররা। ব্ল্যান্ড রান্না খাওয়া সাহেবি জিভে ঝাল সইত না। তাই অল্প ঝাল দিয়ে তাদের জন্য তৈরি হত মুরগির কারি। সঙ্গে ভাত বা রুটি। ডাকবাংলোর চৌহদ্দির মধ্যে দিশি মুরগির দেওয়া অপর্যাপ্ত ডিমও থাকত। প্রথমে চড়া আঁচে বসিয়ে তারপর ঢিমে আঁচে অনেকটা সময় ধরে রান্না হতো বলেই বুঝি এত সুস্বাদু ছিল সেই রান্না। এভাবেই ডাকবাংলোর কর্মীদের তৈরি মাংসের একটি সাধারণ পদই বাঙালির পাতে হয়ে উঠল অসাধারণ, এবং এই নামেই নামকরণ হল চিকেন ডাকবাংলো।
আরও পড়ুন: গোয়ালন্দ কারি: মাঝিমাল্লার হাতে তৈরি মুরগির ঝোলের স্বাদ আজও ভোলেনি বাঙালি
ডাকবাংলো চিকেন রেসিপি
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, চিকেন ডাকবাংলো একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খাবার। সেই সময় এই ডাকবাংলোর কেয়ারটেকাররা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেয়েই তাড়াতাড়ি রান্না চাপানোর প্রস্তুতি নিতেন। এই বাংলোগুলোর সঙ্গেই লাগোয়া নিজস্ব পোলট্রি ফার্মও থাকত। তাই মাংস, ডিম বা গরুর দুধের তৈরি টক দইয়ের অভাব ছিল না। কিন্তু কেয়ারটেকারদের হাতে ৪০-৪৫ মিনিট সময় থাকত রান্নাটি সম্পূর্ণ করার জন্য। সেই জন্য সময় বাঁচাতে আলু না কেটে শুধু খোসা ছাড়িয়ে গোটা অবস্থায়, নামী-দামি মশলা না দিয়ে শুধু টক দই ও কিছুটা ভাজা পেঁয়াজ সহযোগে পদটি তৈরি করা হতো।
আবার যেহেতু ডাকবিভাগের অফিসারেরা একটু অবেলার দিকে এসে উপস্থিত হতো, তাই মাংস খুব একটা বেশি পরিমাণে থাকত না কোনও কোনও সময়। সেই জন্য মাংসের সঙ্গে একটি আস্ত ডিমও দেওয়া হতো এই রান্নাতে, পরিমাণে বাড়াতে। উপমহাদেশের কোনায় কোনায় প্রায় প্রত্যেক ডাকবাংলোর চৌকিদারের হাতের স্টেপল খাবার হিসেবে মুরগির ঝোল হিসেবে যে পদটি মূলত উনিশ শতকের শেষার্ধে এসে আলু আর সেদ্ধ ডিমের যুগলবন্দি, সেই পদেরই নাম দাঁড়ায় চিকেন ডাকবাংলো।
ডাকবাংলো চিকেন নিয়ে এত রসনা শোনার পর নিশ্চয়ই আপনারও মনে হচ্ছে, আহা ! যদি রেসিপিটা পাওয়া যায়, তাহলে রবিবারের দুপুরটা জমে যাবে। ফিরে যাওয়া যাবে সেই ডাকবাংলোর ইতিহাসে, যেখানে গোটা মশলা গুঁড়ো করে রান্না করা হতো। সে চল তো আজ প্রায় উঠেই গেছে।
আপনাদের সকলের জন্য রইল ডাকবাংলো চিকেনের রেসিপি।
কী কী লাগবে
১টা বড় এলাচ, ১/২ জায়ফল, ৫টা ছোট এলাচ, ১টা জয়িত্রী, ৪ টুকরো দারচিনি, ৫টা লবঙ্গ, ৪টে শুকনো লঙ্কা, ২টো তেজপাতা, ২ চা চামচ গোটা ধনে, ১ কিলো ৫০০ গ্রাম চিকেন, ১ কাপ টকদই, ধনেগুঁড়ো, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, ৩ চামচ আদা-রসুন বাটা, হলুদগুঁড়ো, গোলমরিচ গুঁড়ো, সরষের তেল, মাঝারি মাপের ৮-৯টা আলু, ৬টা সেদ্ধ হাঁসের ডিম, ৫টা মাঝারি মাপের পেঁয়াজ কুঁচি, ১টা টমেটো কুচি, নুন আন্দাজমতো।
পদ্ধতি
১টা বড় এলাচ, ১/২ জায়ফল, ৫টা ছোট এলাচ, ১টা জয়িত্রী, ৪ টুকরো দারচিনি, ৫টা লবঙ্গ, ৪টে শুকনো লঙ্কা, ২টো তেজপাতা, ২ চা চামচ গোটা ধনে শুকনো খোলায় ভেজে গ্রাইন্ড করুন। এর পর চিকেনে টক দই, ১/২ চামচ ধনেগুঁড়ো, স্বাদ অনুযায়ী নুন, ১/২ চামচ শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, ৩ চামচ আদা-রসুন বাটা, ১ চামচ হলুদগুঁড়ো, ১/২ চামচ গোলমরিচ গুঁড়ো, ২ চামচ গ্রাইন্ড করা মশলা দিয়ে ৩০ মিনিট ম্যারিনেট করুন।
এর পর একটি পাত্রে ৫ চামচ সরষের তেল দিয়ে দিন। তেল গরম হয়ে গেলে মাঝারি মাপের ৮-৯টা আলু কাঁটাচামচ দিয়ে ফুটো করে নিন। এর পর ১ চামচ নুন, ১/২ চা চামচ শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, ১/২ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো দিয়ে হালকা আঁচে আলু ভেজে নিন। ওই একই তেলে ৬টা সেদ্ধ হাঁসের ডিম সামান্য ভেজে আলাদা করে রেখে দিন। এর পর ৪ চামচ সরষের তেল যোগ করুন, ৫টা মাঝারি মাপের পেঁয়াজ কুচি হালকা আঁচে ভাজুন। এর পর ১ চামচ নুন যোগ করুন। ১টা টমেটো কুচি, ১ চামচ শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে হালকা আঁচে ৫ মিনিট কষান।
এর পর ম্যারিনেট করা চিকেন যোগ করুন। ১০ মিনিট হালকা আঁচে কষান, গ্রাইন্ড করা বাকি মশলা যোগ করুন। ভেজে রাখা আলু দিয়ে আরও ১০ মিনিট কষান। ম্যারিনেট করা পাত্রে ২-৩ কাপ জল মশলায় গুলে দিন। হালকা আঁচে ১০ মিনিট ঢাকা দিন। ভেজে রাখা ডিম যোগ করুন, ২-৩ মিনিট পর আঁচ নিভিয়ে দিন। তৈরি হয়ে যাবে চিকেন ডাকবাংলো।
এই ডাকবাংলো মুরগি নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। ১৮৫৬ সালে চার্লস ডিকেন্সের পুত্র ওয়াল্টার ডিকেন্স সৈনিক হিসেবে কলকাতায় আসেন । তাঁর লেখাতেই আছে এমন। ভারতে আসার আগে এই ডাকবাংলোর মুরগি রান্নার একঘেয়েমি বিষয়ে প্রচুর রসিকতা শুনে এসেছিলেন তিনি। তাই সেটি ঠিক কতটা বোরিং, সেটা জানতেও উৎসাহী ছিলেন। ভাগ্যক্রমে এদেশে এসে যেসব ভিন্ন ভিন্ন ডাকবাংলোয় তিনি থেকেছিলেন, সেখানকার খানসামারা তাঁকে সত্যি সত্যি এই ডাকবাংলো মুরগি রান্না করে খাইয়েছিল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যতটা একঘেয়েমির কথা তিনি শুনেছিলেন তেমন লাগেনি তাঁর, বরং মুরগির মশলাদার মজার স্বাদই তাকে মুগ্ধ করেছিল।
চিকেন ডাকবাংলো রেসিপিতে আহামরিত্ব নেই। আমরা ছোটবেলা থেকে মায়ের হাতে যেমন সাদামাটা মাংস খেয়ে আসছি তেমনই, শুধু অভিনবত্ব সেদ্ধ ডিমের উপস্থিতিতে। সেকালে প্রচুর তেল-মশলা সহযোগে মাংসের কারি কিম্বা ট্যালট্যালে মাংসের স্টু… সেদ্ধ আলু আর ডিম ফেলে দিয়েই তাকে গালভরা নাম ডাকবাংলো বলে ডাকা হতো। ব্রিটিশরাজের কালেই মুরগি জনপ্রিয় হয়েছিল ভারতীয় রসনায়, কলকাতার কেতাদুরস্ত ক্লাবগুলিতে।
স্বাধীনতা আসেনি তখনও আমাদের দেশে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৪০ সালে ভারতের অগণিত স্থানে নিজেদের কাজের সুবিধার্থেই কিছু ডাকবাংলো তৈরি শুরু করেন। ডাক পরিষেবা ছাড়াও সরকারি কর্মচারী সাহেবরা সপরিবারে সেখানে গিয়ে একদিকে সবুজ প্রকৃতিকে উপভোগ করতেন আর অন্যদিকে জঙ্গলের মধ্যে নিজেদের গ্যাস্ট্রোনমিক স্ফূর্তিতে জমিয়ে দিতেন ছুটির দিন। সাহেবের আদেশে খানসামার হাতের দেশি পদ তৈরি হতো আর সাহেবরা তা খেতেন কবজি ডুবিয়ে। সেই থেকেই এই ডাকবাংলো রান্নার ট্র্যাডিশন চলেছে এখনও।