স্রেফ ভয় দেখানো নয়, ২০ কোটি উদ্ধার বলছে লক্ষ্য আরও গভীর...
ইডি কেবল ভয় দেখাচ্ছে নাকি মাটি খুঁড়ে সত্য বের করে এনে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে চাইছে, প্রশ্ন এখন এটাই।
ভোট বড় বালাই! বহু ব্যবহারেও ক্লিশে হল না এ কথা।
বিরোধী শিবির বলছে, ২০২১-এর ভোটের হারের যন্ত্রণা সম্ভবত ভুলতে পারেননি মোদি-শাহরা। তাই ২০২৪ কে পাখির চোখ করে বঙ্গে আসরে নামতে তাঁদের হাতিয়ার সিবিআই, ইডি-র মতো অস্ত্র? বলা হচ্ছে, সিবিআই, ইডি বহু ব্যবহারে ভোঁতা হলেও তাকে হাতছাড়া করতে চায় না কেন্দ্র। রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছে, সেই কারণেই বিভিন্ন রাজ্যে একই ভাবে ইডির কোপে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। রাজ্যে এর আগে সিবিআই, ইডি-র হাত থেকে রেহাই পাননি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অস্ত্রে সোনিয়া-রাহুলদের ফালাফালা করার চেষ্টা চলছে। আর এই প্রক্রিয়া দেখেই একাংশ বলছে, ইডি সিবিআই-এর মতো সংস্থাগুলিকে স্বতপ্রণোদিত ভাবে ব্যবহারের খেলায় মেতেছে বিজেপি। তবে ভিন্ন মতও রয়েছে। অনেকে বলছেন, স্রেফ ভয় দেখানোই নয়, দুর্নীতি যদি সত্যিই সামনে আসে তাহলে তা বিরোধীদের জন্য যেমন ব্যাকফুটে যাওয়া অবধারিত, তেমনই বিজেপির নৈতিকতার ধ্বজাটি ওড়ানো সহজ হবে।
যে কারণে এই কথাবার্তা, তা এতক্ষণে সকলেই জেনে গিয়েছেন। এ দিন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ম্যারাথন জেরা করে কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। এসএসসি-র শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় শুক্রবার সকালে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে যায় ইডি। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাঁকে। জানা গিয়েছে, প্রায় ৭ ঘণ্টা জেরার মাঝে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি তাঁর বাড়িতে চিকিৎসকদের ডাকা হয়।এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার কয়েক মুহূর্ত আগে ইডি জানিয়েছে জনৈক অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে অন্তত ২০ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেখে নেওয়া যাক গোটা ঘটনাক্রমটা।
কেন জেরা মন্ত্রীকে
কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে খবর, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়টি খতিয়ে দেখতেই এদিন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। এই মামলাতে আগেই সিবিআই জেরার সম্মুখীন হয়েছিলেন তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
কোন উত্তর খুঁজছে ইডি?
সূত্রের খবর মোট ১৩টি জায়গায় তল্লাশি চালায় ইডি। এই দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রীর কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার চেষ্টা করে ইডি। ইতিমধ্যে মামলাকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি যে সকল তথ্য পেয়েছে, তাতে টাকার বিনিয়ের কম নম্বর প্রাপ্ত ও অনুত্তীর্ণদের কেন চাকরি দেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাইছে ইডি। এতে শিক্ষা দফতরের একাংশ এবং জেলা স্তরে এই চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ। দফতরের তৎকালীন মন্ত্রী হিসেবে এই আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি তিনি কি অবগত ছিলেন? তাঁর ঘনিষ্ঠ কোনও পদাধিকারী এই আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না, সেই বিষয়গুলি নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে খবর। পাশাপাশি যাঁদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ, তাঁদের একাংশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত যে তথ্য সিবিআই পেয়েছিল, তা ইডিকে দেওয়া হয়েছে।
রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর আত্মীয়ের বাড়ি ছাড়াও এদিন সকাল থেকে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেখলিগঞ্জের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের গোয়েন্দারা তল্লাশি চালান। তল্লাশি চালানো হয় একেবারে পরিকল্পনা করে।
শুধু পার্থই নন, নজরে বহু রাঘববোয়াল
মনে রাখতে হবে, পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রথম নন, এর আগে এই রাজ্যেও হোমড়া চোমড়াদের সিবিআই, ইডির কোপে পড়তে হয়েছে। যেমন ধরা যাক মদন মিত্রের কথা। মদন মিত্রের গ্রেফতারির পর তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীরা সুর চড়াবে জেনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু মদনের পাশ থেকে সরে দাঁড়াননি। উল্টে সেই সময় তিনি জানিয়েছিলেন, সিবিআইয়ের কাছে যাওয়ার আগে মদন তাঁর কাছে ইস্তফা পাঠিয়ে দিয়েছেন। মমতা সাফ জানিয়েছিলেন, তিনি ইস্তফা গ্রহণ করবেন না। ওই মন্ত্রী থাকবে। এটা তাঁর চ্যালেঞ্জ। আর্থিক কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হওয়ার মন্ত্রীর ইস্তফা গ্রহণ না করে তিনি দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছিলেন। এমন নজির দেশে খুব একটা নেই বলা যায়। একটা কথা পরিষ্কার মদনের হয়ে ঢাল, তলোয়ার নিয়ে তাঁকে রক্ষা করতে আসরে নেমেছিলেন দিদি। পার্থর ক্ষেত্রে এসএসসি দুর্নীতির মতো মারাত্মক অভিযোগ, সেখানে কখন কী হয় বলা যায় না। তার ওপর সামনে লোকসভা ভোট। তাই কি দিদি এখনও নীরব? পরে মুখ খুলবেন কি না, তা সময়ই বলবে।
কিছুদিন আগের ঘটনা। বিস্মৃত হয়নি দেশবাসী। পর পর ৩ দিনে রাহুল গান্ধীকে ২৫ ঘণ্টা টানা জেরা করে ইডি। ন্যাশনাল হেরাল্ডের মতো একটি পুরনো মামলা খুঁচিয়ে তোলার দায় কি সেই ভোট? ভোট আসবে, যাবে, রাজা বদলাবে, দেশ বদলাবে-এটাই তো গণতন্ত্র! কুর্সিতে টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে আশ্রয় করতে হবে? বিরোধীদের সুর ও স্বর নরম করাতে এ কেমন অস্ত্র?
তখন সোনিয়া গান্ধী হাসপাতালে। একাংশের অভিযোগে, কংগ্রেসকে ভেন্টিলেশনে পাঠানোর এটাই আদর্শ সময় বলে হয়ত মনে করেছিল বিজেপি। ইডির ম্যারাথন জেরায় জেরবার হন কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি। এর আগে বারবার বিজেপির বিরুদ্ধে সিবিআই ও ইডি জুজু ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। উত্তরপ্রদেশে বুয়া, বাবুয়া, কিংবা বাংলায় পিসি-ভাইপোর গলার স্বর নরম করাতে তারা এই `ভোঁতা অস্ত্র’ই ব্যবহার করেছে। কংগ্রেসের অন্দরে ভাঙনের চোরা স্রোত বইছে। ভোটের আগে কংগ্রেসের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটলে কার লাভ, তা ভালোই জানে দেশ। শুধু তাই নয়, বাংলাও পাখির চোখ মোদি-শাহর। তার ওপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গরমাগরম আওয়াজ তুলে বিজেপিকে বারবার ঘায়েল করতে শুরু করেছিলেন। তার ওপর দিল্লির মসনদ থেকে বিজেপিকে সরাতে বিরোধীরা এককাট্টা হওয়ার চেষ্টা করে। সলতে পাকানোও শুরু হয়। সেক্ষেত্রে বিরোধী মুখ হিসেবে বারবার আলোচনায় এসেছে মমতার নাম। তাই কি তাঁকে একটু সমঝে দেওয়ার দরকার ছিল? এই কারণেই কি তাঁর দলের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং মহিসাচিবও রেহাই পাচ্ছেন না?
বলাই বাহুল্য শাসকেরই মরণকামড়ের নাম সিবিআই, ইডি। তাই ইডির হাত থেকে রেহাই পাননি কর্ণাটক কংগ্রেসের ডাকসাইটে নেতা শিবকুমার। চিদম্বরমকে জেলে যেতে হয়েছে। গত লোকসভা ভোটের আগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নেক নজরে পড়েন মায়াবতী। মমতাকে বিড়ম্বিত করতে অভিষেককেও টানাটানি চলেছে। তবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাণ্ডে জল বেশ অনেকটাই গড়িয়েছে, এমনটা আজকের ঘটনায় বলাই যায়।
বিজেপির বহু পুরনো ও চেনা হাতিয়ার হিন্দুত্ব। সম্প্রতি প্রাচীন স্মৃতি সৌধের ইতিহাস পরিবর্তন করে গায়ে হিন্দুত্বের তকমা দেওয়া হচ্ছে সেই দাওয়াই কায়েম করার জন্যেই। এদিকে মোদি ক্ষমতায় এসে বুঝেছিলেন, নতুন ভারতের মন হিন্দুত্বে ভিজবে না। নতুন ভারত কাজ চায়। তাই মোদিকে বারবার বলতে হয়েছে উন্নয়নের কথা। এতকিছুর পরেও সিবিআই ও ইডির মতো `বহু ব্যবহৃত অস্ত্রে’ কেন বারবার শান দেওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্র? এইটা ছিদ্রযুক্ত পাত্রে জল ভরার বৃথা চেষ্টার সামিল হবে না তো? দেখা যাক। বিরোধীরা জুজু দেখে ঘরে সিঁধিয়ে যায় কিনা!