পায়রা পোষেন, পায়রা খাওয়ান? দেশে পায়রাপ্রেমীদের মধ্যে হু হু করে বাড়ছে যে রোগ
Indian Pigeons: ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতে পায়রার জনসংখ্যা ১৫০%-এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্রমাগত শুকনো কাশি হচ্ছে রোগীর। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। সাধারণত এমন রোগী এলেই, অন্য কোনও উপসর্গ না থাকলে চিকিৎসকরা তাঁদের পেশাগত ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। কোনও খামার বা পোল্ট্রি ব্যবসা আছে কিনা, সোল্ডারিং বা তুলো বা কাপড়ের শিল্পে কাজ করেন কিনা এসব জিজ্ঞেস করেন ডাক্তাররা। এর কোনওটাই যদি না হয়, তাহলে চিকিৎসকদের অনেকেই প্রশ্ন করেন বারান্দায়, এসির ইউনিটে বা বাড়ির কোনও জায়গায় পায়রা আছে কিনা। বা নিয়মিতই পায়রাদের তারা খাওয়ান কিনা? হচ্ছে কাশি বা শ্বাসকষ্ট, এর সঙ্গে পায়রা খাওয়ানোর কী সম্পর্ক?
চিকিৎসকরা দেখেছেন, এমন রোগীর সাধারণত পাখিদের সংস্পর্শে আসার ইতিহাস রয়েছে। এক্স-রে বা সিটি স্ক্যান, বা রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায় এই রোগী ছত্রাক, ছাঁচ, দেয়ালের স্যাঁতাপড়া এবং পায়রার বিষ্ঠার মতো বিভিন্ন জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে কিনা। রোগীর ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে থাকলে, সাধারণত দেখা যায়, রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস বা বার্ড ফ্যান্সিয়ার্স লাং। এই রোগের লক্ষণ ফুসফুসের দাগ, বুকে চাপা ভাব, শ্বাসকষ্ট এবং দীর্ঘস্থায়ী কাশি।
চিকিৎসকরা বলছেন, হাইপারসেনসিটিভিটি নিউমোনাইটিস কোনও সংক্রমণ নয় কিন্তু পায়রার বিষ্ঠাতে উপস্থিত কিছু অ্যালার্জেন বা রাসায়নিকের প্রতি শরীরে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে, বিশেষ করে ফুসফুসকে প্রভাবিত করে। দিল্লির চিকিৎসক মহল বলছে, দিল্লির মতো শহুরে এলাকায় পায়রার সঙ্গে মানুষের যোগ বাড়ছে। ক্রমেই এমন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে যা পায়রার বিষ্ঠা এবং পালকের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন ধরে আসার ফলেই ঘটেছে।
২০২৩ সালের স্টেট অফ ইন্ডিয়া'স বার্ডস রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতে পায়রার জনসংখ্যা ১৫০%-এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পায়রারা আসলে মানুষের আবাসস্থলে, মানুষের নানা বিল্ডিংয়ে বাসা বাঁধতে শিখে গেছে এবং মানুষ যা দেয় তা খেয়ে ফেলাতে নিজেদের সফলভাবে অভিযোজিত করে নিয়েছে। দিল্লি এবং অন্যান্য বড় শহরগুলিতে, ট্র্যাফিকের, ফুটপাথে পায়রাদের খাওয়ানো খুব পরিচিত দৃশ্য। এখন অনেকেই গৃহপালিত পাখি হিসাবে রাখেন পায়রাদের।
আরও পড়ুন- শকুনের সংখ্যা কমায় ৫ বছরে ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ভারতে! অবাক করা তথ্য গবেষণায়
পায়রা বিক্রেতাদের অনেকেই বলছেন, মানুষ পায়রা পছন্দ করে কারণ তারা সহজেই পোষা হয়ে যায় এবং যারা তাদের খাওয়ায় তার কাছে ফিরে যায়। অন্য কোনও পাখি এমন আনুগত্য দেখায় না। আর মানুষজন তো অনেকেই পায়রাদের খাওয়ানোর কাজটিকে 'পুণ্য' বলেও মনে করেন। তবে বেশিরভাগ চিকিৎসকরাই এই পাখিদের ক্ষতির দিকটি নিয়ে চিন্তিত। পায়রাদের 'উড়ন্ত ইঁদুর'-ও বলা হয়৷ মানুষ যদি কৃত্রিমভাবে খাওয়ানোর মাধ্যমে পায়রাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে, তাহলে আখেরে মানুষদেরই সমস্যা তৈরি হবে। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, পায়রার সঙ্গে সম্পর্কিত রোগের মোকাবিলার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে, সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। তাতে পায়রার অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে মানুষের অবদান পরিবর্তির হবে। মানুষকে মনে রাখতে হবে, মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাণীদের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
দিল্লির কথাই ধরা যাক। বাজরা এবং ভুট্টা বিক্রি হয় নয়াদিল্লির কনট প্লেসের ভেতরে, পায়রাদের খাওয়ানোর জন্যই। প্রতি প্লেট ২০ টাকায় বিক্রি হয় সেই সব শস্যদানা। দুপুর ১২টার মধ্যে বিক্রেতাদের ভাঁড়ার শেষ হয়ে যায় প্রায়। এই বিক্রেতারা আছেন উপকণ্ঠের নানা গ্রাম থেকেই। তারা ভাবেন, গ্রামে জমি আছে, গোলা আছে। পায়রারা চাইলেই সেখান থেকে শস্যদানা খেতে পারে। শহরে তো এসব নেই, তাই পায়রারা ক্ষুধার্ত থাকে। মানুষ তাঁদের খাওয়ায়। এমনটা কিন্তু আসলে ঘটে না। হ্যাঁ, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং দ্রুত নগরায়নের ফলে দূষণের মাত্রা এবং তাপমাত্রা ব্যাপক বেড়েছে, যার ফলে অনেক পাখির প্রজাতিই সঙ্কটে। তবে পায়রাদের ক্ষেত্রে সবটা খাটে না। পায়রারা মানুষেরই বাড়িতে বাসা বাঁধছে, সারা বছর ধরে প্রজনন করে এবং মানুষের ঘনিষ্ঠ হয়ে মানুষের খাওয়ানোর উপর নির্ভর করে দিব্যি বেঁচে থাকছে।
শহরে আগে পায়রার আসল আবাসস্থল ছিল পাথর এবং পাথরের নানা ফাঁক। এখন শহরের কংক্রিট এবং বিল্ডিংয়ের সঙ্গে নিজেদের অত্যন্ত অভিযোজিত করে ফেলেছে পায়রারা। পায়রা এই সমস্ত জায়গায় নিরাপদে লুকিয়ে থাকতে পারে। আর পায়রাদের প্রাকৃতিক শিকারী, যেমন সাপ, তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত তো হয়েইছে, নগরায়নের ফলে এই প্রাণীদের জনসংখ্যা হ্রাসও পাচ্ছে। তাই পায়রারা শহরগুলিতে অনেক নিরাপদ এখন। ২০২৩ সালের স্টেট অফ ইন্ডিয়া'স বার্ডস রিপোর্ট বলছে, শহরাঞ্চলে খাদ্যের নিশ্চিত জোগান বাড়তে থাকার ফলে 'হাউজ ক্রো' এবং 'ফেরাল রক পিজিয়ন'-এর মতো প্রজাতির বৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
আরও পড়ুন- ১ লক্ষেরও বেশি মৃত্যু! কেন অন্য বিপর্যয়ের থেকে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ভারতে?
প্রতি বছর পায়রাকে খাওয়ানোর জন্য হাজার হাজার কিলোগ্রাম শস্য নষ্ট হয় যা আসলে মানুষের জন্য উৎপাদিত হয়। পায়রাকে নিয়মিত মানুষ যেভাবে খাইয়ে চলেছে, তাতে এই পাখির জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। আর পাল্লা দিয়ে ফুসফুসের রোগগুলিও বাড়ছে, বিশেষত শহুরে এলাকায় তা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমেই।
জৈন ধর্মে বলা হয়, সমস্ত জীব পবিত্র। জীবে প্রেমের সেই চিরায়ত সত্য! এই ধর্মবিশ্বাসী এক পরিবারের যুবক স্ক্রোল.ইন-কে জানিয়েছিলেন, দরিয়াগঞ্জে তাঁর বাড়ির বারান্দাটি কেবল পায়প্রাদের জন্যই বরাদ্দ। প্রতি বছর পাখির খাবারের জন্য প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ করে তাঁদের পরিবার! বর্ষাকালে পায়রা পুরনো পালক খসিয়ে দেয়। শীতকালের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে নতুন পালক গজায় দেহে। এই সময়ে, তাদের ঘাড়ের চারপাশে খুব ছোট পালক গজায় যা সহজের মানুষের শ্বাসের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তবে এসব ছোটখাট বিষয়কে পাত্তা দেন না অনেকেই। তারা মনে করেন, পায়রার কারণে ঘটা রোগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বায়ু দূষণে আক্রান্ত হন। তা বলে, পায়রার বিষ্ঠাকে সহজ ভাবার কোনও কারণও অবশ্য নেই। ফুসফুসের রোগের লক্ষণ দেখা দিলেও অনেকেই চিকিৎসা করাতে এতটাই দেরি করে দেন যে ফুসফুসের কার্যকারিতা কমতে থাকে ক্রমেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পায়রার থেকে সৃষ্ট রোগের মোকাবিলার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, তাঁদের খাওয়ানোর অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। তাতে পায়রার জনসংখ্যা কমে অনেকখানি ভারসাম্যে আসবে আর পরিবেশের অন্যান্য উপাদানগুলির সঙ্গেও সামঞ্জস্য রক্ষা হবে। কিছু কিছু জায়গায় পায়রাদের খাওয়ানোর উপর নিষেধাজ্ঞাও জারি আছে। যেমন, থানে আর মুম্বাইয়ের মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ঠিক করেছে, জনসাধারণের স্থানে পায়রাদের খাওয়াকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন কিছু জায়গায় গ্রিল বসিয়ে ট্র্যাফিকের মোড় গুলিতে পায়রাদের খাওয়ানো বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল ঠিকই। তবে তা কোনও কাজেই আসেনি।
তবে পায়রাবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে মানুষকেই খানিক সচেতন হতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে পায়রার আসা রোখা যাবে না, সেক্ষেত্রে সেই জায়গাগুলি ঘনঘন এবং ধারাবাহিকভাবে পরিষ্কার করা জরুরি। পায়রার বিষ্ঠা জমতে দেওয়া যাবে না। পায়রার পালক উড়ে আসা আটকাতে ভেজা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে সেই সব জায়গা।