গুনগুন থেকে রোহিত সেন, চরিত্রের মৃত্যু আসলে বাংলা সিরিয়ালের মৃত্যুঘণ্টা?

কেন এত শোক? আর কেনই বা এত মৃত্যু? এর মধ্যে সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার সূচকের মৃত্যুর ইঙ্গিত লুকিয়ে নেই তো?

ভরদুপুরে শোকের ছায়া বাংলার ঘরে ঘরে। গুনগুনের মৃত্যুতে দুঃখের স্রোত বয়ে যাচ্ছে, চতুর্দিকে অরন্ধনের আবহ। গুনগুন কে? দীর্ঘদিন জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা স্টার জলসার ধারাবাহিক 'খড়কুটো'-র নায়িকা বা মলাটচরিত্র। তৃণা সাহা অভিনীত এই চরিত্রটির মৃত্যু সিরিয়ালের প্রথম মহাপ্রয়াণ নয়, এর আগেও বিভিন্ন সময় বিবিধ বাংলা ধারাবাহিকে বিভিন্ন চরিত্রের মৃত্যু নিয়ে উতরোল হয়েছে দর্শকমনে। দিনকয়েক আগে 'খড়কুটো'-রই লেখক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্য আরেকটি তুমুল পপুলার ধারাবাহিক 'শ্রীময়ী'-তে যেমন টোটা রায়চৌধুরি অভিনীত রোহিত সেন চরিত্রটি, অল্পদিনেই দর্শকের ঘরে ঘরে ঝড় তোলা সেই চরিত্রের মৃত্যু পারিবারিক শোক হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন। কেন এত শোক? আর কেনই বা এত মৃত্যু? এর মধ্যে সিরিয়ালের জনপ্রিয়তার সূচকের মৃত্যুর ইঙ্গিত লুকিয়ে নেই তো? এই উত্তর খুঁজে দেখতে কিঞ্চিৎ অতীতের উথালপাথাল প্রয়োজন।

গত শতকের শেষ দুই দশক ছিল বাংলা টেলিভিশনের স্বর্ণযুগ, এমন একটা কথা প্রায়শই বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সেসময় বাংলা টেলিভিশন নেহাত নাবালক। ১৯৭৫-এ যাত্রা শুরু হয়েছে এই মাধ্যমের, এবং তার এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে শুরু হয়েছে টিভি সিরিজ এবং সিরিয়াল। এত অল্প সময়ের মধ্যে, একটা মাধ্যম নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হতে না হতেই কী করে স্বর্ণযুগ শুরু হয়ে যেতে পারে? আসলে এই 'স্বর্ণযুগ' তকমাটার বিশেষ কারণ, একাংশের দর্শকের মতে, বাংলায় দূরদর্শনের (চ্যানেল নয়, সামগ্রিকভাবে টেলিভিশন) কনটেন্টের গুণমান ক্রমে অধোগতিপ্রাপ্ত হয়েছে। এই তত্ত্বকে একটু ছানবিন করে দেখা প্রয়োজন।

বাংলা টেলিভিশনের মাভেরিক যাঁকে বলা চলে, সেই জোছন দস্তিদার যখন 'তেরো পার্বণ' করেছেন, এবং শুরু করছেন বাংলায় টিভি ফিকশনের এক নবতম ধারা, সেসময় টেলিভিশন মূলত শহুরে মধ্যবিত্তর ড্রয়িংরুমে শোভা পায়। এর কিছুদিন আগে 'হামলোগ' হয়েছে জাতীয় দূরদর্শনে, যা সর্বভারতীয় স্তরে ছোটপর্দার প্রথম ফিকশন। বাংলায় 'গল্পবিচিত্রা' করেছেন গৌতম ঘোষ। কিন্তু ১৯৮৭ সালে 'তেরো পার্বণ' প্রথম বিনোদনের গতিপথে টিভি সিরিয়াল নামক একটি ধারাকে সুস্পষ্ট করে তুলল। 'তেরো পার্বণ'-এর গোরা গেঁথে গেল বাঙালির মনে, যে চরিত্র দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক হলো সব‍্যসাচী চক্রবর্তীর। খেয়ালী দস্তিদার, ইন্দ্রাণী হালদারদের অভিনয়ে সেই কয়েকটিমাত্র এপিসোডের ধারাবাহিক বা‌ংলা সিরিয়ালের মাইলফলক। কিন্তু তখনও দূরের দ্বীপ মেগা সিরিয়াল। তারপর জোছন দস্তিদারের সোনেক্স থেকেই হয়েছে 'সেই সময়', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে। সুনীলের আরও একটি উপন্যাস 'পূর্ব পশ্চিম' নিয়েও ধারাবাহিক হয়েছে সেসময়। 'পারমিতার একদিন'-এ অপর্ণা সেন তুলে ধরলেন টিভিতে 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' দেখার আকুলতা। মনোজ মিত্র আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে জ্যান্ত হয়ে উঠল বিভূতিভূষণের ক্লাসিক। এরপর সন্দীপ রায় একে একে বানাবেন 'ফেলুদা ৩০', 'সত্যজিতের গপ্পো', 'একের পিঠে দুই' (সম্প্রচার হয়নি)‌। মোদ্দাকথা, সাহিত্যনির্ভর ধারাবাহিকের একটি প্রবণতা তখন বেশ পরিস্ফুট, বাংলা বায়োস্কোপের স্বর্ণযুগের সঙ্গে যার বেশ মিল ছিল। এর পাশাপাশিই হয়েছে 'কুয়াশা যখন'-এর মতো ধারাবাহিক, নয়ের দশকে যা রীতিমতো আলোচিত, নচিকেতার টাইটেল ট্র্যাকের সুর ইন্দ্রাণী হালদার অভিনীত এই ধারাবাহিককে আরও স্মরণযোগ্য করে রেখেছে। ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলা ধারাবাহিকের অন‍্য ধারা তৈরির প্রয়াস নিয়েছিলেন 'বাহান্ন এপিসোড' করে।

Famous serial Ganer opare by Rituparno Ghosh

'গানের ওপারে' সিরিয়ালের দৃশ্য। ফ্রেমে মিমি চক্রবর্তী ও অর্জুন চক্রবর্তী

 

সে অর্থে জনপ্রিয় মেগার শুরু বলা যায় 'জননী' এবং 'জন্মভূমি'-র জমানা থেকে। নয়ের দশকের শেষ, শেষ হচ্ছে শতাব্দীও। 'এক আকাশের নীচে' থেকে শুরু হলো মেগার একেবারে নতুন এক অধ‍্যায়। রবি ওঝা নির্মিত সেই ধারাবাহিকে কে না অভিনয় করেননি? তখন যাঁরা তারকা এবং আজ যাঁরা তারকা, তাঁদের সকলকে সত্যিই এক আকাশের নিচে হাজির করেছিল সেই ধারাবাহিক। সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, পার্থসারথি দেব (পরে সেই চরিত্রে অরিন্দম শীল), শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, চৈতি ঘোষাল, দেবলীনা দত্ত, রজতাভ দত্ত, সুদীপা বসু, অপরাজিতা আঢ‍্য, কৌশিক সেন, কুণাল মিত্র, ঋতা দত্ত চক্রবর্তী, সুনীতা দত্তগুপ্ত, অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বাদশা মৈত্র, দেবশঙ্কর হালদার, চন্দন সেন, বরুণ চন্দ, দীপঙ্কর দে, সন্তু মুখোপাধ্যায় থেকে নবাগত কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আবির চট্টোপাধ্যায়, তখনও পর্যন্ত ততটা তারকা না হওয়া মনামী ঘোষ, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, রাহুল- এখন দেখলে অলীকই লাগে। এখানে বলে রাখা ভালো, 'এক আকাশ' ছিল আলফা বাংলার (অধুনা জি বাংলা) সিরিয়াল। স্যাটেলাইট চ্যানেলকে এক ধাক্কায় অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছিল 'এক আকাশ...', দূরদর্শনের নন ফিকশন তখনও সমান জনপ্রিয়, অপর্ণা সেন করছেন কথোপকথনের অনুষ্ঠান। আবার আলফা বাংলায় হচ্ছে 'চেনা মুখ অচেনা মানুষ'। 'এবং ঋতুপর্ণ'-ও হচ্ছে স্যাটেলাইট চ্যানেলেই। আবার ইটিভি বাংলায় পরমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় তুমুল আলোড়ন তুলেছে 'রোজগেরে গিন্নি'।

Ek akasher niche

জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'এক আকাশের নীচে'-র একটি দৃশ্য

নতুন শতক শুরু হয়ে গেছে। তখনও পর্যন্ত টার্গেট অডিয়েন্স কারা ছিলেন? 'এক আকাশের নীচে'-র চিত্রনাট্যকার অনুজা চট্টোপাধ্যায়ের কথা থেকে জানা যায়, এই সিরিয়ালের টিআরপি কিছু কিছু চ্যানেলের সামগ্রিক জিআরপি-কে ছাপিয়ে গিয়েছিল। আবার এই আলফা বাংলাতেই অঞ্জন দত্ত করেছেন 'হাফ চকোলেট', দূরদর্শনের জন্য 'রুদ্র সেনের ডায়েরি', 'রাজা অপেরা'। ইটিভি বাংলায় মূলত শুরু হলো টেলিফিল্মের যুগ। এইসবই ছিল শহুরে শিক্ষিত মধ‍্যবিত্ত দর্শকের জন্য। টিআরপি-র লাভক্ষতির অঙ্কেও তা পিছিয়ে থাকেনি। এই যুগটা ফুরোচ্ছিল। বিশেষত, এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষের মুখেই‌। তারা মিউজিক-এর মতো চ‍্যানেলে তখনও পুরোদমে চলছে টেলিফিল্ম। এই সময় সিরিয়ালের ধরনধারন কিছুটা পাল্টাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ দেখা গেল স্টার জলসা-য়‌। 'চলো পাল্টাই' ছিল তাদের স্লোগান। সেই স্লোগানের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে শুরু হলো 'গানের ওপারে', নেপথ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষ। আজ পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত ধারাবাহিকগুলির একটি এই 'গানের ওপারে'। কাদের মধ্যে আলোচিত? যে দর্শক সচরাচর সিরিয়াল দেখেন না, যাঁদের শিক্ষিত, বুদ্ধিমান দর্শক বলে ধরা হয়। কারণ, যে চিত্রনাট্য, যে সংলাপ এবং অভিনয়ের যে ধরন এই ধারাবাহিকে প্রত‍্যক্ষ করা যাচ্ছিল, মেগার নামে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া দর্শক তা দেখে অবাক হচ্ছিল, ছোটপর্দায় এমনও হয়? কিন্তু টিআরপি-র অঙ্ক? তা এতটাই শোচনীয় ছিল, শেষের দিকে গল্প এবং লেখনী সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের ব্র‍্যান্ড ভ্যালু সেখানে প্রায় গৌণ হয়ে গেল।

দর্শক পাল্টাচ্ছিল, দর্শকের মনও পাল্টাচ্ছিল। এবং তার সঙ্গেই পাল্টাচ্ছিল চ্যানেলের গতিপ্রকৃতি। মাঝে মাঝে পাঁচ মিনিটের খবর নয়, দুপুরে সিনেমা নয়, সন্ধে থেকে রাতের স্লটে পরপর সিরিয়াল এবং তারপর রিয়েলিটি শো-ও নয়, প্রায় সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টার ধারাবাহিকের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল। সোম থেকে শুক্রর সিরিয়াল সংস্কৃতি পালটে গেল। প্রতিদিন সিরিয়াল, প্রতিদিনের এপিসোডিক উত্তেজনা। একইসঙ্গে পাল্টাতে লাগল কনটেন্টের প্রকৃতি। শহর থেকে দর্শক ছড়াতে লাগল গ্রামে, মফসসলে। আমাদের সা‌ংস্কৃতিক মূলধারার চিরকালের অভ্যাস, গ্রাম-শহরের রুচিকে আলাদা করে একটি ভেদরেখা টেনে দেওয়া। এখন চ্যানেলের মার্কেটিং টিম গায়েগতরে সমীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করেন অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাস। এ, বি, সি, ডি ইত্যাদি ক্যাটেগরি নির্মিত হয় তার ভিত্তিতে। টিভি আছে এমন যার কাছে ফ্রিজও আছে, গাড়িও আছে, সে এ, যার হয়তো টিভি ছাড়া তেমন ইলেকট্রনিক সম্বল নেই, সে ডি‌। মোটের ওপর এমন একটা হিসেবে দর্শক বিভাজন শুরু হলো। এবং শুরু হলো এ থেকে ডি পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণির জন্য কনটেন্ট নির্মাণের খেলা।

'ইষ্টি কুটুম' ধারাবাহিকটিকে যদি আরও একটি বাঁক হিসেবে ধরে নেওয়া যায় বাংলা সিরিয়ালের, তাহলে দেখা যাবে, সেই থেকে শুরু হয়েছিল কিঞ্চিৎ ফর্মুলা সিরিয়ালের ছক। শহরের একাংশের দর্শক নাক সিঁটকোলেন, কাঁধ ঝাঁকালেন, কিন্তু বুঝলেন না, তাঁরা, নন্দন-বিলাসী, টেলিফিল্মের গুণগ্রাহী দর্শকরা আর টার্গেট অডিয়েন্স নন। 'ইষ্টি কুটুম', 'জল নুপুর', 'পুণ‍্যিপুকুর' থেকে 'শ্রীময়ী', 'খড়কুটো', 'ধুলোকণা'- জনপ্রিয় ধারাবাহিকগুলির নেপথ্য কারিগর লীনা গঙ্গোপাধ্যায় এই নতুন সিরিয়াল যুগের প্রায় প্রবর্তক বলা যায়। লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরেই নানাবিধ ফর্মুলা বারংবার তৈরি হলো, আবার ভাঙল। 'শ্রীময়ী'-তে এসে যেমন লীনা বলতে শুরু করলেন সম্ভ্রান্ত বাড়ির এক গৃহবধূর কথা। মূলগতভাবে তথাকথিত 'পিছিয়ে পড়া মূল‍্যবোধ'-এর কথা এই সিরিয়ালগুলি বললেও, 'শ্রীময়ী'-তে নায়িকা বিয়ে ভেঙে অন্য চরিত্রের সঙ্গে বিয়ে করছেন বলে সামাজিক মাধ্যমে হারাকিরি লেগে গেল। এক প্রবীণ বামপন্থী অভিনেতা দুম করে বলে বসলেন, লীনা গঙ্গোপাধ্যায়কে গুলি করা উচিত। অত‍্যধিক প্রগতিশীলতার অভিযোগ যখন একদিকে, অন্যদিকে চূড়ান্ত রিগ্রেসিভ হওয়ার অভিযোগেও উত্তাল হয়েছে নেটদুনিয়া। কিন্তু এসবের মধ্যেও এই সিরিয়ালগুলির মূল পুঁজি ছিল জনপ্রিয়তা।

কিন্তু অসম্ভব জনপ্রিয় চরিত্র রোহিত সেনের মৃত‍্যু দিয়ে 'শ্রীময়ী' শেষ হওয়া এবং গুনগুনের মৃত্যু দিয়ে 'খড়কুটো' শেষ হওয়া দেখে একাংশের নেটিজেনের প্রশ্ন, তবে কি এই ধারার সিরিয়ালের সেই মূল ভিত্তি, অর্থাৎ জনপ্রিয়তাতেই টোল পড়ল? আবারও পালটে গেল দর্শকদের মন? এখানে বলে রাখা ভালো, যতই স্বর্ণযুগের বড়াই করা হোক, যতই বলা হোক, সেই সিরিয়াল আবার দেখা যায় না কেন, অতিমারীর প্রথম দিকে যখন 'এক আকাশের নীচে', 'গানের ওপারে' রি-টেলিকাস্ট হলো, তখন কিন্তু মানুষ আদৌ ফিরে দেখেনি তা। চ্যানেলের নিজস্ব ওটিটি বা ইউটিউবের হিসেব কী বলছে জানা নেই, তবে তা মাত্রাছাড়া কিছুও নয়, আসলে সেই সময়ের যাপন মানুষ ফিরে পেতে চায় যত না, তার চেয়ে বেশি স্মৃতিরোমন্থন বা নস্টালজিয়ার চর্চাই করতে চায়। তার জন্য টুকরো কোলাজ, কয়েকটি মাত্র ক্লিপই যথেষ্ট। কষ্ট করে আবার সেই পুরনো ধারাবাহিক ফিরে দেখতে মানুষের অনীহা। স্পষ্টভাবেই, সময় পাল্টে গেছে। দর্শকের চাহিদা নির্মাণ করা হয়েছে যেভাবে, সেভাবেই তারা থাকতে চায়। জোর করে টেনে আনা যাবে না পুরনো সময়। কাজেই শত সমালোচনা সত্ত্বেও একথা কেউ অস্বীকার করবেন না, এই সময়ের পালস, এই সময়ের গণ-অচেতনের স্নায়ুচলাচল লীনা একরকমভাবে ধরে ফেলেছেন। কিন্তু সেই গণমনও কি পাল্টাচ্ছে? টিআরপি-র চূড়ান্ত পতন কি সিরিয়ালের অবসানকল্প নির্মাণ করছে?

চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অনেকেই কিন্তু তা মানতে নারাজ। ক্রমাগত গুজব, টিআরপি নিম্নমুখী, তাই বন্ধ হচ্ছে একের পর এক সিরিয়াল। কিন্তু চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত কেউই এমন গুঞ্জনের সত‍্যতা স্বীকার করছেন না। অর্থনৈতিক কারণে শুটিং বন্ধ হওয়া থেকে শুরু করে কোভিডের বারবার ধাক্কা, এত ঝড়ঝাপটা পেরিয়েও সিরিয়াল ইন্ডাস্ট্রির পতনের কোনও শব্দ শোনা যায়নি। তাহলে হঠাৎ কী হবে? কাজ না পাওয়ায় হাহাকার, আত্মহত্যার প্রবণতা পেরিয়েও ইন্ডাস্ট্রিতে শ্রম দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের কী হবে এরম গুজব চালু হলে? এই স‌ংগত প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।

তাহলে এত জনপ্রিয় চরিত্রদের মেরে ফেলতে হচ্ছে কেন? এই বিষয়ে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ইনস্ক্রিপ্ট, তাঁর সপাট উত্তর, "এটা লেখকের স্বাধীনতা। এর পিছনে অন্য কোনও ভাবনা কাজ করছে না। লেখক কী লিখবেন, সেখানে কোনও ডিক্টেটরশিপ চলে না। গুনগুন বা রোহিত সেনের মতো চরিত্র যাতে দর্শকদের মনে থেকে যায়, তার জন‍্যই এই সিদ্ধান্ত‌।" নেটদুনিয়ায় ট্রোলের বন্যাকে একচুল পাত্তা দিতে রাজি নন লীনা। বললেন,

"সোশ্যাল মিডিয়ায় কী লেখা হচ্ছে জানি না। কিন্তু সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা তো ভালবাসছেন গল্প, চরিত্রের পরিণতি কষ্ট দিতে পারে, কিন্তু তাই নিয়ে কোনও অনুযোগ নেই।" জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা চরিত্রের মৃত্যুতে দর্শকের প্রতিক্রিয়া এতটাই সহজ? দর্শক কি তাহলে বদলাচ্ছে? লীনা বলছেন, "সময় পাল্টাচ্ছে, দর্শক তো পাল্টাবেই।"

রোহিত সেনের ভূমিকায় অভিনয় দর্শকের ঘরের লোক করে তুলেছে টোটা রায়চৌধুরিকে আবারও। তিনি কিন্তু এর কৃতিত্ব দিচ্ছেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়কেই। ইনস্ক্রিপ্ট-কে তিনি জানালেন,

"এখানে লেখিকার মুনশিয়ানা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সেই চরিত্র গেছে, তাকে রোজ নানা আঙ্গিকে আবিষ্কার করে গেছেন দর্শক। সব চরিত্রের মৃত্যু অবশ্যই এমন অভিঘাত তৈরি করে না। আর একথাও ঠিক, সিরিয়ালের সঙ্গে দৈনন্দিনের যোগাযোগ দর্শকদের, তাই সিরিয়ালের চরিত্র তাঁদের কাছে ঘরের লোক। সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে যোগাযোগে একটা আবডাল থাকে, একটা দূরত্ব থাকে। সিরিয়ালের ক্ষেত্রে তা থাকে না। আর এই চরিত্রের মৃত্যু হিন্দি সিরিয়ালের দর্শককেও ভয় পাইয়েছিল। 'শ্রীময়ী'-র হিন্দি সংস্করণ 'অনুপমা'-র দর্শকরা ভাবছিলেন, সেখানে এই চরিত্র, যার নাম ছিল অনুজ, তার মৃত্যু হবে কি না। এই পরিমাণ সংবেদন তৈরি করা একান্তই লেখিকার কৃতিত্ব।"

মোদ্দা কথা, একের পর এক সিরিয়াল শেষ যেমন হচ্ছে, নতুন সিরিয়াল শুরুও হচ্ছে, এখন, এক-দেড় দশক কাটিয়ে সিরিয়াল আবার গতিপথ পালটাবে কি না, তা সময়ই বলবে। তবে ইন্ডাস্ট্রির মৃত্যুঘণ্টা সত্যিই বাজলে, গুনগুনের মৃত্যু নিয়ে দর্শকের কান্নার আভাস আদৌ পাওয়া যেত না।

More Articles