মাত্র দু'পাতা পড়েই রুশদিকে খুনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে!

এমন ঔপন্যাসিকও ইসালামিক রক্তচক্ষুর হাত থেকে রেহাই পেলেন না। পরিণাম, গন্তব্য ভেল্টিলেশন। প্রাণে বেঁচে গেলেও বড় কোনও মাশুল দিতে হবে না তো? বিশ্বের সুস্থ বিবেক এমনটা তো ভাববেই।

সলমন রুশদি গত পাঁচ দশকে তাঁর সাহিত্য কর্মের জন্য বারবার হত্যার হুমকি পেয়েছেন। সাফল্য তাঁকে বিশ্বখ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছে। সঙ্গে পাথেয় হুমকি আর ফতোয়া। তবে তাতে আমল দেননি বুকারজয়ী `মিডনাইট চিলড্রেনে’র স্রষ্টা। সেটাই কী কাল হল!

শেষপর্যন্ত এ আর হুমকিতে সীমাবদ্ধ থাকল না। নিউইয়র্কে তাঁর ওপর বর্বরোচিত হামলা দেখল বিশ্ব। নিন্দার ঝড় উঠবে এতো স্বাভাবিক। তবে হয়ত তাঁকে চোখ খুইয়ে বড় মাশুল দিতে হবে হামলার। কোনও হামলা, হুমকি, ফতোয়া এসব যে স্রষ্টার কলমকে থামাতে পারে না, তা আগেও প্রমাণ করছেন রুশদি। তাঁর অনেক উপন্যাস ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। যার মধ্যে ১৯৮১ সালে বুকার পুরস্কার জেতা তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস `মিডনাইট চিলড্রেন’। তবে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তাঁর চতুর্থ বই `স্যাটনিক ভর্সেস’ হল তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত কাজ, যা তাঁকে বারবার বিপদে ফেলে দেয়। গত সপ্তাহে সীমাহীন বর্বরতার সাক্ষী থাকল সারা বিশ্ব। এই হামলার নেপথ্যে কে? তিনি কেন এই হামলা চালালেন? তাঁর বয়ান রেকর্ড করেছে এক সংবাদমাধ্যম।

গত সপ্তাহেই নিউইয়র্কে শতকা ইনস্টিটিউশনের তরফে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান চলাকালীনই বুকারজয়ী সাহিত্যিকের উপরে হামলা হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বার ছুরিবিদ্ধ হন সলমন রুশদি। মঞ্চ থেকেই গ্রেফতার করা হয় হামলাকারী হাদি মাতারকে। সম্প্রতিই তাঁকে আদালতে পেশ করা হলে, অভিযুক্ত হাদি দাবি করেন তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। তবে আদালত তাঁর দাবিতে কান না দিয়ে অজামিনযোগ্য ধারায় আপাতত কারাবাসের নির্দেশ দেয়। নিউইয়র্ক পোস্ট জেলবন্দি হাদির একটি সাক্ষাৎকার নেয়। সেই সাক্ষাৎকারেই হাদি বলেন, “যখন আমি শুনলাম যে উনি (সলমন রুশদি) বেঁচে গিয়েছেন, তখন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।” ১৯৮৯ সালে ইরানের দেওয়া ফতোয়ায় অনুপ্রাণিত হয়েই ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-র লেখক সলমন রুশদির উপরে হামলা চালিয়েছিল কিনা অভিযুক্ত, সেই বিষয়ে কিছুই জানায়নি হাদি। তবে তিনি বলেন, “আমি আয়াতোল্লাহকে সম্মান করি। আমার মতে উনি একজন অসাধারণ মানুষ। এই বিষয়ে আমি এতটাই বলতে পারি।”

উল্লেখ্য, ৯০-র দশকে ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেইনিই সলমন রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিলেন `দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইয়ে ইসলাম ধর্ম ও নবি মহম্মদকে অসম্মান করার জন্য।

হাদি মাতার রুশদির কোনও বই পড়েছেন কিনা, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি কয়েকটা পাতা পড়েছি। আমি ওনাকে (সলমন রুশদি) একদম পছন্দ করি না। আমার মতে উনি ভাল মানুষ নন। উনি এমন একজন, যিনি ইসলামকে আক্রমণ করেছেন, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসে আক্রমণ করেছেন।”

আরও পড়ুন-কেন আক্রমণ সলমন রুশদির ওপর? আসল কারণ লুকিয়ে সেই ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে’

‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-র দু’পাতা পড়েই মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল। অপেক্ষা করছিলেন সুযোগের। ট্যুইট দেখে জানতে পারেন বক্তৃতা দিতে আসবেন ওই বইয়ের লেখক। মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চাঞ্চল্যকর দাবি সলমান রুশদিকে খুনের চেষ্টায় অভিযুক্ত হাদি মাতারের। বর্তমানে নিউ ইয়র্কের জেলে বিচারাধীন বন্দি হিসেবে রয়েছেন বছর ২৪-র ওই যুবক। জেলে বসেই একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে আটলান্টিকের পাড়ে।

কী বলেছেন রুশদির উপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হাদি মাতার? মার্কিন সংবাদ সংস্থায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার অনুযায়ী মাতারের দাবি, “রুশদি একটা শয়তান। বারবার তিনি ধর্মকে আক্রমণ করেছেন। যাঁরা ইসলামকে মেনে চলেন, তাঁদের বিশ্বাসে আঘাত হেনেছেন তিনি। যা ক্ষমাহীন অপরাধ।” পাশাপাশি, ইরানের সুপ্রিম নেতা আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমিনি-কে ‘মহান ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করেছেন মাতার।

‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হওয়ার পর এই খোমিনি-ই রুশদির নামে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিলেন। এরপর থেকেই অন্তরালে চলে যান রুশদি। যদিও তাঁর উপর প্রাণঘাতী হামলার নেপথ্যে ইরানের হাত রয়েছে কিনা তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি হাদি মাতার।

মার্কিন সংবাদসংস্থায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ মাত্র দু’পাতা পড়েই রুশদিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন অভিযুক্ত যুবক। “তাঁর (রুশদির) বেশ কিছু ভাষণও শুনেছি। সবসময় অযৌক্তিক কথা বলেন তিনি। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ট্যুইট চোখের পড়ে। সেখান থেকেই তাঁর ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার বিষয়ে জানতে পারি।“ সাক্ষাৎকারে হাদি এমনটাই দাবি করেছেন বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদসংস্থা।

সলমান রুশদিকে ছুরিকাঘাতের ঘটনায় আটক ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ। হামলার কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সন্দেহভাজন হামলাকারীর নাম হাদি মাতার। ২৪ বছর বয়সী এই যুবক নিউ জার্সির ফেয়ারভিউয়ের বাসিন্দা। দ্য গার্ডিয়ানের খবরে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। নিউইয়র্ক পুলিশের মেজর ইউজিন স্ট্যানিসজেউস্কি বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাদির অ্যাকাউন্টগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে, তিনি শিয়া চরমপন্থি এবং ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রতি সহানুভূতিশীল। হাদির ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়েও তথ্য পেয়েছে নিউইয়র্ক পুলিশ।

রুশদির সবথেকে বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত বই হল ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। ১৯৮৮ সালেই ইরানে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ইরান এবং বিশ্বের আরও অনেকের মতে বইটি ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারী। বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণার এক বছর পর, ইরানের প্রয়াত নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি সালমা রুশদির মৃত্যুর আহ্বান জানিয়ে একটি ফতোয়া জারি করেছিলেন। রুশদিকে হত্যা করলে ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলারের বেশি পুরস্কার দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে দিয়েছে ইরান। তবে এদিনের হামলার সঙ্গে ইরানের কোনও সংযোগ আছে কি না, সেই বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে মার্কিন পুলিশ।

দীর্ঘদিন আগেই অবশ্য ইরান সরকার খোমেইনির সেই ফতোয়া থেকে নিজের দূরত্ব বাড়িয়েছে। কিন্তু, তারপরও ইরানে রুশদি-বিরোধী মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি। ২০১২ সালে এক আধা-সরকারি ইরানী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রুশদির মাথার দাম বাড়িয়ে ৩৩ লক্ষ মার্কিন ডলার করেছিল। ফুৎকারে সেই হুমকি উড়িয়ে দিয়েছিলেন রুশদি। ভারতীয় লেখক সেই সময় বলেছিলেন, “কেউ এই পুরস্কার নিতে আগ্রহী এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।” শুধু তাই নয়, ওই বছরই খোমোইনির সেই ফতোয়াকে বিষয়বস্তু করে ‘জোসেফ অ্যান্টন’ নামে একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ করেছিলেন।

সলমান রুশদি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ হলেও গত ২০ বছর ধরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বসবাস করেন। ১৯৭৫ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তাঁর প্রতিভার আসল পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল ১৯৮১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’। আধুনিক ভারত সম্পর্কে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তিনি বুকার পুরস্কার জিতেছিলেন। তবে, তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ চরম বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তারপর দীর্ঘদিন তিনি লোকচক্ষুর বাইরে ছিলেন। তবে, ১৯৯০-এর দশকেও বেশ কয়েকটি দুর্দান্ত উপন্যাস তিনি উপহার দিয়েছেন। ২০০৭ সালে সাহিত্য সেবার জন্য তিনি নাইট উপাধি পেয়েছিলেন।

এমন ঔপন্যাসিকও ইসালামিক রক্তচক্ষুর হাত থেকে রেহাই পেলেন না। পরিণাম, গন্তব্য ভেল্টিলেশন। প্রাণে বেঁচে গেলেও বড় কোনও মাশুল দিতে হবে না তো? বিশ্বের সুস্থ বিবেক এমনটা তো ভাববেই।

More Articles