কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের 'সুরক্ষা কবচ' কোথায়? এত বড় দুর্ঘটনার দায় কার?

Kanchanjunga Express Accident: কবচ কাজ করলে তা দুই চালককেই সতর্ক করে দিতে পারত এবং ট্রেন থামিয়ে দিতে পারত।

ঠিক এক বছর আগের একদিন। এমন জুন মাসেই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা দেখেছিল দেশ। ২৮৯ জনের মৃত্যু ঘটেছিল সেবার। ওড়িশার বালেশ্বরে করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়েছিল। আবারও জুন মাসেই মর্মান্তি দুর্ঘটনা উত্তরবঙ্গে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা আবারও প্রশ্ন তুলছে রেলের উন্নয়ন নিয়ে যা যা বুলি সরকার আওড়ায়, সবটাই আসলে জনগণকে বোকা বানানোই নয় তো? যাত্রীদের সুরক্ষা 'কবচ' জোগাতে ডাহা ফেল ভারতীয় রেল? তাহলে ঢালাও বিজ্ঞাপন, বেসরকারিকরণ, স্টেশনে ঝকঝকে শপিংমল-সম আলোর রোশনাইয়ের আড়ালে আসলে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে যাত্রীদেরই? প্রতিবছরই একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনা আঙুল তুলছে যাত্রী সুরক্ষার দিকে।

মানুষের ভুলে যাতে ট্রেনে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে তা রুখতেই ভারতীয় রেল 'কবচ' সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের লাইনে কীভাবে মালগাড়ি চলে এল? এখনও অবধি কেবল অনুমান করা হয়েছে যে, মালগাড়ির চালক ভুল করেই একই লাইনে এসে যান এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে পিছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেন। এমন ভুল একমাত্র সিগন্যালের সমস্যাতেই হতে পারে। তাহলে সিগনাল না বোঝা বা সিগনাল দিতে ভুল করা একেবারেই মানুষের ভুল। সেই ভুল আটকানো গেল না কেন 'কবচ' দিয়ে? রেল সুরক্ষা মজবুত করতে যে অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তা কাজ করল না কেন? সিগন্যাল ভুল হলেও দুর্ঘটনা আটকানোর জন্য তো বন্দোবস্ত করেছিল রেল। তা এখানে ছিল না?

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, রাঙাপানি স্টেশনে ঢোকার আগে সিগন্যালের কারণে দাঁড়িয়ে ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সেই সময়ে ওই লাইনেই ঢুকে পড়েছিল মালগাড়ি। পিছন থেকে সজোরে সেটি ধাক্কা মারে। একেবারে শেষের কামরাটি উপরে উঠে যায় এবং শূন্যে ঝুলতে থাকে। মালগাড়িটিও লাইনচ্যুত হয়।

 

আরও পড়ুন- লাইনচ্যুত কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, মৃত ৫! কীভাবে ঘটল ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা?

কবচ কাজ করলে তা দুই চালককেই সতর্ক করে দিতে পারত এবং ট্রেন থামিয়ে দিতে পারত। একই লাইনে দু'টি যদি ট্রেন নিরাপদ দূরত্ব পেরিয়ে কাছাকাছি চলে আসে তাহলে এই কবচ সক্রিয় হয়ে যায়। তাতে ব্রেক পড়ার কথা এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ট্রেনের গতিরোধ করার কথা। রিসার্চ ডিজাইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন এই নতুন প্রযুক্তি তৈরি করেছিল। কুয়াশা ও অন্য কোনও দৃশ্যমানতার অভাব কিংবা দ্রুত গতির ট্রেন সিগন্যাল ফেল করলেই কবচ সক্রিয় হয়ে ওঠে।

বলা হচ্ছে, ওই বিভাগের ইলেকট্রনিক ইন্টারলকিং সিস্টেম ব্যর্থ হয়েছে। পিএলসি বা পেপার লাইন ক্লিয়ারেন্সের মাধ্যমে ট্রেনগুলি পরিচালনা করা হচ্ছিল। এই ক্ষেত্রে, পিএলসি TA 912 নামে একটি নির্ধারিত ফর্ম জারি করা হয়, যাতে সংশ্লিষ্ট স্টেশন ম্যানেজার সই করেন। রঙপানি স্টেশনে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে 0সকাল ৮ টা ২৭ মিনিটে TA 912 দেওয়া হয়েছিল। এরপর ট্রেনটি ছাতারহাট স্টেশন এবং বিহারের রানিপাত্র স্টেশনের মাঝে থামানো হয়। এখানে ট্রেনটি মালগাড়ির ধাক্কা খায়। প্রশ্ন উঠছে মালগাড়ির লোকো পাইলটকে TA 912 কে দিল? পণ্যবাহী ট্রেনটি কোনও সিগন্যাল ছাড়াই এগিয়ে গেল কীভাবে? যদি একটি বিভাগের স্বয়ংক্রিয় সংকেত সিস্টেমটি ব্যর্থ হয়, তাহলে সমস্ত সংকেতই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাল হয়ে যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে কি রানিপাত্র স্টেশনে ঢোকার ঠিক আগের সিগন্যালে থামানো হয়েছিল? যদি তাই হয়, তাহলে সেটা কি ছাতারহাট স্টেশন এবং রাঙাপানি স্টেশনকে জানানো হয়নি?

এখানে কবচ ছিল না তাহলে? ভারতীয় রেল ১০ হাজার কিমি রেললাইনের জন্য টেন্ডার ডেকেছিল। এর মধ্যে ৬ হাজার কিমি পথের টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ-মধ্য রেলের ১৪৬৫ কিমি পথের ১৩৯টি ইঞ্জিনে কবচ লাগানো হয়েছে। কবচের বরাত পেয়েছে দিল্লি-মুম্বই (আমেদাবাদ-বদোদরা সেকশন) এবং দিল্লি-হাওড়া (লখনউ-কানপুর সেকশন) করিডর।

পূর্ব রেল, পূর্ব-মধ্য রেল, উত্তর-মধ্য, উত্তর রেল, পশ্চিম-মধ্য রেল এবং পশ্চিম রেলের প্রায় ৩ হাজার রুটে কবচ দেওয়া হয়েছে। এত কবচ গেল কোথায়? উত্তরবঙ্গের মতো গুরুত্বপূর্ণ রেল পথে যে কবচ ব্যবস্থা রাখতেই হবে এ তো অজানা নয়? নিউ জলপাইগুড়ি-শিয়ালদহ লাইনে কবচ সুরক্ষা যদি নাই থেকে থাকে তাহলে এই টেন্ডারগুলিই বা কোথায় কাদের দেওয়া হলো? যাত্রী সুরক্ষায় এত চরম ব্যর্থ হওয়ার পরে কেন পদত্যাগ করবেন না রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব?

More Articles