সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার মাশুল! জাফর পানাহির গ্রেপ্তারি নিয়ে উত্তাল বিশ্ব

মোস্তাফা আল মাহমেদ এবং মহম্মদ রাসুলাফ- এই তালিকায় জুড়ে গেল আর একটা নাম। জাফর পানাহি। ইরানের কট্টর মৌলবাদী সরকার এবং নিরাপত্তাবাহিনীর দমনপীড়ন নিয়ে কণ্ঠ ছেড়েছিলেন পানাহি। তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করা হলো।

মোস্তাফা আল মাহমেদ এবং মহম্মদ রাসুলাফ- এই তালিকায় জুড়ে গেল আর একটা নাম। জাফর পানাহি। ইরানের কট্টর মৌলবাদী সরকার এবং নিরাপত্তাবাহিনীর দমনপীড়ন নিয়ে কণ্ঠ ছেড়েছিলেন পানাহি। তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করা হলো। একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা যে সরকারের 'বেয়াড়াপনা’-র বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবেন, এ আর কী এমন আশ্চর্যের! পানাহি সেই কাজটাই করেছিলেন। জেলের দরজা দেখিয়ে তাঁকে যে থামানো যায় না, আবারও তা প্রমাণ করলেন তিনি। কারণ কিছুদিন আগেই তাঁকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এরপর সরকারের তোষণ তো দূর অস্ত! তিনি 'তুঘলকি’ আচরণ নিয়ে সরব হন। আবারও তার মাশুল দিতে হলো তাঁকে। পরিণতি গ্রেপ্তার!

ফ্রান্সের এক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ১১ জুলাই তেহরান থেকে 'স্বর্ণভালুক’-জয়ী পরিচালক পানাহিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইরানের স্বৈরাচারী সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত পানাহিকে এর আগেও গ্রেপ্তার করা হয়। সরকার-বিরোধী প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য ২০১০ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। তখন তাঁর ৬ বছরের জেল হয়। সিনেমা তৈরি এবং চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি তাঁর দেশত্যাগের ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

গত সপ্তাহে ইরানের দুই চলচ্চিত্র-নির্মাতা মোস্তাফা আল আফমেদ এবং মহম্মদ রাসুলফকে গ্রেফতার করে ইরানের নিরাপত্তাবাহিনী। তাঁদের মামলার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে আইনজীবীর কাছে গিয়েছিলেন পানাহি। সেখানেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।

আরও পড়ুন: বিবেকানন্দই অনুপ্রেরণা ছিলেন নিহত শিনজো আবে-র

মে মাসে ইরানের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের শহর আবাদানে একটি বাড়ি ধসে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখান সাধারণ মানুষ। সেই বিক্ষোভকে সমর্থন করায় আহমেদ এবং রাসুলফকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ নিয়ে আবার সরব হন পানাহি। এর মাশুল দিতে হলো তাঁকেও। `দ্য সার্কল’, 'অফসাইড’, 'ট্যাক্সি’-র মতো ছবি তৈরি করে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন পানাহি। তাঁকে ইরানের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রকার বলে মনে করা হয়। ফলে তিনি গলা ছাড়লে, তা যে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করবে, তা ভালোই বুঝেছিল সরকার। তাই হয়তো ভয় থেকেই তারা পানাহিকে জেলের দরজা দেখিয়ে দিল। কিন্তু এতে কি সমাজের কণ্ঠ রুদ্ধ করা যায়? বোধহয় না। ইতিহাস সেকথা বলে না। যুগে যুগে সমাজকে আলো দেখাতে আসেন পানাহিরা, জেল তাঁদের আওয়াজ দমন করতে পারে না, তা নিরাপত্তাবাহিনী যত বলশালীই হোক না কেন!

সাপ্তাহিক মার্কিন বিনোদন ম্যাগাজিন 'ভ্যারাইটি'-র অনলাইন ভার্সন এই নিয়ে সরব হয়েছে। 'ভ্যারাইটি' লিখেছে, গত মে মাসে ইরানে শহর আবাদানে একটি ভবন ধসে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়। এই নিয়ে সাধারণ জনগণের বিক্ষোভে নিরাপত্তাবাহিনীর দমনপীড়ন নিয়ে সোচ্চার ছিলেন আল আহমেদ ও রাসুলফ। 'পুট ইওর গান ডাউন’- হ্যাশট্যাগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার পর তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে তাঁদের গ্রেফতারি নিয়ে সরব হন জাফর পানাহি। পানাহি-সহ ইরানের ৭০ জন নির্মাতা গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছেন। এর মধ্যেই পানাহির গ্রেপ্তারের খবর আসে। অর্থাৎ, ইরানের সরকার যে বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিতে সবরকম চেষ্টা চালাচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।

'দ্য সার্কল', 'অফসাইড', 'ট্যাক্সি' তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি দিয়েছে। তাই তাঁর গ্রেপ্তারি নিয়ে তোলপাড় বিশ্ব। সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে। ২০০০ সালে `দ্য সার্কল’-এর জন্য গোল্ডেন লায়ন, `ক্রিসন গোল্ড’ সিনেমার জন্য ২০০৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের আঁ সেত্রাঁ রিগা বিভাগে পুরস্কার পান তিনি। ৬২ বছরের এই চলচ্চিত্র-নির্মাতা বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের টপ প্রাইজ, দ্য গোল্ডেন বিয়ার। ২০১৫ সালে 'ট্যাক্সি’-র জন্য এই পুরস্কার পান তিনি। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার পান ২০১৮ সালে। `থ্রি ফেসেস’ ছবির জন্য এই বিশেষ ক্যাটেগরিতে এই পুরস্কার পান তিনি।

পানাহিকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ্যে আসতেই কান চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে তিন নির্মাতার মুক্তির দাবি তুলেছে। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, গভীরভাবে এই গ্রেপ্তারির নিন্দা করছি। অবিলম্বে এঁদের মুক্তির ব্যবস্থা করুক সরকার। বার্লিনও বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। পানাহি নিজেই সোশ্যাল মিডিয়াকে আশ্রয় করে গলা ছেড়েছিলেন। তাতে সুর মিলিয়েছিলেন দেশের অসংখ্য মানুষ। সংখ্যাটা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। প্রায় ৫০০ ইরানিয়ান চলচ্চিত্রকার ও সমাজকর্মী শুধু ইনস্টাগ্রামেই তাঁর পোস্টের সমর্থনে আওয়াজ তুলছেন। তাঁরা বলেছেন, আমরা এর তীব্র নিন্দা করছি। যেভাবে স্বাধীন চলচ্চিত্রকার, মুক্ত চিন্তক এবং স্বাধীন মতাদর্শীদের কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে, সারা বিশ্ব তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে।

পানাহির স্ত্রী বিবিসি-কে জানিয়েছেন, তিনি খবর পেয়েছেন, তাঁর স্বামী দুই সহকর্মীর গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতিতে সই করেছিলেন। তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই প্রথম নয়, এর আগেও সরকারের সমালোচনা করায় তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। তিনি ভয় পাওয়ার মানুষ নন। তাই তো তাঁর হাতিয়ার চলচ্চিত্রভাষা। তাঁকে একটা সরকারের এই নির্লজ্জ আচরণ দমিয়ে দিতে পারবে না।

সরকারের সমালোচনা করায় গত কয়েক দশকে বহু ভিন্ন-মতাদর্শী ও স্বাধীন চিন্তকদের জেলে ভরেছে তেহরান। এই ব্যাপারে সরকার নিন্দার পরোয়া করে না। ধৃতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও বুদ্ধিজীবী। অনেকে গ্রেপ্তার না হলেও গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

অর্থাৎ একদিকে একটা 'তুঘলকি' সরকার, অন্যদিকে সারা দেশ, রয়েছেন মুক্ত চিন্তকরা, এরপরও স্বাধীন আওয়াজ উঠবে না তেহরানের বুকে?

More Articles