১ লক্ষেরও বেশি মৃত্যু! কেন অন্য বিপর্যয়ের থেকে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ভারতে?
Lightning Strikes: ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে হতাহতের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বজ্রপাতে যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে ৬৮% আদিবাসী
প্রায় ১৫ জন বন্ধুর দল। এক গ্রাম থেকে দল বেঁধে রওনা দিয়েছে পাশের গ্রামে হকি ম্যাচ খেলতে যাবে বলে। ১৪ অগাস্ট দুপুর বেলা। ঝাড়খণ্ডের সিমডেগা জেলার তুটিকেল গ্রামের বাসিন্দা সবাই। গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে প্রধান সড়ক। পাশের গ্রামটির নাম ঝাপলা। প্রায় ৭ কিমি দূরে সেই গ্রাম। স্কুটার ও মোটরসাইকেলে চেপে দুপুর দেড়টার দিকে দলটি ঝাপলার খেলার মাঠে পৌঁছয়। খেলার প্রস্তুতি শুরু করতেই হালকা বৃষ্টি শুরু হল। কিছুজন খেলোয়াড় খেলার মাঠের পাশে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে আশ্রয় নিল। অন্যরা পাশের একটি খাবারের স্টলে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন পারস ডাং এবং তার ভাই সেনান ডাং। তখনই ঘটে সেই ভয়াবহ ঘটনা!
প্রচণ্ড জোরে এক বাজ পড়ে ওই গাছে! গাছের ডাল থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। পারাস, তার ভাই এবং অন্য ছয়জন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সঙ্গে সঙ্গে। বজ্রপাত যে কী ক্ষতি করতে পারে তা কল্পনাতীত! বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, একটি বজ্রপাত ৩০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গরম হতে পারে। ওই গাছে বাজ পড়ার পরে পারস বলেছিলেন, "আমি অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে আমার শেষ মনে আছে আমি ভাইয়ের মাথায় ছাতা ধরেছিলাম। ভাই গাছের নীচে স্কুটার স্ট্যান্ড করছিল।" মার্সালান ডাং, আরেকজন খেলোয়াড়, খাবারের স্টলে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি জানান, কয়েক মিনিটের মধ্যে, ওই অচেতন মৃতদেহ মাটিতে পড়ে থাকতে থাকতেই বৃষ্টি নামল। বজ্রপাতটি এতটাই জোরে হয়েছিল যে সকলে চমকে যায়। গাছের নীচে গিয়ে বন্ধুদের দেখতেও ভয় পাচ্ছিলেন তারা। শেষমেশ কয়েকজন ছুটে এসে গাছের নীচ থেকে খেলোয়াড়দের বের করে আনেন। দেখেন, তিনজনের হৃদস্পন্দন নেই কোনও।
আরও পড়ুন- মহাকাশ দখলের লড়াইয়ে বিপদ পৃথিবীরই? পরিবেশের যে ক্ষতি ডেকে আনছে রাশি রাশি উৎক্ষেপণ
মুন্ডা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রথা মেনে একটি ওষুধ ব্যবহার করেন, গোবর। অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ছিলেন মুন্ডা। গোবর পোড়ার ঘা থেকে শরীরকে ঠান্ডা করতে সাহায্য করে বলে তাঁদের বিশ্বাস। তাই, সতীর্থরা কাছাকাছি একটি বাড়িতে ছুটে গিয়ে কিছুটা গোবর নিয়ে আসে। বাজে পোড়া শরীরগুলিতে তা লাগিয়ে দেয়। ঝাপলা গ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। জরুরি চিকিৎসার কোনও বন্দোবস্তই করা যায়নি। অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করার জন্য প্রধান সড়কের দিকে পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁদের।
অ্যাম্বুলেন্স এসে সাতজন খেলোয়াড়কে কোলেবিরা শহরের কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে নিয়ে যায়, সেখান থেকে তাদের সিমডেগা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনজন খেলোয়াড় - সেনান ডাং, এনোস বুর এবং নির্মল হোরোকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়। অন্য পাঁচজন - ক্লেমেন্ট বাগে, জয়েশ বাগে, সেলিম বাগে, পাত্রাস বাগে এবং পারস ডাংয়ের চিকিৎসা চলে। সেরে ওঠেন তারা। তবে চামড়া পোড়ার যন্ত্রণা সহ্যাতীত! আমাদের দেশে বাজ পড়ে মৃত্যু অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবাংলায় এমনটা অহরহ ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের সংখ্যা এবং বজ্রপাতের ঘটনা দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। নিরক্ষরেখা এবং ভারত মহাসাগরের সঙ্গে ভারতের নৈকট্য থাকায় এখানে বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি।
২০২৪ সালের একটি গবেষণাপত্রে ১৯৬৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫৩ বছরের ব্যবধানে, বজ্রপাতের কারণে ভারতে মোট ১০১,৩০৯ জন মারা গেছেন। প্রতি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বজ্রপাতের কারণে গড় বার্ষিক প্রাণহানি বেড়েছে। ১৯৬৭ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ৩৮ থেকে, ২০০৩-২০২০-র মধ্যে তা বেড়ে হয়েছে ৬১। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য বলছে, প্রাকৃতিক শক্তি যেমন, বন্যা, ভূমিধস এবং তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বজ্রপাতের কারণে ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মৃত্যুর ঘটেছে৷ এনসিবির ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ধরনের ৮,০৬০টি মৃত্যুর মধ্যে ২,৮৮৭টিই ঘটেছে বজ্রপাতের কারণে! অর্থাৎ মোট ৩৫.৮% মৃত্যু!
লাইটনিং রেজিলিয়েন্স ইন ইন্ডিয়া ক্যাম্পেইন অনুসারে, ঝাড়খণ্ড এবং মধ্য ও পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলি, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ছত্তিশগড় এবং মধ্যপ্রদেশ বজ্রপাতের হটস্পট। পশ্চিম হিমালয় অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্ব ভারতেও প্রায়শই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। যে রাজ্যগুলিতে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক মারা গেছে তার মধ্যে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, সেখানে ৪৯৬ জন মারা গেছে, বিহারে ৩২৯ জন, ওড়িশায় ৩১৬ জন, উত্তরপ্রদেশে ৩০১ জন এবং ঝাড়খণ্ডে ২৬৭ জন। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০২১-২২ সালের তথ্য বলছে, এই রাজ্যেই মোট ৩৫০ জন প্রাণহানির রেকর্ড রয়েছে। রাজ্যে বজ্রপাতের কারণে হতাহতের সংখ্যা কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ২০১৪-২০১৫ সালে যেখানে ১৪৪টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল, ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর সেখানে ৩০০টিরও বেশি মৃত্যু ঘটছে।
বিজ্ঞানীদের একাংশ বজ্রপাতের বৃদ্ধিকে জলবায়ু সঙ্কটের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। লাইটনিং রেজিলিয়েন্ট ইন্ডিয়া ক্যাম্পেইন বলছে, বজ্রপাত বৃদ্ধি পেতে পারে এমন কারণগুলির মধ্যে রয়েছে উষ্ণায়ন, পরিবেশের অবক্ষয়, ব্যাপক কার্বন নির্গমন, দূষণ যার ফলে অ্যারোসলের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলাশয়ের অবক্ষয়, বনভূমি ধ্বংস, নগরায়ন, দ্রুত শিল্পায়ন।
বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনোরঞ্জন মিশ্র বলছেন, "যদিও জলবায়ু সঙ্কটের সঙ্গে বজ্রপাতের বৃদ্ধিকে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত করা যায় না, তবে বলা যেতে পারে যে মানুষের কার্যকলাপ জলবায়ুতে পরিবর্তন এনেছে যা বজ্রপাতের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা বৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। তাপমাত্রার ১% বৃদ্ধির ফলে আর্দ্রতা ১০-১৪% বৃদ্ধি পায়।"
দ্য স্ক্রোলকে মনোরঞ্জন মিশ্র জানিয়েছেন, বজ্রপাতের কারণগুলিও বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে পৃথক। মধ্য ও পূর্ব ভারতের কিছু অংশে, ভারী খনির কারণে বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসল এবং দূষকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বজ্রপাতের কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে। বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তনগুলিও এই ধরনের কার্যকলাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি নিয়মিত বৃষ্টিপাত হয় তবে কম বজ্রপাত হবে। যদি অনেক বিরতির পর বৃষ্টি হয় তবে বেশি বজ্রপাত হবে।
আরও পড়ুন- এক কোটি গাছ কাটা হবে নিকোবরে! সবুজ ধ্বংসের কারণ কী?
২০২১ সালের লাইটনিং রেজিলিয়েন্ট ইন্ডিয়া ক্যাম্পেইন রিপোর্ট অনুসারে, ৯৬% বজ্রপাতজনিত মৃত্যু গ্রামীণ ভারতে ঘটে। যারা দীর্ঘ সময় ধরে বাইরে কাজ করেন, যেমন কৃষক, শ্রমিক এবং গরু চরাতে যান যারা তাদের বজ্রপাতের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। সেই বছর যারা বজ্রপাতে মারা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে ৭১% গাছের নিচে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে হতাহতের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বজ্রপাতে যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে ৬৮% আদিবাসী।
বজ্রপাত সংক্রান্ত সমস্ত মৃত্যুর ৮৫% বর্ষায় ঘটে। এক্ষেত্রে প্রায়শই যারা দীর্ঘ সময় ধরে জলে কাজ করে, যেমন কৃষকরা, তারা ভুক্তভোগী হন। কৃষিক্ষেত্রগুলি সাধারণত সমতল, খোলা মাঠ, ফলে কোথাও কোনও আশ্রয় নেই। তাছাড়া চাষের জমিতে জল জমে থাকে বলে তা বিদ্যুতের জন্য শক্তিশালী পরিবাহী হিসাবে কাজ করে। দ্বিতীয় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটে এপ্রিল ও মে মাসের প্রাক-বর্ষাকালে। সঙ্গে ছাতা থাকে না অধিকাংশের। তারা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মানুষ গাছের নীচে আশ্রয় নেয়। খোলা মাঠে বড় গাছগুলিই সাধারণত সবচেয়ে লম্বা বস্তু হয়ে থাকে। ফলে গাছে বজ্রপাতের সম্ভাবনাও বেশি থাকে। তাছাড়া মাটির বাড়িতে বসবাসকারী মানুষও বজ্রপাতে বেশি মারা যান।
বজ্রপাতের সময়টিও গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব ও মধ্য ভারতে সাধারণত দিনের বেলা ১২ টা থেকে সন্ধে ৭ টার মধ্যে বজ্রপাত হয়, যখন লোকেরা বাইরে থাকার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে, হিমালয় অঞ্চলে, সাধারণত রাতে বজ্রপাত হয়, যখন বেশিরভাগ লোকের বাড়ির ভিতরে থাকার সম্ভাবনা থাকে। তাই এত বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে না।