কেন বিশ্বের তাবড় ধনকুবেরদের তালিকায় নেই রতন টাটার নাম?

পৃথিবীর সবথেকে ধনী ব্যক্তি কারা আমরা কীভাবে জানতে পারি? ধনসম্পদের সিংহভাগ রয়েছে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে। এদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে অহরহ। কে এগোল কে পিছিয়ে গেল এই তথ্য নিয়ে ফোর্বস্‌ একটি তালিকা করে থাকে। সেই তালিকায় বর্তমানে সবার উপরে রয়েছেন এলন মাস্ক। একের পর এক কোম্পানি কিনে চলেছেন তিনি। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল সে সব খবর। তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ এখন ২৬৮ বিলিয়ন অর্থাৎ ২০ লক্ষ ৫৫ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। সন্দেহ নেই এই বিপুল পরিমাণ টাকা অনেকেরই নজর টানে। কিন্তু কেবলমাত্র টাকার ভিত্তিতে ব্যবসায়ী চেনার পন্থা কতদূর সঠিক? রতন টাটার নাম সমগ্র বিশ্ব জানে। কিন্তু সে নাম সবথেকে ধনীদের মধ্যে উঠে আসে না কেন?

টাটা গ্রুপ শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অথচ টাটার নাম নেই ফোর্বসের তালিকায়। এই নিয়ে কৌতূহল জাগাটাই স্বাভাবিক। এলন মাস্কের যাপন বা ক্ষমতা দেখানোর নজির আমরা সর্বত্র দেখছি। রতন টাটার জীবনের দিকে চোখ ফেরালে সে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে বাধ্য।

ভারতীয় ব্যবসায়ীদের নামোল্লেখ হলে রতন টাটার প্রসঙ্গ আসবেই। ব্যক্তি রতন টাটাকে পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ব্যবসার ক্ষেত্রটিতে তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টিও কারোর অজানা নয়। তবে এইটুকুই কি সব? রতন টাটা জনপ্রিয় তাঁর লোকহিতৈষী ভাবমূর্তির জন্য। মানুষের কল্যাণে বহু কাজই তিনি করে থাকেন। এ বিষয়ে তিনি অনন্য।

আরও পড়ুন-দু’কামরার ফ্ল্যাটে থাকেন রতন টাটার ভাই! লাইমলাইট থেকে বহু দূরে অবস্থান জিমির

মাস্কের মতো দেখনদারি তাঁর নেই। মানুষের জন্য চিন্তাভাবনা করেন বলেই একরকম মানুষ তাঁকে এতখানি ভালোবাসে। এই কারণেই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি রতন টাটা হতে পারেননি। একের পর এক দেশ ও জাতির পক্ষে কল্যাণকর প্রকল্প তাঁকে এই বিশ্ববন্দিত পরিচিতি এনে দিয়েছে। খুব কম ব্যবসায়ী প্রসঙ্গেই এ কথা বলা যায়। কারণ সাধারণ মানুষের থেকে ধনী ব্যবসায়ীদের দূরত্ব অনেকখানি। মানুষ সেই দূরত্ব থেকে বিলাস বহুল জীবনের স্বপ্ন দেখলেও মানুষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তেমন একাত্ম বোধ করে না। বরং একটা অসূয়া কাজ করে। টাটার সে সব বালাই নেই। নিজের যাপন দিয়ে রতন টাটা প্রমাণ করেছেন মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ফোর্বসের তালিকায় স্থান পাওয়াটা কোনও বিষয়ই নয়। বরং মানবদরদী হলে বড়লোক হওয়ার অহংকার কাটিয়ে ওঠা যায়।

৮২ বছর বয়েস হল তাঁর। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বরাবরই শিক্ষা নিয়েছেন। শিখিয়েছেন মানুষকেও। সেই শিক্ষা যা মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে, মানবতার পাঠ। এই কারণেই ভারতের মানুষের কাছে এটখানি পরিচিতি, জনপ্রিয়তা। তা নাহলে আম্বানি, আদানির সঙ্গে এক করে ফেলা হত তাঁকে কবেই! কিন্তু ভারতের মানুষ এখনও তাঁকে একটু অন্যরকম চোখে দেখে।

দীর্ঘ ষাট বছর ধরে যিনি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, টাটা সাম্রাজ্যের উপর এখনও যার প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ, আশাই করা যায় ভারতের সর্বাপেক্ষা ধনীদের তালিকায় তাঁর নাম থাকবে প্রথমের সারিতে। একেবারে প্রথমে যদি নাও হয় অন্তত প্রথম ১০ থেকে ২০র মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু জানলে আশ্চর্য হবেন আইআইএফএল ওয়েলথ-এর ২০২১ সালে প্রকাশিত তালিকা অনুসারে  রতন টাটার থেকেও ধনী এমন ভারতীয়র সংখ্যা ৪৩২ জন। এর প্রধান কারণ টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমে মানব কল্যাণে ব্যয় করা বিশাল অঙ্কের টাকা।

গত বছরের হিসেব অনুযায়ী টাটা গ্রুপের মোট সম্পত্তি ১০৩ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। অর্থাৎ ৭ লক্ষ ৮৯ হাজার ২২৭ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। ভারত তথা বিশ্বের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপ। কিন্তু টাটা সন্স-এর আয়ের ৬৬% সরাসরি যায় জনকল্যাণ মূলক কাজের খাতে। গত দেড়শো বছরে টাটা গ্রুপ জনগণের আশু প্রয়োজনের কথা সর্বক্ষণ মাথায় রেখেছে। এই জন্যই কোম্পানির লাভে রতন টাটার ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনও হেরফের ঘটে না। যা লাভ হয় তার বেশিরভাগটাই চ্যারিটিতে যায়।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই টাটা পরিবার এই জনকল্যাণ মুলক কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে। ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি নানাবিধ উন্নতিতে রতন টাটার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টাটা গ্রুপের ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। ধাতু, খনি, তথ্যপ্রযুক্তি, খুচরো ব্যবসা, গাড়ি, হাসপাতাল, রাসায়নিক, পরিবহণ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে তাদের ব্যবসা সর্বজন বিদিত। এর অধীনে রয়েছে ২৯টি তালিকাভুক্ত সংস্থা এবং তালিকার বাইরেও রয়েছে বহু। এতকিছু থেকেও টাটারা কখনও নিজের কোম্পানির সম্পূর্ণ সম্পত্তির মালিক হননি। জামশেদজী টাটা স্বয়ং এই নিয়ম বানিয়ে গিয়েছিলেন, টাটা সন্স যা আয় করবে তার সিংহভাগ যাবে টাটা ট্রাস্টে।

জনকল্যাণ মূলক কাজ টাটা পরিবার করে চলে চলেছে বহুদিন আগে থেকেই। রতন টাটা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি নাইই হতে পারেন, তাতে তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমে না। বস্তুত ফোর্বসের সম্পত্তির তালিকা যে কে প্রকৃত পক্ষে মহৎ মানুষ তা নির্ণয় করতে অসমর্থ, টাটার জীবনই তার প্রমাণ।

More Articles