কৌরবদের জব্দ করতেই পাশা খেলা! শকুনির সঙ্গে মর্মান্তিক অবিচারের যে কাহিনি অজানাই

Shakuni Mahabharata: রাজা সুবল শেষ নিঃশ্বাসে শকুনির পায়ে ছুরিকাঘাত করেন এবং তাঁকে ব্যথা মনে রাখতে এবং কুরু পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের কথা স্মরণ করতে বলেন।

দ্যুতসভা। শকুনির পাশার চালে যুধিষ্ঠির পথের ভিখারি। পাশাখেলায় সব খোয়া গেছে তাঁর। এমনকী ভাইদের বাজি রেখেও হেরেছেন। তখন সর্বহারা যুধিষ্ঠিরকে শকুনি বললেন, "কেন এবার দ্রৌপদী! তাঁকে পণ রেখে যদি যেতেন!’’ কী সাংঘাতিক চাল! যে চাল ডেকে এনেছে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। যে চালের পরিণতি কুরুবংশের ধ্বংস। কারণ খল শকুনি তো ধ্বংসই চাইতেন। তাঁর কপটতা ঘিরে বারবার আবর্তিত হয়েছে মহাভারতের আখ্যান। সূচনা থেকে এ গল্প সূচিত হোক।

মৃত্যুসজ্জায় শুয়ে রাজা সুবল তাঁর পুত্র সৌবালাকে এই গোপন কথা শুনিয়েছিলেন,

"আমার মৃত্যুর পর আমার হাতের আঙুলগুলি তুমি নেবে, আর অস্থি দিয়ে তোমার দ্যূতক্রীড়ার ঘুঁটি তৈরি করে নেবে। এর মধ্যে আমার সমস্ত ক্রোধ ও প্রতিহিংসার বীজ লুকিয়ে থাকবে। পাশার খেলায় দান তুমি যাই দাও, তোমার ইচ্ছা অনুসারেই জয়ের ফল তুমি পাবে। লোকে তাকে কপট উপায় বললেও তাতে কান দিও না, কারণ এই গূঢ় গুপ্ত কথা কেউ জানবে না। তুমি যত শীঘ্র সম্ভব তোমার ভাগিনেয় সুযোধনের (দুর্যোধনের অপর নাম) সঙ্গে যোগাযোগ করে কৌরবদের পক্ষে মিলিত হও! ভবিষ্যতে এই দ্যূতক্রীড়ার সাহায্যেই তুমি কুরু বংশের ধ্বংসের কারণ হবে। তোমার এই লক্ষ্য থেকে যেন কোনও দিন বিচ্যুত না হও মনে রাখবে।’’

তাঁর কপট বুদ্ধিতেই শেষ পর্যন্ত কুরুবংশ ধ্বংস হয়েছিল। শকুনিকে কেন্দ্র করে মহাভারতের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। ধূর্ত, কূট, কপট, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে শুধুমাত্র মহাভারতের উল্লেখযোগ্য চরিত্রই নন তিনি, সমকালের আলোয় যদি মহাকাব্যকে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে সর্বকালের ধ্বংসের প্রতীক এই খল শকুনি মামা।

মহাভারতের কথা অমৃতসমান, যেমন তার বিস্তার, তেমনই বিচিত্র তার চরিত্রসমূহ। মহাকাব্যটি ধারণ করে আছে বটে পৌরাণিক সময়, কিন্তু আজকের দিনেও তাকে মনে হয় আধুনিক। তাই সমকালের আলোকে শকুনির মতো কপটকে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। শকুনি ছিলেন একজন অত্যন্ত চতুর ব্যক্তিত্ব এবং একজন মায়াবাদী, তাঁর একটি আশ্চর্য প্রতিভা ছিল। তিনি যে কোনও পাশা খেলার সময় পাশাকে তাঁর মন অনুযায়ী চালনা করতে পারতেন। যুধিষ্ঠির শকুনির সঙ্গে পাশা খেলায় দুর্যোধনের কাছে সব কিছু হারিয়েছিলেন। এটাই হয়ে ওঠে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রধান কারণ। ফলত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সঙ্গে শকুনি মামার নাম জড়িয়ে আছে গভীরভাবে।

আরও পড়ুন- শূদ্রের আঙুল কেটে ‘সবক’ শেখানো! একলব্যের প্রতিভাকে যেভাবে খুন করেন দ্রোণ-অর্জুন

শকুনি (আক্ষরিক অর্থে- পাখি) হলেন মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র। প্রথমদিকে, তিনি ছিলেন গান্ধার রাজ্যের যুবরাজ। পরবর্তীতে, শকুনি, তাঁর পিতা রাজা সুবলের মৃত্যুতে গান্ধার রাজ্যের রাজা হন। তিনি হলেন হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রাজমহিষী গান্ধারীর বড় ভাই এবং কৌরবদের মামা। বুদ্ধিমান, ধূর্ত এবং বিপথগামী, কপট, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিত্রিত, শকুনি তাঁর ভাগ্নেদের সবসময় সমর্থন করতেন, বিশেষ করে জ্যেষ্ঠভাগ্নে দুর্যোধনকে। মামা শকুনির সঙ্গে মিলে দুর্যোধন তাঁর কাকাতো ভাই পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র রচনা করতেন। শকুনির পরামর্শেই দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানান এবং শকুনিই যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে কপট পাশা খেলা খেলেন, যা মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান ঘটনা। তিনি ভারী পাশা ব্যবহার করে পাশা খেলায় কারসাজি করতে পারদর্শী ছিলেন। ফলে, পাশা খেলায় পরাজিত হয়ে যুধিষ্ঠির সহ অন্য পাণ্ডবগণ কুরু রাজসভায় চরমভাবে অপমানিত, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা ও বস্ত্রহরণ, পাণ্ডবদের ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাস প্রভৃতি ঘটনা ঘটে।

গান্ধাররাজ সুবলের পুত্র ও গান্ধারীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শকুনি। তিনি মহাভারতের প্রধান খলনায়ক। সুবলের কোনও এক পাপের কারণে দেবতাদের অভিশাপে তাঁর বংশে শকুনির জন্ম হয়। শকুনির জন্ম কলির অংশে; তাই তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত ও কপট। গান্ধারীর বিবাহের পর থেকে শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের সংসারেই থাকতেন এবং ভাগিনেয় দুর্যোধনের সঙ্গে ওঁর বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর কারণেই মহাভারতের বিচিত্র ঘটনাগুলো আবর্তিত হয়েছে। তিনি অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী নন; তথাপি তাঁর কপট বুদ্ধিতেই সমগ্র কুরুবংশ ধ্বংস হয়েছিল।

পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে শকুনির কোনও বিদ্বেষ ছিল না, শকুনির প্রধান শত্রুতা ছিল ভীষ্ম পিতামহের বিরুদ্ধে । তখন কৌরব মাতা গান্ধারী সংসারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। একদিন পিতামহ ভীষ্মের কানে পৌঁছে গেল কেমন করে যে, গান্ধার রাজকন্যা বিবাহপূর্বে নাকি বিধবা ছিলেন। চারিদিকে গুপ্তচর ছুটল, জ্যোতিষীদের ডাক পড়ল সত্যাসত্য যাচাই করতে। জানা গেল সত্যিই নাকি গান্ধার রাজ সুবলকে সভার রাজজ্যোতিষী বলেছিলেন, গান্ধারীর প্রথম পতির আয়ু সীমিত, কিন্তু দ্বিতীয় পতির আয়ু হবে অনেক। তাই তড়িঘড়ি একটি ছাগলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিয়ে সেই দোষ স্খলন করেছিলেন তিনি এবং ছাগ পুঙ্গবটি যথারীতি পরে পরেই সদ্গতি প্রাপ্ত করে। তার কিছুদিন পরেই স্বয়ং ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারীর বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে গান্ধার রাজ্যে পৌঁছে যান। আর সুবল দেরি না করে সেই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে শুভকার্য সম্পন্ন করেন।

এই কথা পরে জানতে পেরে ভীষ্ম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। ভীষ্ম শকুনির পরিবারকে ভোজনের জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁদের ন্যূনতম খাবার দিয়ে তালাবদ্ধ বা বন্দি করেন। তখন রাজা সুবল সিদ্ধান্ত নেন, ভীষ্মের এই আচরণের জন্য ভীষ্ম এবং কুরু পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁর পরিবারের একজন সদস্যকে যে কোনও মূল্যে বাঁচতেই হবে। তাই শকুনি, সবচেয়ে ছোট এবং চতুর পুত্র, বেঁচে থাকার জন্য অন্য সকলের খাবার দিয়ে তাঁকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। রাজা সুবল শেষ নিঃশ্বাসে শকুনির পায়ে ছুরিকাঘাত করেন এবং তাঁকে ব্যথা মনে রাখতে এবং কুরু পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের কথা স্মরণ করতে বলেন।

আরও পড়ুন- ভাইদের ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে! ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র হয়েও কেন এত অবহেলিত যুযুৎসু

তাঁর কথায়, "সৌবালা, এখন থেকে তুমি খুঁড়িয়ে হাটবে আর প্রতিবার খোঁড়ানোর সময় মনে পড়ে যাবে কৌরবরা ও ভীষ্ম আমাদের প্রতি কী ভীষণ অন্যায় করেছে, যার ক্ষমা নেই। কৌরবদের বিনাশেই আমার আত্মা শান্তি পাবে, সে কথা বিস্মরণ হয়ো না।" কুরুবংশের ধ্বংসের পেছনের শকুনির চাল যে দায়ী, সেকথা মহাভারতে আখ্যায়িত।

খল শকুনি বস্তুত ধ্বংস চাইতেন, তাই তিনি ভাগিনেয় দুর্যোধনকে নানা কুবিদ্ধি দিতেন। তাঁর কপটতার তালিকা বারবার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে মহাকাব্যের আখ্যান। কালকূট বিষ প্রয়োগ করে ভীমকে হত্যার চেষ্টা, জতুগৃহে কুন্তী সহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারা, ইত্যাদি ষড়যন্ত্রে শকুনির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। দ্যূতক্রীড়ায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্থ। যুধিষ্ঠির দ্যূতপ্রিয় হলেও, ক্রীড়া পটু ছিলেন না। তাই তাঁকে পণ-দ্যূতে আমন্ত্রণ করে সর্বস্বান্ত করার পরামর্শটা তিনিই দুর্যোধনকে দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির খেলতে এলে কৌরবদের পক্ষ হয়ে দুইবার তিনিই খেলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শকুনির পুত্র উলুক দুর্যোধনের দূত হিসেবে দুর্যোধনের শিখিয়ে দেওয়া অভদ্র অশ্লীল কথাগুলো পাণ্ডব পক্ষকে গিয়ে শোনালেন। কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব সেই শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে শপথ করলেন যে, শকুনির সামনে প্রথমে উলুককে হত্যা করে, তারপর তিনি শকুনিকে বধ করবেন। যুদ্ধের শেষ দিনে সহদেবের হাতেই শকুনি-পুত্র উলুক ও শকুনির মৃত্যু হয়।

মহাভারতের যুদ্ধের ১৮ তম দিনে সহদেব শকুনিকে বধ করেন। দ্রৌপদীর প্রতি সমস্ত দুর্ব্যবহারের নেপথ্যে মূলত যে শকুনিই ছিল, সেকথা অনুভব করেন সহদেব। সেই কারণে তিনি শকুনিকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেন। অনেক দেশি-বিদেশি পণ্ডিত মনে করেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আসলে কৌরব ও পাঞ্চালদের যুদ্ধ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বলা হলেও এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের নেপথ্যে কতই না কপটতার কাহিনি ডালপালা মেলেছে!

More Articles