মমতার ভুল না কি... সিঙ্গুর নিয়ে যা বলছেন সেই মাস্টারমশাই
Singur Rabindranath Bhattacharya : সিঙ্গুর কাণ্ডে রাজ্যসরকার ধাক্কা খেতেই বামেদের প্রতিই আক্রমণের তির ঘুরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।
ছিলেন তৃণমূলেই। জীবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সরণ-গমন। মানুষ সততই গমনশীল। মানুষ, বিশেষ করে রাজনৈতিক মানুষ একটু বেশিই পর্যটক। দল, অবস্থান হামেশাই বদলে বদলে যায় তাই। সেভাবেই দল বদলেছিলেন তৃণমূলের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গমন। ৩৪ বছরের বাম শাসনকে উপড়ে দিয়েছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন। টাটাকে ন্যানো কারখানা গড়তে দেওয়া হয়নি। শিল্প রাজ্যে না এসে গুজরাতে চলে গিয়েছিল। তারপর এ রাজ্যে শিল্প বললেই কেমন 'খিল্লি' করতে থাকেন আম জনতা, হতাশ জনগণ। সিঙ্গুর ছিল তৃণমূলের মোক্ষম তাস, তাস কখন কাঁটা হয়ে সর্বাঙ্গে বিঁধবে তৃণমূল বোঝেনি। ১৫ বছর পর সিঙ্গুর নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে সরকার। কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে টাটাকে। জমি আন্দোলনের সেই মুখ, মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ, যিনি তৃণমূল ছেড়ে চলে গেলেন বিজেপিতে, কী বলছেন তিনি এই ক্ষতিপূরণ নিয়ে?
বিরোধী বিপাকে পড়লে শাসকের খুশি হওয়াই দস্তুর। রবীন্দ্রনাথ এখন যে দলে রয়েছেন, সেই দল সারা দেশের শাসক। তৃণমূল রাজ্যের শাসক, রাজ্যের যুযুধান প্রতিপক্ষও। সিপিএমের অবস্থা রাজ্যে কী তা নতুন করে কহতব্য নয়। ব্রিগেডে ভিড় যদি বা মেলে, ভোট মেলে না। সকলেই জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনের ফলেই টাটাকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়। বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দিয়ে সিঙ্গুর আন্দোলন নিয়ে এমনটাই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বিজেপিতে গিয়ে সিঙ্গুর থেকে টাটা গোষ্ঠীর বিদায় নিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনকেই দায়ী করেছিলেন। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ উল্টোবয়ান। চিত্রনাট্যে আবার হাজির হয়েছে বামফ্রন্ট! সিঙ্গুর কাণ্ডে রাজ্যসরকার ধাক্কা খেতেই বামেদের প্রতিই আক্রমণের তির ঘুরিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন- সিঙ্গুরের ভুলের খেসারত ১৩৫৫ কোটি! রতন টাটার ছোট্ট চালেই কিস্তিমাত?
রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, টাটা সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাক তা তিনি কখনই চাননি। টাটা গোষ্ঠী রাজ্য থেকে চলে যাওয়ায় জন্য সিঙ্গুর-সহ রাজ্যের ক্ষতি যে হয়েছে তা স্বীকার করছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তার জন্য বর্তমান সরকার কিছুতেই দায়ী নয়। যদি কেউ দায়ী হয়ে থাকে তাহলে তা তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। ন্যানো কারখানা গুটিয়ে টাটারা চলে যাওয়ার জন্য জমি আন্দোলন কিছুটা দায়ী বলেও মন্তব্য তাঁর।
সিঙ্গুরে টাটার কারখানা না হওয়ায় টাটা গোষ্ঠীকে সুদসহ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড বা WBIDC-কে। টাটার পক্ষে রায় দিয়েছে মধ্যস্থতাকারী ট্রাইবুনাল। ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা মাথা খারাপ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! সুদ মিলিয়ে প্রায় ১৩৫৫ কোটি টাকা সরকারকে দিতে হবে টাটাকে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, টাটাদের দিক থেকে ভাবতে গেলে এই ক্ষতিপূরণ যুক্তিসঙ্গত কারণ একটি কারখানা নির্মাণে জন্য অনেকটা কাজ হয়ে যাওয়ার পরে তা বন্ধ করে দেওয়া মানে প্রভূত ক্ষতি। এবার এই এত টাকা তৃণমূল দেবে কিনা তা সরকারের ব্যাপার। তিনি তো আর সরকারে নেই, তাই সরকার কী ভাবছে, সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে যাবে কিনা তাও তাঁর জানা নেই।
আরও পড়ুন- মমতা-মন্তব্যে ফের বিতর্কিত সিঙ্গুর! এক নজরে ফিরে দেখা সেই ইতিহাস
সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই এই এতবছর পর বলছেন, “আমরা সিঙ্গুর আন্দোলনকারী হিসাবে তখন চেয়েছিলাম ৬০০ একর ছবিতে টাটাদের কারখানা হোক। বাকি জমি কৃষকদের ফেরত দেওয়া হোক।” ২০২১ সালের নির্বাচনের আগেই বিজেপিতে চলে যান রবীন্দ্রনাথ। বিরোধী হয়ে সিঙ্গুর থেকে টাটা বিদায়ের জন্য মমতার আন্দোলনকেই দায়ী করেছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বরাবরই বলে এসেছেন টাটাবিদায়ের নেপথ্যে তিনি নেই, রয়েছে সিপিএমই। সিপিএম জোর করে জমি নিতে গিয়েই সমস্ত বিপত্তির সূত্রপাত ঘটায়। বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেই কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ। তাহলে কি আবার বিজেপি থেকে পুরনো বাড়িতে ফিরবেন রবীন্দ্রনাথ?
মাস্টারমশাইকে মূলধারার রাজনীতিতে আর দেখাই যায় না। শরীরের কারণেই রোজের রাজনীতি থেকে তিনি দূরে। বিজেপি প্রার্থী হয়ে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লড়েছিলেন 'শিষ্য' বেচারাম মান্নার বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথ ২৫,৯৩৩ ভোটে হেরে যান। সিঙ্গুরে বিজেপির হয়ে কোনও পদ্মই ফোটাতে পারেননি তিনি। বিজেপিও দলত্যাগী মাস্টারমশাইকে একেবারে জড়িয়ে ধরে দলে টেনে নেয় তাও না। বেচারাম মান্নার কাছে হারের পরই সিঙ্গুরের প্রাক্তন বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সক্রিয় রাজনীতি থেকে ক্রমেই সরে যেতে থাকেন। বিজেপিও যে নিজে থেকে খুব একটা যোগাযোগ রাখে না তা পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই অবস্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে কথা বলা অস্বাভাবিক নয়। দলে নাই বা ফিরলেন, শাসকের বিরাগভাজন হয়েই বা কে থাকতে চায় আর!