পঞ্চায়েত নির্বাচনে 'নিরঙ্কুশ' জয় মানেই কি বাংলায় সব কিছু ঠিক?

Panchayet Poll 2023 and TMC: ছোট ছোট লক্ষ্য। বাংলার 'শান্তিপ্রিয়' মানুষকে খুশি রাখো। নতুন নতুন স্লোগানে ভুলিয়ে রাখো।

প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, বাংলায় তৃণমূলকে সরিয়ে দিয়ে শাসন ক্ষমতা হাতে নেওয়ার মতো রাজনৈতিক বিকল্প এখনও নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস এখনও এই রাজ্যের প্রধান এবং শক্তিশালী দল। হ্যাঁ, সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসা, মৃত্যু, কারচুপি, ছাপ্পা, ব্যালট পেপার খেয়ে নেওয়া বা জলে ফেলে দেওয়া, পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা— সব কিছু নিয়েও বলতে হবে যে তৃণমূলের হাতেই এখনও রাজ্যের রাশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তাঁর ধারে কাছে আর কেউ নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক বিস্তার বিরোধী দলগুলির থেকে অনেক বেশি। প্রশাসন ও পুলিশের উপর তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাব অটুট। নির্বাচন লড়ার রসদ ও রাজ্যের মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণেও তৃণমূল কংগ্রেস অন্য দলগুলির থেকে অনেক এগিয়ে। 

কিন্তু এর মানে এই নয় যে বাংলায় সব কিছু ঠিক চলছে। একটি নির্বাচনে কোনও একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতে যাওয়া মানেই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সব কিছু নিয়ে খুশি তা নাও হতে পারে। আসলে রাজ্যের মানুষ আপোষ করে চলছে।

আমরা যতই 'বাঙালির রক্তে হিংসার ইতিহাস রয়েছে' (রাজাদের আমলে, বাংলা উপন্যাসে, স্বাধীনতার যুদ্ধে, বাম ও অতিবাম আন্দোলনে, ৭০ দশকের কংগ্রেস শাসনে, মাওবাদী আন্দোলনে হিংসার কথা) বলে পঞ্চায়েতের হিংসার জন্য সাফাই গাই, আদতে বাঙালি শান্তিপ্রিয় জাতি। তাই বামেরা সাড়ে তিন দশক আর তৃণমূল ইতিমধ্যেই এক দশকের বেশি ক্ষমতায় থেকে যায়। স্থিতাবস্থা বজায় রাখতেই আধুনিক বাঙালি পছন্দ করে। 

রাজ্য়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি রসাতলে গেলেও একটি দল তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে। একদল 'বুদ্ধিজীবী কোথায়? বুদ্ধিজীবী কোথায়?' বলে হাহাকার করতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তেড়ে গাল পাড়তে পারে, কিন্তু প্রতিরোধ করতে ভয় পায়। ওই কাজটি অন্যের উপর ছেড়ে দেয়।

প্রতিরোধ হয় সামান্য কয়েকটি জায়গায়। খানিকটা ভয়ও হয় যখন বলে দেওয়া হয়, হিংসা হয়েছে মূলত ভাঙড়, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুরের কয়েকটি জায়গায়। এর যে কী ভয়ঙ্কর বার্তা সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে যাচ্ছে তা রাজনীতিকরা খেয়ালও করছেন না! আসলে যাদের কাছে ভরসা করার মতো কোনও রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রয়েছে, তারাই প্রতিরোধ করে। বাকিরা 'শান্তি' বজায় রাখে।

আরও পড়ুন- সন্ত্রাস ছাড়া জয় নেই! শেষ ২০ বছরে বাংলার পঞ্চায়েত মানেই লাশের রাজনীতি

এর কারণ,  লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প নাকি পঞ্চায়েতের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় এই রাজ্যে। আর এটাই হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের দুর্দশার সবচেয়ে বড় কারণ। রাজ্যের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোন অবস্থায় থাকলে, মহিলাদের হাতে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দিয়ে তাদেরকে খুশি রাখা যায়! এতেই নাকি মহিলাদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে! এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মহিলারা এই দানের টাকায় খুশি হচ্ছেন। কিন্তু অবাক হতে হয় এই ভেবে যে অর্থনীতির অবস্থা এমনই যে ৫০০ টাকাই 'অনেক' টাকা মহিলাদের কাছে। হয়ত কারও কাছে এটি উপরি।

গোটা রাজ্যটাই এরকম শ্রী-সাথী-ভাণ্ডার প্রকল্পে চলছে। পঞ্চায়েতের এই জয়কে প্রকল্পগুলির জয় বলে ব্যাখ্যা করা চলছে। অথচ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আসল উদ্দেশ্য কী? পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে সাধারণ মানুষের হাতে নিজেদের উন্নয়নের পরিকল্পনা ও রূপায়ণের ক্ষমতা দেওয়া। সেই উদ্দেশ্য যে ব্যাহত হচ্ছে এবং সেটি যে শাসক দলের এজেন্ডাতেই ছিল না — এটা নিয়ে সাধারণ মানুষ ভাবিত নন! 

জেলা পরিষদের নির্বাচিত সভাধিপতি নন, জেলাশাসকই এখন শেষ কথা প্রতিটি জেলায় এবং তিনি নির্দেশ পান সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর থেকে। মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করে দেন কোথায় কী কাজ হবে না হবে, কত টাকা আছে, কত টাকা খরচ করা যাবে  ইত্যাদি।

এ গেল একটি দিক। অন্য দিকে এই শ্রী-সাথী-ভাণ্ডার প্রকল্প আসলে রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং শাসক দলের দূরদৃষ্টির অভাবকেই প্রকট করছে। একটি জনকল্যাণমুখী সরকার তার নাগরিকদের দুধে ভাতে রাখবে সেটাই স্বাভাবিক। আর নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা হবে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য। এটাও স্বাভাবিক। যখন স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় একজন নাগরিক এই মৌলিক চাহিদাগুলি মেটাতে পারবেন না, তখনই সরকার তাঁকে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সাহায্য করবে। যদি নাগরিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকে, তবে রাষ্ট্রের সম্পদগুলি সমানভাবে যাতে সব নাগরিকদের মধ্যে বা পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যায়, সেটা সরকারের কাজ হবে। কিন্তু একটি গোটা রাজ্য যদি এই সরকারি প্রকল্পগুলির উপরেই এত ভরসা করে যে তার জন্যই একটি দলকে জিতিয়ে যাবে ভোটের পর ভোট, তাহলে বুঝতে হবে গোটা পরিকল্পনাতে এবং রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেই আসলে গলদ রয়েছে। 

কন্যাশ্রী প্রকল্পে বৃত্তি বা সবুজ সাথীতে সাইকেল দিয়ে যদি ছেলে মেয়েদের পড়াশোনায় উৎসাহিত করি, কিন্তু স্কুলগুলির উন্নয়ন না করি, ঘুষের টাকায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করি তাহলে যা হওয়ার তাই হয়।

যদি চাকরি দিতে না পেরে কর্মশ্রী প্রকল্পে টাকা দিই, কিন্তু ব্যবসা করার পরিবেশ না তৈরি করতে পারি, তাহলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

যদি গ্রামের লোকেদের ১০০ দিনের কাজ বা বাড়ি তৈরির টাকা দিতে চাই, কিন্তু সেই টাকা নিয়ে দুর্নীতি করি, তাহলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

যদি দুর্গা পুজোর নামে সরকারি তহবিল থেকে হাজার হাজার টাকা পাড়ার ক্লাবগুলোকে বিলি করতে হয়, তাহলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

একজন গ্রামের ছেলে বা মেয়ে পড়াশোনা করে এ রাজ্যে কী করবে তা নিয়ে কোনও পরিকল্পনা রয়েছে কি রাজ্য সরকারের কাছে? জাতীয় গড়ের থেকে এই রাজ্যের বেকারত্বের গড় কম বলেই শুধু গর্ব করলে চলবে? পণ্য উৎপাদনের জন্যই হোক বা পরিষেবা প্রদানের জন্যই হোক — শিল্প কোথায়? সরকারি বা বেসরকারি চাকরি কোথায়? চাষবাসের উন্নতির পরিকল্পনা কোথায়?

একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে হিংসার ভাব পুষে রেখে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ না দেওয়া ও বলে দেওয়া যে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি খুঁজে নাও বা ডিএ দিতে গেলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে টাকা কম পড়ে যাবে — এটি কোন ভবিষ্যতের কথা বলে? কোন পরিকল্পনার কথা বলে? কেন রাজ্যের ছেলে মেয়েরা অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে কাজের খোঁজে?

আরও পড়ুন- গ্রাম দখলের টোটকা এখনও শুভেন্দুর অধরাই! নন্দীগ্রাম পঞ্চায়েতে বিজেপি কেবলই বুদবুদ?

পঞ্চায়েত নির্বাচনের নিরঙ্কুশ জয় এই প্রশ্নগুলোকে মুছে দেবে!

২০২১ সালের নির্বাচনে 'দিদিকে বলো' আলেখ্য তৈরি হলো। অর্থাৎ সমস্যা হলে অভিযোগ জানাও। সেটায় কাজ না হওয়ায় বলতে হলো 'বাংলা নিজের মেয়েকে চায়' অর্থাৎ 'বহিরাগত বিজেপি'কে রাজ্যে ক্ষমতায় নিয়ে এসো না। এবারের পঞ্চায়েতের আগে দুর্নীতির কালো দাগগুলি মুছতে এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে ধরতে 'তৃণমূলের নবজোয়ার' এল। অর্থাৎ যা পরিকল্পনা তা নির্বাচনকে ঘিরেই। ছোট ছোট লক্ষ্য। বাংলার 'শান্তিপ্রিয়' মানুষকে খুশি রাখো। নতুন নতুন স্লোগানে ভুলিয়ে রাখো।

হিংসাত্মক পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে একই বুলি ও সেই টাকা দিয়ে ভুলিয়ে রাখার গল্প। হিংসা হয়েছে ৭১ হাজারের মধ্যে মাত্র '৬০টি বুথে এবং দু'টি জেলায় ও ভাঙড়ে'। সঙ্গে মৃতদের ক্ষতিপূরণ ও চাকরি দিয়ে সেই শাসক দলের আশ্রয়ে নিয়ে আসা।

বিরোধী দলগুলি শত যোজন দূরে দাঁড়িয়ে। যখন শাসক দলের মন্ত্রী, বিধায়ক এবং নেতারা জেলের ভিতরে, ঘরে ঘরে শিক্ষা-দুর্নীতির আক্রান্তরা, তখনও তাদের মনে ভরসা জোগাতে পারছে না বিরোধীরা। সাধারণ মানুষেরা বিশ্বাস করতে পারছে না যে, তারাও বিকল্প শাসন ব্যবস্থা দিতে পারে।

দেনা-পাওনার রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস এখনও এগিয়ে। তাই তৃণমূল কংগ্রেসকে খুশি রাখতে দলের নেতা-কর্মী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় বাঙালি এই নির্বাচনে লড়ে গেলেন। জিতিয়ে রাখলেন (সে যে ভাবেই হোক) তাদের জনপ্রিয় দলটিকে। এটিই হলো পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলের নির্যাস।

বাংলার ভবিষ্যৎ রসাতলে যাক।

More Articles