পাখির চোখ শুধু শুভেন্দু, দুই চালে কিস্তিমাত করতে জাল ছড়াচ্ছে শাসক দল
রাজনৈতিক আবহে সমস্ত ইস্যু ছেড়ে শুভেন্দুতেই 'ফোকাস' করেছে তৃণমূল?
এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়! বঙ্গ রাজনীতির অলিন্দে এই দেখাদেখির রাজনৈতিক লড়াইয়ের আবহে ক্রমশ এগিয়ে আসছে ব্যক্তিগত পরিসর। সিপিএম, কংগ্রেস বনাম তৃণমূল এবং বিজেপি বনাম তৃণমূলের রণাঙ্গনে এখন স্পষ্ট হচ্ছে দুই দলের দুই ব্যক্তির নাম। যেখানে দলীয় নীতি-আদর্শের লড়াইকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়ে, সম্মুখসমরে শুভেন্দু অধিকারী এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিদ্বন্দ্বী দু'জনেই একদা ছিলেন এক পক্ষের। আজ সময় বদলেছে। হলদি নদী দিয়ে গড়িয়েছে জল। গঙ্গায় ওঠানামা করেছে স্রোত। কিন্তু পরিস্থিতি আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গের রাজনীতিতে শাসক-বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসে যোগ হয়েছে এই ব্যক্তিগত বিভেদ। যা অন্যের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ এবং ব্যক্তিগত শত্রুতার ফল বলেও মত কারও কারও।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই তৃণমূলের নবতম মুখ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-রক্ষায় কোমর বেঁধে নেমেছে তৃণমূল। 'যুবরাজে'র পক্ষ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে শুভেন্দু-বধে সচেষ্ট হয়েছেন তৃণমূল নেতাদের একটা বড় অংশ। অর্থাৎ জনমানসে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, শুভেন্দুর অভিষেক বিরোধিতা আসলে মেকি, সম্পূর্ণতই মিথ্যা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস মাত্র! এখানেই ফের শুভেন্দু টার্গেট করেছেন অভিষেককে। ঘুরিয়ে পাল্টা রাজনৈতিক শরনিক্ষেপের অভিষেক-লক্ষ্য হয়েছেন শুভেন্দু। বঙ্গে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা হয়েছেন গৌণ। বঙ্গ-বিজেপির সমস্ত নেতা ছেড়ে অভিষেক-শুভেন্দুর লড়াই জমজমাট হয়েছে বঙ্গের রাজনৈতিক নাট্যমঞ্চে।
আর এখানেই রাজনৈতিকভাবে শুভেন্দু-কাঁটা খর্ব করতে চাইছে তৃণমূল। বিজেপি নেতার হুঙ্কার এবং তীব্র বিরোধিতাকে হাতিয়ার করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি তৈরির আগেই অনবরত বাক্যবাণে 'কাঁথির সম্রাট' শুভেন্দু-শেষের কৌশল নিচ্ছে তৃণমূল। কেন?
আরও পড়ুন: অভিযোগের তির এবার কার দিকে? ব্যক্তিগত সততার প্রমাণ দিতে কেন মরিয়া মমতা?
রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, গত শুক্রবার সল্টলেকের নিজাম প্যালেস থেকে বেরিয়ে ইডি-র জিজ্ঞাসাবাদের পর তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, 'দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পলাতক বিনয় মিশ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে শুভেন্দু অধিকারীর। আট মাস আগে ফোনে কথা হয় দু'জনের। বিনয়কে কেস মিটিয়ে নেওয়ার কথাও জানান শুভেন্দু অধিকারী।' এমনকি এই কথোপকথনের প্রমাণ হিসেবে আদালতে অডিও ক্লিপ জমা দেবেন বলেও জানান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মালহানি মামলার চ্যালেঞ্জও ছোড়েন রাজ্যের বিরোধী দলনেতার উদ্দ্যেশ্যে। এরপরেই শোরগোল শুরু হয়। বরাবর বঙ্গে দুর্নীতির বিরোধিতাকে মূল রাজনৈতিক হাতিয়ার করা বিজেপি অস্বস্তিতে পড়ে ফের। অবশেষে পাল্টা সরব হন শুভেন্দু। তিনি বলেন, "ওই অডিও ক্লিপ সুদীপ্ত সেনের চিঠির মতো সাজানো নয় প্রমাণ হবে, যদি ওটার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর প্রকাশ করতে পারেন।" এখানেই না থেমে উত্তরপাড়ার পথসভা থেকে বিস্ফোরক অভিযোগ করেন শুভেন্দু। হাতে একটি চেকের প্রতিলিপি নিয়ে অভিষেকের স্ত্রী রুজিরার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তিনি। থাইল্যান্ডে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। বিপুল টাকা লেনদেন, সোনা কেনা-সহ একাধিক অভিযোগে সরব হন শুভেন্দু। অর্থাৎ, অভিষেকের সরব হওয়ার পরেই শুভেন্দু ফের টার্গেট করেন অভিষেককে। তাঁর স্ত্রী-কে। এদিকে ওই অডিও ক্লিপ নিয়ে কটাক্ষ করতে শুরু করেন তৃণমূল নেতারা। শুভেন্দু মানহানি মামলা কেন করছেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কুণাল ঘোষ। কটাক্ষের সুরে তৃণমূল মুখপাত্র বলেন, সময় চলে যাচ্ছে, শুভেন্দু মানহানির মামলা কবে করবেন? এখানেই উঠেছে প্রশ্ন।
তাহলে কি রাজনৈতিক আবহে সমস্ত ইস্যু ছেড়ে শুভেন্দুতেই 'ফোকাস' করেছে তৃণমূল। একদা মমতার বিশ্বস্ত সৈনিক। আবার নন্দীগ্রাম আসনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেই হারিয়ে দেওয়ার কারিগরকে নাজেহাল করার চেষ্টার মধ্যেই কি রাজনৈতিক ভবিষ্যতের লাভ দেখতে পারছে তৃণমূল? অনেকেই বলছেন, বিষয়টি এত সহজ নয়। বিনয় মিশ্র ইস্যুর মধ্যেই জেলবন্দি বিকাশ মিশ্রের সঙ্গে অভিষেকের কথা হয় বলে অভিযোগ করেছেন শুভেন্দু। এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতি এবং পার্থ সম্পর্কে কড়া অবস্থানের কারিগর অভিষেকের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। যেখানে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখার চেষ্টায় ব্রতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব চাইবেন না অভিষেকের নাম বারবার এভাবে প্রকাশিত হোক। যা শুভেন্দু অধিকারীর মাধ্যমেই তীব্রতা পাচ্ছে। যাঁর প্রধান লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অভিষেক।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে দলের সামগ্রিক অস্বস্তি এবং যুবনেতার ভাবমূর্তির বিড়ম্বনা ঠেকাতে মূল কেন্দ্রেই হাত বাড়িয়েছে তৃণমূল। দলে প্রায় কোণঠাসা দিলীপ ঘোষ ছাড়িয়ে ওই কেন্দ্রবিন্দু এখন শুভেন্দু। যাঁর পক্ষে তৃণমূলের অন্দরের বহু খবরই জানা। তৃণমূলের রাজনৈতিক ভিত্তিতে যাঁর ভূমিকা ছিল অন্যতম। সেই শুভেন্দুর বারবার সরব হওয়া, মুখ খোলা, অভিযোগের কেন্দ্রে অভিষেককে রেখে আক্রমণ; তৃণমূলকে মাঝে মাঝেই অস্বস্তিতে ফেলছে। যা, জনমানসে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল- এই বার্তা দিচ্ছে বলেও এক অংশের তৃণমূল নেতার মত। সেখানে দাঁড়িয়ে কার্যত বঙ্গ বিজেপির মুখকেই যদি অস্বস্তিতে ফেলা যায়, তাহলে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে তৃণমূল। বিজেপির বিড়ম্বনা বাড়বে। ঠিক এই অবস্থাতেই অভিযুক্ত বিনয় মিশ্র এবং শুভেন্দু অধিকারীর যোগাযোগের তথ্য সামনে আনা হয়েছে। যেখানে শুভেন্দু যে জড়িত নন, একথাও স্পষ্টভাবে বলতে পারছে না বিজেপি নেতৃত্ব। উপরন্তু তৃণমূলের তরফে মানহানি মামলার কটাক্ষ ছোড়া হচ্ছে। যে ভাবমূর্তিগত অশান্তি থেকে বাঁচতেই পাল্টা সরব হয়েছেন শুভেন্দু। বিনয়ের পাল্টা বিকাশ, রুজিরা প্রসঙ্গ ফের প্রকাশ করেছেন তিনি। অর্থাৎ এক ঢিলে ভাবমূর্তি এবং বঙ্গ বিজেপিতে অক্সিজেন জুগিয়ে আক্রমণের কেন্দ্র করে নিয়েছেন অভিষেককেই। অনেকেই বলছেন, মমতা-তুলনায় তাঁর উত্তরসূরির বিরুদ্ধে গিয়ে ভবিষ্যতের তৃণমূলের ভিত্তি নড়বড়ে করে দিতে চাইছেন শুভেন্দু। যা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক লাভ দিতে পারে তাঁকেও। এখানেই 'খেলা' ধরেছে তৃণমূল। দুর্নীতি-অস্ত্রে শান দিয়েই রাজনৈতিক শত্রু শুভেন্দু-নিধনে রাজনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করছে সবুজ সেনারা। যার দরুণ, সামগ্রিক লড়াই ক্রমশ গুটিয়ে গিয়ে আবর্তিত হচ্ছে শুভেন্দু আর অভিষেকে। যা বঙ্গের বিরোধী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ফের উঠে আসার চেষ্টায় থাকা বামফ্রন্টের সুবিধা বাড়াবে নাকি এই কৌশলের অলিন্দে আসলে বিরোধীদের নিষ্ক্রিয় করার কৌশলই আবর্তিত হবে, তা বলবে সময়।