ট্রেন মানেই দেরি, কেন লেট লতিফের শিরোপা পেল ভারতীয় রেল

কখনও সাত-আট ঘণ্টারও বেশি দেরিতে ট্রেন ঢোকে স্টেশনে। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে লাইন ফাঁকা থাকে না। তখন ক্রমাগত বেড়ে যেতে থাকে দেরি। এককথায়, 'পথে হল দেরি' ভারতীয় রেলের অন্যতম থিম।

১ অগাস্ট ২০২২, প্রায় সমস্ত প্যাসেঞ্জার ট্রেন সময়ে চালিয়েছে ভারতীয় রেল। একেই বিরাট সাফল্য বলে মনে করছেন রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল। তাঁর ভাষায়, এই জয় 'ঐতিহাসিক'। সহজেই বোঝা যায়, ভারতীয় রেলের অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দীর্ঘদিন এই ঝঞ্ঝাটে ভুগছেন সাধারণ মানুষ। কানেকটিং ট্রেন মিস হওয়া থেকে জরুরি ফ্লাইট মিস হয় আকছার। সময় বেঁধে দেওয়া থাকলেও ভারতীয় রেল তা মানতে নারাজ। কখনও সাত-আট ঘণ্টারও বেশি দেরিতে ট্রেন ঢোকে স্টেশনে। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে লাইন ফাঁকা থাকে না। তখন ক্রমাগত বেড়ে যেতে থাকে দেরি। এককথায়, 'পথে হল দেরি' ভারতীয় রেলের অন্যতম থিম। তাই এতদিনে একটিবার সঠিক সময়ে ট্রেন চালাতে পেরে রেলমন্ত্রী পুলকিত। অথচ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এক যাত্রীকে তিরিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছে ভারতীয় রেল। আজমের-জম্মু এক্সপ্রেস চার ঘণ্টা দেরি করে ঢোকায় যাত্রীটির জরুরি ফ্লাইট মিস হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া রেলমন্ত্রীর 'ঐতিহাসিক জয়'-এর দু'টি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি আমাদের মাথায় রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, পনেরো মিনিটের দেরিকে ভারতীয় রেল দেরি হিসেবে গণ্য করে না। দ্বিতীয়ত, করোনা-উত্তর পর্বে ট্রেন চলছে ক'টি? করোনার আগে যেখানে ১৩০০০ প্যাসেঞ্জার ট্রেন এবং ৮০০০ মালগাড়ি চলত, সেখানে করোনার পরে এ-পর্যন্ত চালু হয়েছে ২৩০টি প্যাসেঞ্জার ট্রেন, ৩০০০ ভর্তি মালগাড়ি, ২২০০টি খালি মালগাড়ি। এই পরিস্থিতিতে 'ঐতিহাসিক সাফল্য'-র সন্তোষ রেলওয়ের ভবিষ্যৎকে ঠিক কোনদিকে পরিচালিত করবে, তা নিয়ে চিন্তা হয় বইকি!

সিএজি (কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) রিপোর্ট বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ভারতীয় রেলওয়েতে লগ্নি হয়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরেও সঠিক সময়ে ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছনোর পরিসংখ্যান মোটেও বাড়েনি। অডিটে দেখা গিয়েছে, এক শতাংশও নয়, মাত্র ০.১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে সময়ানুবর্তিতা। বিশেষত ২০১৭-'১৮-র মরশুমটিতে ভারতীয় রেল সময়ানুবর্তিতার নিরিখে চূড়ান্ত অসফল। তিরিশ শতাংশরও বেশি ট্রেন দেরি করে গন্তব্যে পৌঁছেছে। তাহলে টাকাটা খরচ হলো কোথায়? স্টেশনগুলি আরও ঝকঝকে করে তুলতে, স্টেশনের সম্মুখভাগকে আরও সুন্দর করে তুলতে টাকা খরচ করা হয়েছে। অথচ স্টেশনে ঢোকা এবং বেরনোর পথ সরু। স্টেশনে এক সঙ্গে বেশি ট্রেন দাঁড়ানোর জায়গা নেই। চব্বিশটির বেশি কামরাওলা রেলগাড়ি দাঁড়াতে পারে, বেশিরভাগ স্টেশনেই এমন প্ল‍্যাটফর্ম নেই। ছোট প্ল‍্যাটফর্মে যাত্রীদের ওঠানামায় সময়ও লাগে অনেকটা বেশি। পর্যাপ্ত ওয়াশিংপিট বা স্টেবলিং লাইন নেই। ওয়াশিংপিট লাইনে গাড়ি ধোয়া হয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়, এবং কিছু খোলা ডাম্পিং পিট থাকে, যা আবর্জনা ফেলার কাজে লাগে। আগামী যাত্রার জন্য গাড়িকে প্রস্তুত করা হয় এই লাইনেই। স্টেবলিং লাইন হলো গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছলে ওয়াশিং লাইনে যাওয়ার আগে যে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সিএজির সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৭৯টি পিট লাইন এবং ৬৩টি স্টেবলিং লাইনের মধ্যে কেবল ৩৫টি পিট লাইন ও ২০টি স্টেবলিং লাইনের ২৪টি কামরা বা তার অধিক কামরাবিশিষ্ট রেলগাড়ি পরিষ্কারের ব্যবস্থা হয়েছে। এটিও দেরির অন্যতম কারণ।

আরও পড়ুন: কিছুতেই ট্রেন থেকে চুরি করা যাবে না এই জিনিসটি, ভারতীয় রেলের এই অভিনব প্রযুক্তি চমকে দেবে

কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেও পরিকাঠামোর উন্নতি হচ্ছে না কেন? এ কি ইচ্ছাকৃত নষ্টামি? যাত্রীরা সরকারি পরিষেবায় যত হয়রান হবেন, তত পরিষেবার বেসরকারিকরণের পক্ষে মতামত তৈরির সুবিধা। পরিকাঠামো ট্রেনের সময়ানুবর্তিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ট্রেন ট্রাফিক, নতুন লাইন, ডাবলিং, ট্র্যাক গেজ ইত্যাদির দ্বারা পরিকাঠামো উন্নত করে দেরি কমানো সম্ভব সহজেই। অথচ হাতে-কলমে তা হচ্ছে না। স্টেশনে স্থান সংকুলান না হওয়াও দেরির অন্যতম কারণ। সিএজি সমীক্ষায় উঠে এসেছিল রেলপথ, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্লক এবং সিগন্যাল, টেলিকমিউনিকেশন ট্রেনের সময়ানুবর্তিতার ৫১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ, মূলগতভাবে এই শর্তগুলিকে প্রাধান্য দিয়েও ট্রেন চলাচলের ব্যাপক উন্নতি করা সম্ভব। ট্র্যাকের সংখ্যা বাড়ালে রেলপথে ট্রাফিক কমবে। তাতেও ভারতীয় রেল সময়ানুবর্তী হবে।

সিএজি সমীক্ষায় এও উঠে আসে, ভারতে সময়ানুবর্তিতা মাপাতেও বিস্তর গোল রয়েছে। ১৫ মিনিট আগে-পরে কখনও সময়ানুবর্তিতার প্রামাণ্য মাপ হতে পারে না। জাপানে মাত্র কয়েক সেকেন্ড এদিক-ওদিক বরদাস্ত করা হয়। নেদারল্যান্ডে তিন মিনিট। চিনের মতো বহুল জনসংখ্যার দেশগুলি ডেডিকেটেড উচ্চ গতির লাইন তৈরি করেছে, যাতে রোজকার সাধারণ ট্রেন চলে না। তাদের জন্য আলাদা লাইনের ব্যবস্থা রয়েছে। এই সব উচ্চ গতির রেলপথে ট্রেন অত্যন্ত সময়ানুবর্তী। বিশ্বের নানা কোণে নানা প্রযুক্তির সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। কিন্তু ভারতে এই নিয়ে মাথা ঘামায় না তেমন কেউ।

এই বিপুল জনসংখ্যার উপমহাদেশে ট্রেনের পরিষেবা আরও অনেকখানি উন্নত করা প্রয়োজন। ২০১৬ সালে 'মিশন রফতার' নামে একটি প্রোজেক্ট শুরু হয়েছিল। এর কাজ ছিল, ট্রেনেদের গতিবেগ বৃদ্ধি করা। তাতে এই পর্যন্ত কিছুই কাজের কাজ হয়নি। 'বন্দে ভারত' নামক একটি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। তার গতিবেগ ১৬০-১৮০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। এই ট্রেনটি মোটামুটি সময়েই চলে। কিন্তু কেবল উচ্চ গতির ট্রেন দিয়ে এই খামতির মোকাবিলা সম্ভব নয়। স্টেশনে দাঁড়ানোর সময়, চট করে গতিবেগ বাড়ানো বা কমানো, ট্রেনের দিশা পরিবর্তনের সুবিধা- অনেকগুলি শর্ত এখানে কাজ করে। ভারতীয় রেল জনগণ-প্রদত্ত ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা দিয়ে পরিকাঠামোর বিন্দুমাত্র উন্নতি না করে স্টেশনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে, আর বিশেষ সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে বছরে মাত্র একদিন সঠিক সময়ে ট্রেন চালনা করতে পেলে রেলমন্ত্রী 'ঐতিহাসিক সাফল্য'-র মুখ দেখছেন— এগুলি ভারতীয় রেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিঞ্চিৎ চিন্তিতই করছে সচেতন নাগরিকদের।

 

More Articles