স্বাধীন ভারতের লজ্জা! কর্মক্ষেত্রে আজও অধরা অর্ধেক আকাশের স্বপ্ন
স্বাধীনতার ৭৫ বছর কাটলেও নারীর আধুনিকতা, নারীর এগিয়ে আসার সম্পূর্ণ সার্থকতা কি লাভ হয়েছে?
রূপে লক্ষ্মী! গুণে সরস্বতী! কাজে দশভূজা! নারীর নাড়ির টানে একাধিক উপমা ব্যবহৃত হলেও সেই নারীই থেকে গিয়েছে ঘরকন্নার নিপুণ কন্যা হয়ে! তাদের ঘিরেই বারবার আবর্তিত হয়েছে এক গণ্ডিবদ্ধ জীবনের পথ। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর কাটলেও নারীর আধুনিকতা, নারীর এগিয়ে আসার সম্পূর্ণ সার্থকতা কি লাভ হয়েছে? সত্যিই কি সর্বক্ষেত্রে নারীর অবাধ যাতায়াত সম্ভব হয়েছে আজও?
এই প্রশ্নের, এই যুক্তির আবহেই সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য বার্তা দিচ্ছে এক অশনি সংকেতের! কেন? যেখানে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী তথাকথিত 'অনুন্নত ভারত'-এর কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থান, এই একবিংশ শতকের 'উন্নত ভারত'-এর নারীর অবস্থানের তুলনায় ভাল! অর্থাৎ, দেশ আধুনিকতার পথে এগলেও কর্মক্ষেত্র এবং নারীর অবাধ যাতায়াতে ক্রমশ পিছিয়ে গিয়েছে দেশ। কেন বলা হচ্ছে এমন? তথ্য বলছে, ১৯৮৭ সাল থেকে গত তিন দশকে ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং অন্যান্য দিকের উন্নয়নের সঙ্গে মহিলাদের শিক্ষার বৃদ্ধি সত্ত্বেও, দেশে নারী-কর্মশক্তির কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার, কর্মরত নারীদের অনুপাত, কমই রয়েছে। যা বিস্ময়করভাবে ১৯৮৭ সাল থেকে দ্রুত এবং অবিরাম হ্রাস পেয়েছে।
১৯৮৭-২০১৭; ভারতের গ্রামীণ এবং শহুরে অঞ্চলে ২৫-৬০ বছর বয়সি মহিলা এবং পুরুষদের মধ্যে সমীক্ষার ফলে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা গিয়েছে, সাধারণত শিক্ষা পূরণ করা ২৫ বছর বয়স থেকে কর্মক্ষম ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত গোষ্ঠীর মহিলা-পুরুষদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ কমেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, গ্রাম এবং শহর উভয়ক্ষেত্রেই, কর্মশক্তির বাহক হিসেবে পুরুষের অংশগ্রহণ, মহিলাদের তুলনায় অনেক বেশি রয়ে গিয়েছে। এই বয়ঃগোষ্ঠীতে পুরুষদের কর্মসংস্থানের হার গ্রামীণ অঞ্চলে ৯৬% থেকে ৯৪% এবং শহুরে ভারতে ৯৪% থেকে ৯১% হয়েছে। যা তুলনায় খানিকটা কমলেও শহুরে ভারতের কর্মশক্তিতে মহিলা অংশগ্রহণ ২৬% থেকে ২৪%-এ নেমেছে। যা সামগ্রিকভাবে চিন্তার।
আরও পড়ুন: নেই নিজস্ব রোজগার! সংসারেই সময় কেটে যায় বেশিরভাগ ভারতীয় মহিলার
দেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে মহিলা কর্মসংস্থানের হারের হ্রাস উল্লেখযোগ্যভাবে গ্রামীণ ভারত থেকে এসেছে। যেখানে সামগ্রিকভাবে মহিলা কর্মশক্তি এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ ১৯৮৭ সালের ৫৪% থেকে ২০১৭ সালে ৩১% -এ নেমেছে।
ওই সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সি গ্রামীণ মহিলাদের মধ্যে এই পতনের ক্ষেত্রে মূলত ভূমিকা পালন করেছে বিবাহিতরা। অর্থাৎ বিবাহিতদের মধ্যে প্রায় ৯০% ক্রমশ পিছিয়ে এসেছেন। সামিল হয়েছেন ঘরকন্নার ক্ষেত্রে। পরিবারের বিবাহিত মহিলা এবং পুরুষদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান পারিবারিক আয়, ১৯৮৭-১৯৯৯ সময়কালে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে, মহিলা কর্মশক্তির অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এই তারতম্য ঘটিয়েছে বলে দাবি করেন অনেকেই।
নারীশিক্ষা এবং নারী-কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি ইউ-আকৃতির সম্পর্ক এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যদের শিক্ষা বা আয় এবং নারী কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি নেতিবাচক সম্পর্ক এই পতনকে চালিত করে বলে দাবি করা হয়েছে ওই তথ্যে।
যেখানে কাজের ধরন অনুসারে, কর্মসংস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। এই আবহেই পরিলক্ষিত হয়েছে যে, এই পতনের অনেকটাই কৃষিতে অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্রে ঘটেছে। গ্রামীণ ভারতে কৃষিতে নারী কর্মশক্তির অংশগ্রহণ ১৯৮৭ সালে ৪৬% থাকলেও তা কমে ২০১১ সালে ৩৩% -এ নেমে আসে। ২০১৭ সালে তা আরও কমে ২৩%-এ নেমে আসে।
এছাড়াও পরিসংখ্যান অনুযায়ী দাবি করা হয়, উৎপাদন ক্ষেত্রেও মহিলা কর্মশক্তির অংশগ্রহণ ৩.৫% থেকে ২.৫%-এ নেমেছে এই সময়কালেই। যদিও ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা দিয়েছে নির্মাণ এবং পরিষেবা ক্ষেত্র। যেখানে প্রায় ১-১.৫% বেড়েছে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে।
এর পাশাপাশি পুরুষ অংশগ্রহণও কৃষিতে ১৯৮৭ সালের ৭৭% থেকে ২০১১ সালে ৬৫%-এ নেমে এসেছে, যা নির্দেশ করে যে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে হ্রাস অনেক বেশি হয়েছে। যদিও সামগ্রিক পরিস্থিতে অন্য কাজের প্রতি আকর্ষণের জন্য পুরুষদের এই শতাংশ হ্রাস বলেই দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৯৯-২০১১: এই সময়কালে নারীদের কর্মক্ষেত্রে (গৃহকর্ম বাদে) কম অংশগ্রহণ এবং ক্রমশ শতাংশের হ্রাসের কারণ হিসেবে একাধিক তথ্যগত তত্ত্বে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যেখানে, মূলত, শ্রমনির্ভর কাজের তুলনায় সূক্ষ্মতা নির্ভর কাজে নারীদের চাহিদার কথা বলা হয়েছে। যে চাহিদাযুক্ত কাজের ক্ষেত্রে খানিকটা মেশিন নির্ভরতা এসেছে। বীজ বপন থেকে শুরু করে রেশম বোনা, সব ক্ষেত্রেই মেশিনের অর্থাৎ যন্ত্রের প্রভাব পড়েছে। যা নারীদের একটা বড় অংশের কাজে না আসার কারণ। এর পাশাপাশি, চিরাচরিত বদ্ধমূল ধারণার কোপ পড়েছে নারীদের কর্মক্ষেত্রে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা শুধুমাত্র ঘরের কাজ করবে, তারা যে বাইরের কাজ করতেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, একথা বহুক্ষেত্রেই এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ক্রমশ, সংকীর্ণ মনোভাবের বলি হতে হয়েছে নারীদের। তাই, যোগ্যতা থাকলেও শুধুমাত্র সামাজিক আর পারিবারিক টানাপড়েনে কাজের ক্ষেত্রে ঘটেছে লিঙ্গবৈষম্য। রয়ে গিয়েছে এক চিরাচরিত কঠিন, অপ্রাসঙ্গিক বিধিনিষেধ। যার রক্তাক্ত কোপে খানিকটা বাধা পেয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন এবং কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ। এভাবেই গ্রামীণ কৃষিক্ষেত্রে নারীদের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে যান্ত্রিকতা। যা ক্রমশ মনুষ্যশ্রম হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গেই নষ্ট করেছে কাজের ক্ষেত্রে নারীদের অংশ গ্রহণের ভারসাম্যও। এই প্রযুক্তির পরিবর্তন এই এক দশকের মধ্যে বিপুলভাবে হয়েছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্র 'জেন্ডার অ্যান্ড মেকানাইজেশন: এভিডেন্স ফ্রম ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচার'-এ গবেষক কণিকা মহাজন, ফারজানা আফ্রিদি, মণিশঙ্কর বিষ্ণু উল্লেখ করেছেন এই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নারীদের কর্মক্ষেত্রে কম অংশগ্রহণের বিষয়টি, বিশেষত কৃষিক্ষেত্রে। যেখানে এই যান্ত্রিকীকরণের ফলে ১৯৯৯-২০১১ সময়কালে ভারতীয় খামারগুলিতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের শ্রম উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, যান্ত্রিক চাষ বৃদ্ধির ফলে, মহিলাদের শ্রমের ব্যবহার ৫% হ্রাস পেয়েছে।
যদিও, গ্রামীণ প্রেক্ষাপট এবং কৃষিক্ষেত্র ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্র বা অ-কৃষি কর্মসংস্থানের জগতে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্র ছাড়া, মহিলাদের যে যে ক্ষেত্রে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা যেত, সেই সেই ক্ষেত্রেও তাদের প্রয়োজন থাকলেও কাজে লাগানো যায়নি। যেখানে বিপুল শ্রমের গৃহকর্মের পাশাপাশি অন্য ক্ষেত্রেও বহু মহিলার আকর্ষণ থাকলেও বাধা হয়েছে সামাজিক বিধিনিষেধ। যা গ্রামীণ অঞ্চল তো বটেই ছাপিয়ে গিয়েছে মফসসল বা শহরেও। যেখানে মহিলা এবং রাতের শিফট অথবা একাধিক ক্ষেত্র এবং মহিলার অংশগ্রহণের লুক্কায়িত বিধিনিষেধ ক্রমশ কমিয়ে দিয়েছে এই হার। যেখানে অঘোষিত মহিলাবর্জিত কোম্পানি চালানোর মতো একের পর এক কর্মে মহিলাদের অংশগ্রহণে অনীহা সৃষ্টি করেছে তীব্র অসন্তোষ।
জাতীয় সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মহিলাদের গৃহের বাইরে কর্মে যাওয়া নিয়ে একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে বাড়ির কাছে কর্মস্থল না হওয়া। যেখানে যাতায়াতের সমস্যা, পরিবহণ, যোগাযোগ, নিরাপত্তার অভাববোধ ও নারীকে বাড়ির বাইরে কাজের জন্য যাওয়ায় বাধা দিয়েছে। যা একেকটি কাজের আবহে নষ্ট করেছে ভারসাম্য। প্রতিমুহূর্তে সমস্ত যোগ্যতা নিয়েও বসে থাকতে হয়েছে কর্মক্ষম নারীকে। পুরুষদের ক্ষেত্রেও যে এমনটা হয়নি, একথা বলা যাবে না। কিন্তু সেটা তুলনায় নগণ্য। নানা কারণের ফল। বেকারত্ব। উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কর্মে অনীহার এক চরম ফলও আবর্তিত হয়েছে পুরুষের ক্ষেত্রে। কিন্তু নারীদের এই অংশগ্রহণের ঘাটতি, প্রাসঙ্গিক তথ্য; দেশের নারীদের সামগ্রিক অবস্থান এবং লুকিয়ে থাকা বা প্রকাশ্য ট্যাবুকেই প্রকাশ করে!
যেখানে পুরুষ তুলনায় নারীর প্রায় ১৯-২০ শতাংশ কম কর্মদিবসের তথ্য, ৯০ শতাংশ অংশগ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে যথেষ্ট উদ্বেগের বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ভারতের উন্নয়নশীল অবস্থা এবং মহিলাদের সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া যথেষ্ট আশার সঞ্চার করেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে এই বৈষম্যও অচিরেই লুপ্ত হবে বলেই মত তাঁদের। যদিও শহুরে ভারতে মহিলা কর্মশক্তির অংশগ্রহণ সামান্য হ্রাস পেয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে ভারতের শ্রমবাজারে শহুরে মহিলাদের সামগ্রিক অংশগ্রহণ ২৪ শতাংশ। যা পুরুষ অংশগ্রহণের ৮৫%-এর তুলনায় স্পষ্টতই কম।
গৃহের ব্যাপক কাজ, কৃষিক্ষেত্র সহ একাধিক বিষয়ে নারীর সময়াতীত শ্রমের পরও কেন ১.৫ বিলিয়ন জনসংখ্যা সমৃদ্ধ দেশে এখনও ৪০ শতাংশ সৃজনশীল কর্মে যুক্ত নন, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে বারবার। শিক্ষা, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ, নিরাপত্তা, আগ্রহ বৃদ্ধি-সহ সমাজের সব স্তরের তথাকথিত কর্মে অংশগ্রহণে ঠিক যা যা করা প্রয়োজন, সেটাও কেন এখনও সফলভাবে করা যাবে না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে বারবার। উত্তর, পরিসংখ্যান আর শতাংশের আবহেই অধরা থেকে যায় যুগ যুগ ধরে।