বদলে যাচ্ছেন মমতা! এবার কি বদলাচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক লাইন?

তিনি আছেন তেমনই, যেমনটা আগেও ছিলেন; এই ভাবমূর্তির জন্যই বোধহয় ফের রাজনৈতিক কৌশলের এক নতুন বিচ্ছুরণে আলোকিত হতে চাইছেন মমতা!

পরিবর্তনই জীবনের নিয়ম! পরিবর্তন প্রয়োজন প্রতিটি মুহূর্তেই! কিন্তু তা যদি হয় রাজনীতিতে! কৌশলের অলিগলিতে যদি হঠাৎ হিল্লোল তোলে পরিবর্তনের ঢেউ! তাহলে? নাহ্! আমরা ২০১১ সালের মমতা-সুনামির আগের মুহূর্তের কথা বলছি না। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর অথবা একের পর এক ইস্যুকে সঙ্গী করে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের কথা বলছি না আমরা। বলছি, এই আজকের কথা। এই সময়ের কথা। হঠাৎ করে নীল আকাশে মেঘ জমার কথা। শুনতে কাব্যসম হলেও কিছুদিন অথবা কয়েকমাস আগের মমতা আর আজকের মমতা নিয়ে এমনই যেন নতুন পরিবর্তনের কথা মনে হচ্ছে রাজনৈতিক কারবারিদের একাংশের। মমতা গড়ে পোস্টার, হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা নতুন তৃণমূলের অলিন্দেই ডাক পাড়ছেন নতুন মমতাও? কেন বলছি একথা!

২০১১ সাল। যার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল ২০০৬-র বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হুঙ্কার। 'আমরা ২৩৫, ওঁরা ৩৫!'-র শব্দবন্ধেই তৎকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে ফেলেছিলেন তাঁর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কথকথা। একেবারে তলিয়ে যাওয়া তৃণমূল সমকালীন পঞ্চায়েত নির্বাচন, পরবর্তীতে নেতাই, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরকে তাদের উঠে দাঁড়ানোর শক্ত লাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছিল। ১৯৯৩-র লড়াকু যুবনেত্রী। ১৩ জনের মৃত্যু। পরবর্তীতে কেন্দ্রের মন্ত্রীত্ব ছিনিয়ে নেওয়া মমতা দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনিও পারেন! ৩৪ বছরের একটি প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে দিতে। চূর্ণবিচূর্ণ করতে। কিন্তু সেই মমতা আর আজকের মমতা কি খানিকটা আলাদা? স্বাভাবিকভাবেই আরও পরিণত, রাজনৈতিক ভাবে আরও অভিজ্ঞ হলেও তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের দাপুটে জননেত্রী কি হঠাৎ বদলে যাচ্ছেন? পরিস্থিতির চাপে কি তিনি ক্রমে নেপথ্যে চলে যাচ্ছেন?  নাকি নীরব, নিস্তব্ধতায় সাজাচ্ছেন নতুন রাজনৈতিক ঘুঁটি! সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহ যেন ইঙ্গিত করছে সেই দিকেই।

আরও পড়ুন-কেন সাতটি নতুন জেলার সিদ্ধান্ত মমতার? জানুন আসল কারণ

প্রসঙ্গত, ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভাল ফল, তৃণমূলের খানিকটা ব্যর্থতা অস্বস্তিতে ফেলেছিল তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিশেষত, উত্তরবঙ্গে বিজেপির আধিপত্য বিস্তার মমতার 'দার্জিলিং হাসছে' অথবা উত্তরবঙ্গের পাশে থাকার কর্মসূচি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু উলটপুরাণ ঘটে ২০২১-এই। প্রশান্ত কিশোর-আবহে অভিষেক, মমতার প্রচার; নন্দীগ্রাম। 'খেলা হবে'র উদ্দাম প্রভাব তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছে দেয় মমতাকে। নির্বাচনের আগে খানিকটা অনিশ্চিত ফলাফলের আশঙ্কা। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব আসনে প্রার্থী, দলের প্রাক্তন মহীরুহ শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে 'ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ে' নামার ক্ষত নিয়েই ঘুরে দাঁড়ায় তৃণমূল। ফের প্রতিষ্ঠিত হয় মমতা-সত্য। মুখ্যমন্ত্রীও উজ্জীবিত সরকার চালানোর পথে অগ্রসর হন আবার।

ক্ষত মিটছিল। সারদা, নারদা একাধিক অভিযোগের পরেও একইভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তৃণমূলও। কিন্তু বাঁধা! খেই হারাল শিক্ষাক্ষেত্র নিয়ে। শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি মাথাচাড়া দিল ফের। জল্পনা কাটিয়ে সিবিআই-হাতে গ্রেফতার হলেন মমতার 'প্রিয়' পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গে তাঁর বন্ধু অর্পিতা মুখোপাধ্যায়।

পার্থ-ক্ষত মুছতে মুছতেই ফের গরু, কয়লাকাণ্ডের উত্তাপ ছড়াল। সিবিআই গ্রেফতার করল বীরভূমের 'বাদশা' অনুব্রত মণ্ডলকে। আবারও চাপে পড়ল তৃণমূল। একজনের পাশে না দাঁড়ালেও সেই দলই পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তায় নামল ফের। উস্কে দিল সারদা, নারদকাণ্ডের স্মৃতি। মদন মিত্র গ্রেফতার পর্বের কাহিনি।

কিন্তু তখনের অল আউট আক্রমণে যাওয়া মমতাকে গত ২১ জুলাইয়ের পরে আর সেভাবে পাওয়া যায়নি। যে মঞ্চ থেকে স্বমেজাজে মুড়িতে জিএসটি চাপানোর প্রতিবাদে, কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে ভয় দেখানোর বিরুদ্ধে, কেন্দ্রের বঞ্চনার বিপক্ষে সরব হয়েছিলেন মমতা। যে মঞ্চ থেকেই ২০২৪-এ কেন্দ্রে বিজেপির ক্ষমতায় না আসা নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা। যে মমতা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধীদের প্রার্থী, প্রাক্তন তৃণমূল নেতা যশোবন্ত সিনহার প্রার্থীপদ, বিরোধীদের এককাট্টা করে বৈঠকের মূল মুখ হয়ে উঠেছিলেন। সেই মমতাই কি হঠাৎ বদলে গেলেন? পরিবর্তন করে ফেললেন রাজনৈতিক কৌশল! তাহলে কি কেন্দ্রীয় এজেন্সি এবং তৃণমূললের একের পর এক নেতা, মন্ত্রীর গ্রেফতার, অভিযুক্ত হওয়া প্রভাবিত করেছে মমতার হঠাৎ পরিবর্তনেও? একাধিক প্রশ্ন, জল্পনা, বিতর্ক তুঙ্গে উঠতেই বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশও।

তাঁদের দাবি, গত ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ এবং তার আগে-পরের তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আজকের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খানিকটা ফারাক রয়েছে‌ই। যা একদিনের নয়, একাধিক ঘটনা, পরিস্থিতি, রাজনৈতিক টানাপড়েনের ফল! দাবি, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেও একদা মমতা-সৈনিক শুভেন্দু এবং বঙ্গের বিরোধী রাজনৈতিক দলের যৌথ আক্রমনের ক্ষেত্রে কোনও তারতম্য ঘটেনি। সঙ্গে যোগ হয়েছে বাম-কংগ্রেসের 'বিজেমুল তত্ত্ব'! এর পাশাপাশি একাধিক দুর্নীতির ইস্যুতে কেন্দ্রীয় এজেন্সির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। চাপে পড়েছে তৃণমূল। একের পর ঘটনায় মামলা গড়িয়েছে আদালতে। সরকার পক্ষের তীব্র লড়াইয়ের পরেও একাধিক মামলায় রায় সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি মামলার রায়ে বিভিন্ন ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে মমতা-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। তাহলে কি সবক্ষেত্রেই রাজ্য প্রশাসন ব্যর্থ! তাই নিয়েও সরব হয়েছে বিরোধীরা।

এই আবহেই গোদের উপর বিষ ফোঁড়া হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি। দিনের পর দিন চাকরিপ্রার্থীদের ধরনা, আন্দোলন এবং বিরোধীদের সরব হওয়া। যা আদালতের হস্তক্ষেপে আরও অস্বস্তিতে ফেলে সরকারকে। কোটি কোটি টাকার সারদা অথবা গরু, কয়লা পাচারের দুর্নীতিকে ছাপিয়ে এর আঁচ লাগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের গায়েও। গ্রেফতার হন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত মন্ত্রীও। রাজ্যের মানুষের সামনে আসে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনা। 'অন্যায় করলে কাউকে ছাড় নয়', এই বার্তার মধ্যেই দল, সরকার থেকে ছেঁটে ফেলা হয় পার্থকে। মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মন্ত্রীর এহেন হাল এবং তাঁর বিরুদ্ধে দলের এই কড়া অবস্থানে প্রশ্ন ওঠে এখন কি তৃণমূলে অভিষেকই শেষ কথা বলছেন? তাহলে কি দলের সাধারণ সম্পাদকের বলা, নতুন তৃণমূলই উঠে আসছে ফের! যদিও মমতার পার্থ নিয়ে খানিকটা চুপ থাকা, আবার অনুব্রত নিয়ে সরব হওয়ার পিছনে খুব একটা তাৎপর্য দেখছেন না রাজনৈতিক মহলের একাংশ।

তাঁদের দাবি, বরাবর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রক্ষা করতে চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেছেন মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতেই। সেই মমতাই বারবার 'সততার প্রতীক' হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সাদা শাড়িতে একটুও কালির দাগ লাগতে দিতে চাননি মমতা। প্রকাশ্যে এমন কোনও অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে বা তাঁর দলের বিরুদ্ধে উঠুক এবং তা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অস্বস্তিকর হোক, এমনটা চাননি তিনি। কিন্তু সেটাই হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও অভিযোগের আঁচ না লাগলেও তাঁর কাছের রাজনৈতিক সঙ্গী, দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে, পঞ্চায়েত স্তর থেকে শুরু করে রাজ্য স্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে উঠেছে একাধিক অভিযোগ। বিরোধীদের দাবি, আদালতের পর্যবেক্ষণ, মামলার ঘনঘটায় বারবার অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বকে।

নির্বাচনের আগে 'সব আসনে মমতা প্রার্থী, ভুল হলে শুধরে দিন, আমাকে চড় মারুন'; বলে বারবার জনতার সামনে উপস্থাপিত হতে হয়েছে। একাধিক উন্নয়ন, জনমুখী প্রকল্প চালু করেও মানুষকে জবাব দিতে হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে। যা স্বাভাবিকভাবেই ভা লভাবে নেননি তৃণমূল নেত্রী। বরাবর স্বচ্ছতাকে প্রাধান্য দিলেও সেই তাঁকেই নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে 'ডিফেন্ড' করতে হয়েছে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও! তবুও তিনি কিছু জানেন না, এই বিশ্বাস জোরালো করতে দেয়নি বিরোধীরা।

এখানেই ১৯৯৩-র বিদ্রোহী, লড়াকু মমতা, ২০০৬ থেকে ২০১১-র অপ্রতিরোধ্য মমতাকে খানিকটা পরিবর্তিত হতে হয়েছে বোধহয়! খানিকটা দড়ি ছেড়ে দেওয়ার যে কৌশল তিনি নিয়েছিলেন, সেই দড়িই কি তিনি গুটিয়ে নিচ্ছেন আবার! রাজনৈতিকভাবে ফের 'দলীয় ইমেজ' পুনুরুদ্ধার করতে একটু বদলে যাচ্ছেন তিনি! অনেকেই বলছেন, আগে থেকেই দলের হাল কড়া হাতে ধরলে, 'পুরনো মমতা' বজায় থাকলে কেষ্ট কেসের কষ্ট অথবা অপা-কান্ড এমনকি বেলাগাম দুর্নীতির অভিযোগে মদন-শোভনবিদ্ধ হতে হত না! এমনকি গরু-কয়লায় নজর থাকলে সিবিআই নজরে পড়তে হত না তৃণমূলকে। যা নির্বাচনে ঠিক কতটা প্রভাব বিস্তার করবে, তার নিশ্চয়তা না থাকলেও তৃণমূলের অন্দরে এবং তৃণমূল স্তরের বিশ্বাস করে দল করা কর্মীর মনে যে কুপ্রভাব এনেছে, আত্মবিশ্বাসে যে খানিকটা চিড় ধরিয়েছে, তা মানছেন তৃণমূল নেতারাও।

সেখানেই প্রশ্ন উঠছে ফের, কেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের মতো নেতারা সামনে আসেননি, যাঁদের বিরুদ্ধে তেমন একটা সরব হন না বিরোধীরাও! মমতার রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনার জল্পনার মধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সরব এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রায় নিরব মমতার কথাও অনেকেই বলছেন। রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক সম্পর্কের তিক্ততা এবং তাঁরই উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রার্থীপদ পাওয়ার পরে তৃণমূলের ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত, এক অন্য রাজনৈতিক মমতার অবস্থানকেই জানান দেয় বলেই মনে করেন কেউ কেউ। এদিকে সাম্প্রতিককালের দিল্লি-সফর, মোদি-মমতা বৈঠক। 'নীতি আয়োগ' বৈঠক পর্ব নিয়েও অন্য মমতাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।

অভিষেক-প্রভাব তত্ত্বের মধ্যেই মমতাও যেন বারবার বলতে চাইছেন তিনি যে ভাবমূর্তির জন্য বারবার লড়াই করেছেন, কষ্ট করে দল তৈরি করেছেন। একাধিক শহিদের রক্তে, সামান্য কর্মীদের শ্রমে ঘামে করে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। অমানুষিক লড়াই তাঁকে এনে দিয়েছে এই পর্বে, সেই এক রকমই আছেন তিনি। এখন যে মেজাজ, তা সাময়িক! তা নির্দিষ্ট নয়। দাবি, সেটা মমতা নন, সেটা মমতার একটা অন্য দিক! তিনি আছেন তেমনই, যেমনটা আগেও ছিলেন; এই ভাবমূর্তির জন্যই বোধহয় ফের রাজনৈতিক কৌশলের এক নতুন বিচ্ছুরণে আলোকিত হতে চাইছেন মমতা!

জানা নেই, হয়তো কিছুটা সত্যি, আবার হয়তো কল্পনা আর জল্পনার মিশেলে এক কথকতা মাত্র। উত্তর দেবে সময়!

More Articles