সেলিম কি পারবেন গৌতম দেবের ট্র্যাডিশনটা ধরে রাখতে?
অশক্ত শরীরে তাঁর ঝাঁঝালো বক্তৃতা শোনার জন্য এখনও মুখিয়ে থাকেন আপামর বাম সমর্থকরা। রাজ্যপাট পরিবর্তনের আগে থেকেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে বামেদের লড়াইয়ে বামেদের অন্যতম সেনানায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর কড়া ভোকাল টনিক, এবং 'হয়ে যাক এসপার ওসপার' ভঙ্গিতে দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করেছেন তিনি বহুবার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতায় আসার পরেও তোপ অব্যাহত রেখেছিলেন তিনি। তাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের। কথা বলার ভঙ্গি, তাঁর মেজাজের জন্য, নিজের দলেও প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। একুশের নির্বাচনে রাজ্য থেকে দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর যুবদের সামনে নিয়ে আসার প্রথম পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনিই। বামফ্রন্টের পালাবদলের সময় শোনাও হলো তাঁর সিদ্ধান্ত। দলের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আসীন হল যুবরা, কিন্তু সেই যুবদের ভিড়েই কোথাও একটা হারিয়ে গেলেন বামফ্রন্টের সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রবীণ নেতাটি। তিনি আর কেউ নন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিআইএম নেতা গৌতম দেব।
যদিও শুধুমাত্র গৌতম দেব একা নন। বাদের তালিকায় নাম উঠেছে সিপিএমের আরো অনেক দেবে'র। রবীন দেব, নেপাল দেব ভট্টাচার্য, সকলকেই ড্রেসিংরুমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। একটা সময় এরা ছিলেন সিপিএম রাজ্য কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। রবীন দেব যেমন ছিলেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, তিনি নেপাল দেব ভট্টাচার্য ছিলেন দলের রাজ্য কমিটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। গৌতম দেব নিজেই ছিলেন একজন মন্ত্রী। তাই দেব শূন্য সিপিএমের রাজ্য কমিটি আজ অনেকেরই চোখে লাগছে। সিপিএম-এর রাজ্য কমিটির এক সদস্য বলছেন, "কমিউনিস্ট মানুষেরা দেবতায় বিশ্বাস রাখেন না। কিন্তু এই সিপিএম 'দেব' ছাড়া কার্যত অচল ছিল। আমাদের পার্টি সবচাইতে বেশি এদের উপর নির্ভরশীল। একটা যুগের অবসান হলো। দেব-রা সামনে না থাকলেও তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ পাওয়া যাবে বলেই আমার ধারণা। তবে, তাদের আসায় যে বাড়িটা দেবালোকে পরিণত হয়েছিল, সেটা হয়তো আর থাকবে না।"
আরও পড়ুন-শব্দের থেকেও তিনগুণ জোরে ছুটবে মিসাইল, ব্রাক্ষ্মস জুড়েছে ভারত-রাশিয়াকে!
সারদা কাণ্ড নিয়ে গৌতম দেব -
এই দেবের তালিকাতেই একজন ছিলেন গৌতম দেব। সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কার্যত ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন গৌতম দেব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুকুল রায়কে একসঙ্গে নিশানা করে তাঁর বক্তব্য ছিল, "সারদাকাণ্ড নিয়ে আগাগোড়া সব জানতেন মমতা মুকুল।" মুকুল রায়কে ক্রিমিনাল বলেও আখ্যা দেন গৌতম দেব। একাধিকবার পাগল, উন্মাদ - এইরকম মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হলেও কখনোই বিরোধিতা করা থেকে পিছিয়ে আসেননি তিনি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মত তৃণমূল নেতাঁরা তাঁর কথাকে ছেঁদো কথা, তাকে অসুস্থ এবং পাগল মানুষ বলে কটাক্ষ করলেও তিনি কখনোই নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়েননি।
সিপিএম-এর জেলা দপ্তরের সাংবাদিক বৈঠকেও শাসকদলের বিরুদ্ধে একাধিকবার সারদা কাণ্ড নিয়ে কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাকে। অন্যান্য অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে পথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তিনি। কালিম্পং এর কাছে ডেলো বাংলোতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সেই বিতর্কিত বৈঠকের কথাও প্রথমবার তিনিই জনসমক্ষে নিয়ে এসেছিলেন। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মমতা এবং মুকুলকে ক্রিমিনাল টাইপ পার্সোনালিটি বলেও দাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মদন মিত্রকে নিয়েও এককালে শোনা গিয়েছিল গৌতম উবাচ।
নিজের দলেই বিতর্কিত
তবে শুধুই কি বিরোধী দলকে নিয়ে কটাক্ষ এবং বিতর্কিত মন্তব্য? না তেমনটা ঠিক নয়। নিজের দলের বিরুদ্ধেও একাধিকবার ক্ষোভ উগরে দিতে শোনা গিয়েছে গৌতম দেবকে। ২০১৭ সালে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সমালোচনা করে সিপিএমের অন্দরেই ভর্ৎসিত হয়েছিলেন গৌতম দেব। সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, গৌতম দেবের বক্তব্য দলের তরফ থেকে অনুমোদন করা হবে না। সীতারাম ইয়েচুরিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার ভোটে প্রার্থী করা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছিল বিতর্ক। বঙ্গ নেতৃত্বের অনেকে ইয়েচুরির পাশে দাঁড়ালেও, প্রকাশ কারাটের সমর্থকদের আপত্তিতে প্রার্থী করার প্রস্তাব কার্যত খারিজ হয়ে যায়। আর এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কেন্দ্রীয় কমিটির সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন গৌতম দেব।
প্রকাশ কারাট এবং তাঁর সমর্থকদের একহাত নিয়ে গৌতম দেব বলেছিলেন, সীতারাম ইয়েচুরিকে হিংসা করেন নাকি? ও দেশজুড়ে একটা গ্রহণযোগ্য মুখ হয়ে উঠেছিল বলেই কি এইসব করতে হলো? এই বক্তব্যের পর সিপিএমের অন্দরে একাধিকবার সমালোচনা হয় গৌতম দেবকে নিয়ে। গৌতম দেবের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তুলে কড়া চিঠি পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় কমিটির তরফ থেকে। সিপিএম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু সকলেই গৌতম দেবের বিরোধিতা করেন। সেই সময় থেকেই দলের মধ্যে ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে শুরু করেছিলেন গৌতম দেব।
মমতা একটা ' ক্রিমিনাল ' : গৌতম দেব
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের পালাবদলের নির্বাচনের আগে বামেদের দুর্গ রক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। তাঁর ভোকাল টনিক, কিংবা তাঁর সমালোচনা, সব কিছুর মধ্যেই একটি নাম উল্লেখযোগ্য ভাবে থাকত এবং সেটি হল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সারদা কাণ্ড নিয়ে বারবার মমতাকে কটাক্ষ করলেও, সরকারের কাজ কর্ম পরিচালনা নিয়েও তাঁকে দেখা গিয়েছে মমতাকে নিশানা করতে। মমতা সম্পর্কে, তাঁর ধ্যান ধারনা ছিল একেবারে অন্যরকম। তিনি বলতেন, মমতা সম্পূর্ণ আনপ্রেডিক্টেবল। কখন সিবিআই চিঠি পাঠাবে, তাই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি বিক্রির টাকা নিয়ে মমতাকে কটাক্ষে বিধেছেন গৌতম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় আয় ব্যয় হিসাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
মমতাকে নিশানা করে সরাসরি তাঁর অভিযোগ, মমতা সারদার থেকে টাকা নিয়েছেন, বড়লোকদের থেকে টাকা নিয়েছেন। এমনকি, ধরপাকড় ঠিক ভাবে চললে মমতাকে জেলে যেতে হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি করেছিলেন তিনি। মুকুল রায় ফ্যাক্টর নিয়েও তাঁর গলায় একইরকম সুর। ববি হাকিম হোক কিংবা অরূপ রায় সবাইকেই একই সারিতে ফেলেন তিনি। কিন্তু, সেই শারির শীর্ষে তিনি এখনো রাখেন মমতাকে। তাঁর মতে, মমতা প্রচুর অন্যায় করেছেন। 'শি হ্যাস এ ক্রিমিনাল বেন্ট অফ মাইন্ড'।
বাম - তৃণমূল এক হউক : গৌতম দেব
২০১৯ নির্বাচনে যখন বামফ্রন্টের একেবারে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা, সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাত মেলাতেও রাজি হয়েছিলেন গৌতম দেব। তিনি বলেছিলেন, "মমতাকে সমর্থন করতে পারি, তবে শর্ত মানতে হবে।" কি সেই শর্ত? বিজেপির আগ্রাসনে সেই সময় রীতিমতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে তৃণমূল। আব্দুল মান্নান, সুজন চক্রবর্তীরদের মতো নেতাদের নাম করে একসাথে লড়ার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক সেই সময়ই মাঠে নামেন গৌতম দেব।
সুজন চক্রবর্তী জোটের সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দিলেও, মত দিয়েছিলেন গৌতম দেব। তিনি বলেছিলেন, মমতা ব্যানার্জি যদি তাদের শর্ত মানেন এবং তাদের মত করে চলতে পারেন তাহলে তাঁরা মমতাকে সমর্থন করবেন। তৎকালীন নির্বাচনের সময় গৌতম দেবের এই মন্তব্য তোলপাড় করে দেয় রাজ্য রাজনীতিকে। মুখ্যমন্ত্রী যদিও এই বিষয়টি নিয়ে বেশি জল ঘোলা না করলেও, গৌতম দেবের মন্তব্য সেই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার হটকেক হয়ে ওঠে।
তরুণদের নিয়ে আশাবাদী
আপামর বামপন্থী এই রাজনীতিকের গলায় সবসময়ই শোনা যেত বিরোধী দলকে নিয়ে কড়া মন্তব্য। বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের ধরাশায়ী ফলাফলের পর এসএফআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা দিবসের অনুষ্ঠানে বিজেপি এবং আরএসএসকে বক্তৃতাঁর মাধ্যমে খোঁচা দিতে ছাড়েননি গৌতম দেব। বামফ্রন্টের শূন্য আসনকে ব্যর্থতা হিসেবে গ্রহণ করেও সেখান থেকেই নতুন কিছু শেখার আহ্বান দিয়েছিলেন এই প্রাক্তন মন্ত্রী।
তৃণমূল এবং বিজেপিকে একই গন্ডিতে ফেলে প্রচারের ফলে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, তাও মেনে নিয়েছিলেন তিনি। তবে, প্রথম থেকেই তিনি ভরসা রেখেছিলেন বামেদের যুব ব্রিগেডের প্রতি। তাঁর বক্তব্যে সব সময় উঠে আসতো ছাত্র সংগ্রামের কথা। আগামী দিনে পড়ুয়াদের কি করণীয় তাও একাধিকবার বাতলে দেন গৌতম দেব। সর্বভারতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে এর আগেও মন্তব্য করেছিলেন গৌতম দেব। তবে জাত ধর্মের বিভাজন নিয়ে রাজনীতি করার পরিপন্থী তিনি। বরং তাঁর আন্দোলনের প্রধান ভাষাই ছিল কর্মসংস্থান এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ।
রাজ্যে বামেদের বিপর্যয় নিয়ে ছাত্র-যুবদেরকেও পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। সাদা চুলের নেতাদের পাশাপাশি যে পার্টির শীর্ষস্তরে কাঁচা মাথাদেরও প্রয়োজন, প্রথমবার তিনিই জনসমক্ষে ঘোষণা করেন। ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র ফেরানোর লড়াই জোরদার করার জন্য এসএফআইকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। আগামী দিনে এই তরুণ ব্রিগেড যে পার্টির হাল ফেরাতে পারে, সেদিকেই বারবার ইঙ্গিত করেছিলেন গৌতম দেব। কিন্তু, কে জানতো, পার্টিতে তরুণ মুখ প্রবেশের পথ প্রশস্ত করতে গিয়ে তাঁকেই তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেবে বামফ্রন্ট। সংখ্যালঘুদের উপর ভরসা রাখতে গিয়ে গৌতম দেবকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বামফ্রন্ট। তাঁর মতো একজন নেতা পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতেন দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ। এখন প্রশ্নটা হল, যাকে সামনে রেখে এত কিছু আয়োজন, সেই মহম্মদ সেলিম গৌতম দেবের চাঁচাছোলা মন্তব্যের সেই ট্র্যাডিশনটা ধরে রাখতে পারবেন তো?