আইসিসি-র শীর্ষে সৌরভ, সম্ভাবনা কতটা উজ্জ্বল?

Sourav Ganguly: এবার ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে অভিষেক ঘটতে চলেছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের?

গুগলি আর স্লগ ওভারে ছক্কা হাঁকিয়ে এবারে একেবারে 'বাপি বাড়ি যা'... সিএবি এবং বিসিসিআইয়ের দায়িত্ব সামলানোর পর এবারে আইসিসি-র মসনদে বসতে পারেন বাঙালির ক্রিকেট আইকন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়? ইতিমধ্যেই ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে তার দক্ষতার পরিচয় বারবার সামনে এসেছে। তিনি যখন সিএবি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সেই সময় বাংলা দলের ছিল স্বর্ণযুগ। পরবর্তীতে তিনি যখন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট, সেই সময়টাও ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য ছিল বেশ ভালো সময়। আর এবার হয়তো ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে অভিষেক ঘটতে চলেছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে, নিউজিল্যান্ডের গ্রেগ বার্কলের পর পরবর্তী আইসিসি চেয়ারম্যান হতে পারেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

ক্রিকেটার হিসেবে, অধিনায়ক হিসেবে কেরিয়ারে বারবার সমস্ত বাধা অতিক্রম করেছেন তিনি। কিন্তু ধাক্কা খাওয়ার পরেও ফিরে এসেছেন স্বমহিমায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর তার বিসিসিআই চেয়ারপার্সনের মেয়াদ আরও তিন বছর বৃদ্ধি হলেও, বোর্ড থেকে অপসারণ নিশ্চিত সৌরভের। ৬৭ বছর বয়সি ১৯৮৩ বিশ্বকাপের অন্যতম হিরো অলরাউন্ডার রজার বিনি এবার সম্ভবত বসতে চলেছেন সৌরভের আসনে। অন্যদিকে, নিজের জায়গা টিকিয়ে রেখেছেন জয় শাহ। আরও তিন বছরের জন্য বিসিসিআইয়ের সচিব পদে থাকতে চলেছেন তিনি।

বোর্ডের মসনদে রজার বিনি
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মসনদে আসীন হওয়ার জন্য এতদিন পর্যন্ত যার নাম শোনা যাচ্ছিল, মঙ্গলবার দুপুরে তিনি নিজেই ছিটকে গেলেন এই দৌড় থেকে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আমল শেষ হয়ে গেলেও, এখনই শুরু হচ্ছে না জয় শাহ আমল। জানিয়ে দেওয়া হলো, ভারতীয় ক্রিকেটের শুরু হতে চলেছে রজার বিনির যুগ। গতবারের মতো বড় কোনও মোচড় না হলে, সৌরভের পরবর্তীতে কর্নাটকের এই প্রবীণ ক্রিকেটার হতে চলেছেন বিসিসিআই সভাপতি। আর অমিত শাহ-র পুত্র জয় যেখানে ছিলেন, সেখানেই থেকে যাবেন।

আরও পড়ুন: কেন জামা খুলে উড়িয়েছিলেন সৌরভ, সেই ম্যাচের যে গল্প আজও অজানা

কিন্তু কেন জয় শাহ-র পরিবর্তে রজার বিনি হয়ে উঠলেন হট ফেভারিট? জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা অবশ্য বিশ্বকাপ জয়ের বিষয়টিকে খুব একটা আমল দিতে চাইছেন না। বরং তাঁদের মতে, নরেন্দ্র মোদি চাননি বলেই জয় আসতে পারলেন না ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পদে। এই মর্মে তিনি আগেও একটি সংকেত দিয়ে রেখেছিলেন। গত ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে ভাষণ দেওয়ার সময় পরিবারতন্ত্রর বিরোধিতা করেছিলেন মোদি। বলেছিলেন, শুধু রাজনীতি নয়, দেশের বিভিন্ন সংস্থাতেও পরিবারতন্ত্রর ছায়া আমি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের এটা থেকে বেরোতে হবে। তখন মোটামুটি অনেকেই ভেবেছিলেন, মোদি হয়তো গান্ধী পরিবারের কথা বলছেন। কিন্তু, এভাবে যে ব্যাপারটা অমিত শাহ-র দিকেও ঘুরে যেতে পারে, সেটা হয়তো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি অনেকে।

মোদির ধ্যানধারণার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা বলছেন, কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্যই অমিত-পুত্র জয়ের বোর্ড সভাপতি হওয়া হলো না। তিনি থেকে গেলেন সেই বোর্ড সচিব পদেই। যে নীতি নিয়ে মোদি এবং বিজেপি বিরোধী কংগ্রেসকে আক্রমণ করে, সেই নীতি আগে তাদের প্রণয়ন করতে হবে, নতুবা সেই রাজনৈতিক আক্রমণ কোনও কাজের নয়। তাই হয়তো অমিত-পুত্রকে দিয়েই নিজেদের উদাহরণ তৈরি করল ভারতীয় জনতা পার্টি। বোর্ড সচিব পদে তিনি রইলেন, অর্থাৎ পরিবারতন্ত্রর ছায়ায় উন্নতি তাঁর হলো না। কোনও ক্রীড়া সংস্থার মাথায় রাজনীতির ছোঁয়া রাখতে চাইলেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর রাজনীতির জাঁতাকলে পিষে বোর্ড সভাপতি হবার স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল অমিত-পুত্রর।

রজার বিনিই কেন?
বোর্ড সভাপতি হিসেবে রজার বিনির নাম সামনে আসার সব থেকে বড় কারণ হলো, তিনি বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে যখন কপিলদেব নিখাঞ্জ ওয়েস্ট ইন্ডিজের চোখে চোখ রেখে বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে তুলেছেন, সেই সময় তাঁর সেনাবাহিনীর একজন যোগ্য সদস্য ছিলেন রজার বিনি। তাঁর ভাবমূর্তি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। প্রচারের আলোয় তিনি থাকতে চান না। আর সবথেকে বড় কথা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ। একই সঙ্গে এই ক্রিকেটারকে যদি বোর্ডের শীর্ষে বসানো হয়, তাহলে ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এই বার্তা যাবে, ফুটবল এবং হকির মতো ক্রিকেটের প্রাক্তন খেলোয়াড়ের হাতেই দায়িত্ব দেওয়া হলো ভারতীয় ক্রিকেটের। অর্থাৎ, একজন প্রাক্তন ক্রিকেটারের হাত থেকে আরেকজন প্রাক্তন ক্রিকেটারের হাতে গেল ভারতীয় দলের দায়িত্ব।

কিছুদিন আগেই সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার নির্বাচনে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছেন প্রাক্তন ফুটবলার কল্যাণ চৌবে। তার রাজনৈতিক পরিচিতি থাকলেও, একটা দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ছিলেন মাঠের মানুষ। সেখানে বাইচুং ভুটিয়া-র সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও, কল্যাণের জয় ছিল সময়ের অপেক্ষা। তবে, খেলোয়াড়ি সত্তা এবং গরিমার দিক থেকে দেখতে গেলে রজার বিনি কিন্তু সৌরভের ধারপাশেও আসেন না। তিনি শুধুমাত্র ছিলেন একজন ক্রিকেটার। তাঁর পুত্র স্টুয়ার্ট বিনিও ছিলেন ভারতীয় দলের সদস্য। তবে তাঁরা কেউই ভারতীয় ক্রিকেটের সেরকম বড় মুখ ছিলেন না। তাই কেন হঠাৎ রজার বিনির নাম এই নির্বাচনের তালিকায় উঠল, সেই নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সৌরভ-অপসারণেও রাজনীতি?
বিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সৌরভের বাদ পড়ার খবর সামনে আসার পরেই শুরু হয়েছে নেপথ্য কারণ নিয়ে বিশ্লেষণ। যেখানে আরও তিন বছর পর্যন্ত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় প্রেসিডেন্ট থাকতে পারতেন, সেখানে কেন তাকে মেয়াদপূর্তির আগেই সরিয়ে দেওয়া হলো? এই কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে উঠে আসছে নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ যেখানে বলছেন, বিশ্ব ক্রিকেটের ময়দানে যাওয়ার লক্ষ্যেই এই পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন সৌরভ, সেখানেই আরেক দলের বিশ্লেষণে উঠে আসছে মূল্যদানের প্রসঙ্গ। কীরকম মূল্যদান? না, রাজনীতিতে যোগদানের। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে যখন বিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, তখনই তারই সঙ্গে বিসিসিআইয়ের সচিব নির্বাচিত হয়েছিলেন অমিত শাহর পুত্র জয় শাহ। তারপর থেকেই বিজেপির সঙ্গে সৌরভের সমীকরণ নিয়ে নানারকম তথ্য সামনে আসতে শুরু করে। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে, এই বিষয়টি আরও তুঙ্গে ওঠে। বিজেপির হয়ে প্রচার করতে এসে সৌরভের বেহালার বাড়িতে নৈশভোজে হাজির হয়েছিলেন খোদ অমিত শাহ। হাসপাতালে যখন ভর্তি হয়েছিলেন সৌরভ, সেখানেও বারবার ফোন করে খবর নিয়েছিলেন অমিত শাহ। সৌরভ রাজনীতিতে আসবেন কি না, সেই ব্যাপারে জানতে চাইলে তার স্ত্রী ডোনা জানান, রাজনীতিতে এলেও খেলার মাঠের মতোই ভালো ফল করবেন তাঁর স্বামী। সেখান থেকেই শুরু হয় জোর জল্পনা। এমনকী, বিজেপির তরফে সৌরভকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হতে পারে বলেও জোর গুঞ্জন ওঠে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে।

কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচার যতটা প্রভাবশালী ছিল, ভোটবাক্সে তার ছিটেফোঁটা প্রভাবও পড়েনি। আর তাতেই সৌরভের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা ক্ষীণ হয়ে যায়। পাল্টা, সম্প্রতি দুর্গাপুজোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্তির অনুষ্ঠানে রেড রোডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক পাশেই বসে থাকতে দেখা যায় সৌরভকে। টেলি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠানেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে হাসিমুখে পুরস্কার গ্রহণ করেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আর তারপর বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানো হলো সৌরভকে। অথচ নিজের জায়গায় রয়ে গেলেন অমিত-পুত্র জয়। তবে কি বিজেপিতে না যাওয়ার কারণেই পদ খোয়াতে হলো সৌরভকে? না কি শুধুমাত্র বিশ্ব-ক্রিকেটের ময়দানে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার দৌড়ে নাম লেখানোর জন্যই সৌরভ নিলেন স্বেচ্ছা-অবসর?

এবার কি তবে আইসিসি-র দৌড়ে?
তবে সৌরভকে সরানোর পিছনে আরও বেশ কিছু তত্ত্ব উঠে আসছে। শোনা যাচ্ছে, সৌরভকে আইসিসিতে পাঠাতে পারে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। সেক্ষেত্রে ভারতীয় বোর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে আইসিসি চেয়ারম্যানের পদের জন্য লড়াই করবেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। এমনকী, সৌরভ নিজের ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিনিধি হিসেবে আইসিসি-তে যেই-ই যান না কেন, তাঁর জয় কার্যত নিশ্চিত। তবে, সৌরভের এই রাস্তা কিন্তু এতটা সহজ নয়। শোনা যাচ্ছে, বোর্ডের প্রাক্তন সভাপতি নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনও এই পদের জন্য লড়াই করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সৌরভের জন্য বিষয়টা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে।

কতটা বন্ধুর পথ?
আগামী নভেম্বর মাসে আইসিসি চেয়ারম্যান পদে মেয়াদ শেষ হতে চলেছে নিউজিল্যান্ডের গ্রেক বার্কলের। কমনওয়েলথ গেমসের সময় বার্মিংহামে আইসিসির একটি বোর্ড মিটিং হয়েছিল। সেখানে বার্কলে জানিয়েছিলেন, আরও একটা টার্ম অর্থাৎ দু'বছর আইসিসি চেয়ারম্যান পদে থাকতে ইচ্ছুক তিনি। তবে, ভারতীয় বোর্ড সৌরভকে আইসিসি চেয়ারম্যান পদে সমর্থন করলে বার্কলের পক্ষে আরও একটা টার্ম থাকা কঠিন হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, বার্মিংহামের ওই মিটিং-এ আইসিসি নিয়মে একটি রদবদল করেছে বলেও জানা যাচ্ছে। এবার থেকে আইসিসি চেয়ারম্যান হতে গেলে ১৬টির মধ্যে ৯টি ভোট পেলেই হবে এবং ভোট দেবেন আইসিসি-র সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা এবং ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে তাঁর দক্ষতা বর্তমান সময়ের যে-কোনও ক্যান্ডিডেটকেই পিছনে ফেলে দিতে পারে।

এবারে কিন্তু ভারত থেকেই কোনও একজনের আইসিসি চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। তবে এখনও পর্যন্ত সৌরভের আইসিসি-তে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা নেই। এই নাম প্রণয়নের ক্ষেত্রেও কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ সাহায্যর প্রয়োজন হয়। ফলে এর পিছনেও নানা রকমের শর্ত এবং নানা রকমের অংক থাকতেই পারে। ফলে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বসর্বা হয়ে ওঠার রাস্তাটা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য খুব একটা মসৃণ নয়। তবে, মানুষটার নাম সৌরভ। তিনি এর আগেও সমস্ত হিসেব উল্টেপাল্টে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট। হট ফেভারিট ব্রিজেশ প্যাটেলকে সরিয়ে দিয়ে সেই সময় সভাপতি হয়েছিলেন সৌরভ। তাই হিসেব পাল্টে দেওয়াটা সৌরভের কাছে খুব একটা নতুন নয়।

More Articles