মেয়েদের রাতমিছিলে মানবিক মুখের সারি! সাধ্যমতো সাহায্য নিয়ে পাশে অধ্যাপক থেকে অটোচালক
R G Kar Hospital Incident Protest: ১৪ অগস্ট পথে নামছে শহরের মেয়েরা, লড়তে চলেছে আর এক স্বাধীনতার লড়াই। প্রায় সব শ্রেণির, সব স্তরের মানবিক মুখেরা সেই লড়াইয়ে আরও এগিয়ে দিতে চাইছেন মেয়েদের।
আরজি কর মেডিক্য়াল কলেজের ভিতরে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে এক চিকিৎসককে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চার তলার সেমিনার রুম থেকে যার ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধারের পর কলেজের অধ্যক্ষর মুখে ফুটে উঠেছে অবধারিত সেই বুলি! এত রাতে সেমিনার রুমে একা কী করছিলেন ওই চিকিৎসক? অথচ সে রাতে নাইট ডিউটিতেই বহাল ছিলেন ওই চিকিৎসক। বিগত ৩৬ ঘণ্টা টানা ডিউটি করার পর অবসন্ন শরীরটাকে সামান্য জিরোতেই গিয়েছিলেন হয়তো। যৌনহেনস্থা হোক বা ধর্ষণ, ধর্ষকাম 'পুরুষ'টির বিকৃতির থেকেও প্রতিবার বড় হয়ে উঠেছে নির্যাতিতার পোশাক, বেপরোয়া ভাব কিংবা রাতে ঘুরে বেড়ানোর মতো অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্থাই। সমাজ এ ভাবেই অভ্যস্ত হতে শিখিয়েছে আসলে। তাই চোখে ঠুলি পড়ে থাকা সমাজ দেখতে পায় না আপাদমস্তক বোরখা পরা নারীশরীরকেও কীভাবে চোখের দৃষ্টি দিয়ে ধর্ষণ করা যায় প্রতিনিয়ত। আসলে পোশাক, রাতের শহরে একা কিংবা বেপরোয়া ভাব- কোনও কিছু দিয়েই যে এই ধর্ষকামকে রুখে দেওয়া সম্ভব নয়, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে বারংবার। সেই ভাবনার মুখে প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই ১৪ অগস্ট, বুধবার, রাতের শহর দখল করতে নামছেন মেয়েরা।
সেই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে গিয়েছে কলকাতা থেকে মফসসল, জেলায় জেলায়, এমনকী তা ছড়িয়ে গিয়েছে দেশের আনাচেকানাচেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে শত শত পোস্টার। মিছিলে হাঁটার ডাক। রাতের শহরে যে সমান অধিকার মেয়েদেরও, সেই অধিকার ছিনিয়ে নিতেই এদিন রাতে শহরে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে জমায়েত করবেন মেয়েরা। শহরের দু'তিনটি জায়গার কথাই ভাবা হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু সেই আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা শহর এমনকী জেলাতেও। আরজি কর কাণ্ডের পর প্রথম যে পোস্টারটি ছড়িয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়, সেখানে স্বাধীনতা দিবসের আগে, অর্থাৎ ১৪ অগস্ট (বুধবার) রাত ১১টা ৫৫ মিনিট থেকে মেয়েদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো হয়। সোমবার রাত থেকেই তা অন্য মাত্রা পেতে শুরু করে। কার্যত গোটা রাজ্যের মানচিত্র জুড়েই ছড়িয়ে যায় সেই ঢেউ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গের বৃহত্তর কলকাতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা শহর এবং মফসসল সাড়া দিয়েছে সেই আন্দোলনে। বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের মতো করে মহিলারা ওই আন্দোলনে সংহতি জানাচ্ছেন। জমায়েত করতে উদ্যোগী হচ্ছেন।
আরও পড়ুন: নারীসুরক্ষার দাবিতে রাত দখল অভিযানে গোটা বাংলা! দেখে নিন কোথায় কোথায় রাতমিছিল?
কিন্তু এই সব জমায়েত, রাত দখলের ডাকের মধ্যেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যতিক্রমী কিছু পোস্ট, যা চোখ টেনেছে সকলের। ১৯৪৭ সালের এমনই এক ১৪ অগস্টের রাত দেশকে স্বাধীনতার সুঘ্রাণ এনে দিয়েছিল। নিজের অধিকার, সর্বত্র ভয়হীন আশঙ্কাহীন ভাবে বাঁচার স্বাধীনতাটুকু ছিনিয়ে নিতে আরও এক ১৪ অগস্ট রাতে পথে নামছে বাংলা। এই আন্দোলনকে অরাজনৈতিক করার ডাক দিয়েছেন কেউ কেউ, কেউ কেউ চেয়েছেন এই লড়াই হোক শুধু নারীদের। রয়েছে এর ভিন্নমতও। শুধু মেয়েদের রেখে আন্দোলনের পরিসরকে সঙ্কুচিত করতে চাইছেন না অনেকেই। এর মধ্যে থেকেই যাঁরা নেপথ্যে থেকে মেয়েদের স্বাধীনতার পথটুকুকে একটু প্রশস্ত করার উদ্যোগে নেমেছেন, তাঁদের কথাও আজ না বললেই নয়।
পেশায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্য়ালয়ের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ রায়। এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি দিয়েছেন একটি ব্যতিক্রমী বার্তা। জানিয়েছেন, জমায়েত থেকে একটু দূরে ওষুধের দোকানের উল্টোদিকে তিনি গাড়ি নিয়ে হাজির থাকবেন। যদি কাউকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে সে কাজটি দায়িত্বের সঙ্গে করে দেবেন তিনি। তাঁকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বিশ্বজিৎবাবু জানালেন, "সমাজের মধ্যে একটা সহযোগিতার সম্পর্ক তো স্বাভাবিক ভাবেই থাকার কথা। আর তাতে আলাদা করে কোনও কৃতিত্ব রয়েছে বলে মনে হয় না। আসলে সমাজের স্বাভাবিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো হারিয়ে গিয়েছে। সকলে নিজের অবস্থানে থেকে নিজেদের সাধ্যের মধ্যে পরস্পর পরস্পর সাহায্য করি, তবেই বোধহয় পৃথিবীর বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।" তাই তাঁর এই পদক্ষেপকে ব্যতিক্রমী কিছু বলে আলাদা করে দেখছেন না অধ্যাপক।
একই সঙ্গে এই রাতদখলের মিছিল সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, "এ আসলে আমাদের দৃশ্যমানতার প্রসঙ্গ। উনিশ শতকে একজন মেয়ের গাড়ি চালানোকে ভয়ঙ্কর দৃশ্য হিসেবে ধরা হত। আমাদের কায়েমী যে দৃশ্য, তার বাইরে অন্যরকম ছবি হলেই ব্য়ঙ্গের চোখে দেখা বা প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক অভ্য়েসে মেয়েদের বাইরের অধিকার, কাজের অধিকার এগুলোকে অস্বীকার করার একটা জায়গা রয়ে গিয়েছে সমাজে। ক্রমে ক্রমে মেয়েরা এই ভিজিবিলিটি দখল করেছে। রাত্রিবেলা চল্লিশ জন পুরুষ বাইরে থাকেন, সেটা আমাদের চোখ সওয়া। কিন্তু যখনই রাতে দু'জনকে আমরা বাইরে দেখছি, সে দৃশ্যকে অন্যরকম বোধ হয়। সেই জায়গাতেই যেন মেয়েদের একটু বিপন্নতা তৈরি হয়। একটি মেয়েকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, কেন সে এত রাত্তিরে বাইরে? এবং ভিকটিম ব্লেমিংয়ের শুরুটাও কোথাও এখান থেকেই হয়। কার্যত যাদেরকে আমরা নিরাপত্তা দিতে পারছি না, তাঁদের নিয়মের বেড়াজালে ঠেলে দেওয়ার একটা প্রবণতা থেকে যায়। অভিভাবকত্বের নামে, নিরাপত্তার নামে সেই যে নিয়মের বেড়াজালে মেয়েদের ঠেলে দেওয়া, তাকেই সওয়াল করবে এই রাতমিছিল।"
একই ভাবে এদিন কলেজ স্ট্রিটে রাতভর তাঁদের 'বইচাঘর'-টি খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রকাশনা জগতের সুপরিচিত নাম প্রতিক্ষণ। এই প্রকাশনা সংস্থার তরফে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানানো হয়েছে, আন্দোলনকে সংহতি জানাতে এবং রাত জাগা মেয়েদের পাশে থাকতে সারারাত তাঁদের সংস্থার বিপণীটি খুলে রাখা হবে। প্রতিক্ষণের অন্যতম সৈনিক এষা জানালেন, কোনও বিজ্ঞাপন নয়, শুধু রাত জাগা মেয়েদের পাশে থাকতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে সুপরিচিত এই প্রকাশনা সংস্থাটি। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া তাঁদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। বিরুদ্ধমতও যে তৈরি হয়নি, তা নয়। তার পরেও এই যে রাত মিছিলে রাত জাগা মেয়েদের পাশে থাকার ক্ষেত্রে তাঁদের এই চেষ্টা, তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে শহর কলকাতা।
তবে শুধু যে মেধাজীবীদের থেকেই এই উদ্যোগ এসেছে, তা নয়। সোদপুরে অটো চালান দীপঙ্কর সাহা। তিনি নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট লিখে জানিয়েছেন, তিনি সোদপুর ট্র্যাফিক মোড়ের একজন অটোচালক। এ দিন রাতের রাতমিছিলে কারওর যদি যানবাহন পেতে অসুবিধা হয়, তাহলে তাঁকে ফোন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কোনও রকম অর্থবিনিময় ছাড়াই তিনি তাঁদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবেন। কার্যত তাঁর এই পোস্ট দারুণ ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
প্রসঙ্গত আরজি কর হাসপাতালে নির্যাতিত চিকিৎসকের বাড়িও কিন্তু সোদপুরেই। প্রতিবেশী এই কন্যার সুবিচারের আশায় এবং তাঁর মতো পরিণতি যেন আর কারওর না হয়, তার জন্য যে মানবিক দিকটি দেখিয়েছেন এই দীপঙ্করবাবু, তা কার্যত নজিরবিহীন।
আরও পড়ুন:রাত দখলের পর নিরাপদে ঘরে ফিরবেন তো মেয়েরা? থাকছে ওলা, উবের
১৪ অগস্ট পথে নামছে শহরের মেয়েরা, লড়তে চলেছে আর এক স্বাধীনতার লড়াই। প্রায় সব শ্রেণির, সব স্তরের মানবিক মুখেরা সেই লড়াইয়ে আরও এগিয়ে দিতে চাইছেন মেয়েদের। সেই লড়াইয়ে যেমন বিশ্বজিৎবাবুর মতো অধ্যাপকেরা সামিল, তেমন ভাবেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দীপঙ্করবাবুর মতো অটোচালকও। মেয়েদের লড়াই সহজ করতে অতিরিক্ত গাড়ি পথে নামানোর কথা বলেছে ট্যাক্সি সংগঠনগুলো। রাত পর্যন্ত চলবে মেট্রো। কার্যত বলাই যায়, এক নজিরবিহীন রাতের সাক্ষী থাকতে চলেছে ১৪ অগস্টের বাংলা। এই রাত দখলের মিছিল কি আদৌ পারবে মেয়েদের স্বাধীনতার শুভ মহরৎ ঘটাতে। উত্তর মিলবে অচিরেই।