কেন এত কাজ পাগল আমরা!
আমরা আজকাল কি একটু বেশিই কাজ করছি? কাজ না থাকলে খুব ছটফট করছি? কাজের ব্যস্ততাকেই কি আমরা ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি? এই সব প্রশ্নেরই ইতিবাচক উত্তর পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক গবেষণায়। শুধু তাই নয়, গবেষণায় আরো জানা গেছে,একবিংশ শতাব্দীর সমস্ত কর্মক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত কাজের চাপ থেকে যে স্ট্রেস তৈরি হচ্ছে, সেই মাপকাঠিতেই বিচার করে নিচ্ছি আমরা নিজেদের এবং একে অপরের কাজের গুরুত্ব। তাহলে কি সত্যি বলা যায় যে 'আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে' যখন মানুষ কাজের ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিতে, পরিবারকে সময় দিতে বা নিজের শখগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসতো? এখন আরাম করাটাই কি সত্যি হারামরূপে প্রতিপন্ন হয়েছে আমাদের কাছে ? আর তার ফলেই একের পর এক কাজের বোঝা চাপিয়ে নিতে ভালোবাসছি আমরা, সে যতই দিনের শেষে 'বার্নড আউট' বা 'স্ট্রেসড আউট' লাগুক না কেন? দেখা যায়, ২০১৩ সালে পরপর দুটি নির্বাচনের খবর করার দায়িত্বে থাকা মিয়া সাদো নামের একজন জাপানি নিউজ রিপোর্টার অকস্মাৎ মারা যান। জাপানি ভাষায় এই অত্যাধিক কাজের কারণে মৃত্যু কে 'কারসি' বলা হয়। সরকারি তদন্তের পর দেখা গিয়েছে মিয়া সাদো মৃত্যুর আগের এক মাসে প্রায় ১৫৯ ঘন্টা কাজ করেছিলেন। এমনকি তার মৃত্যুর সময়ও মোবাইল ফোনকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে রেখেছিলেন তিনি। অ্যানথ্রোপলজিস্ট জেমস সুজমান তাঁর 'ওয়ার্ক আ হিস্ট্রি অফ হাউ উই স্পেন্ড আওয়ার টাইম' বইতে বলছেন শিল্পায়ন পরবর্তী যুগে আমাদের কাজের সুযোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমাদের প্রত্যেকের অ্যাম্বিশন। যদিও, সৌভাগ্যক্রমে, এখনও অবধি অতিরিক্ত কাজের ফলে মৃত্যুর উদাহরণ পৃথিবীজুড়ে কমই আছে।
গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে যে, যাদের কাজের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে থাকে,তাদেরই কাজের পরিমাণ অত্যাধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। ওয়েব ডিজাইনার পল জার্ভিস তাঁর 'কোম্পানি অব ওয়ান : হোয়াই স্টেয়িং স্মল ইজ দ্য নেক্সট বিগ থিং ফর বিজনেস' বইতে বলেছেন যে ব্যবসা বড় করে লাভ এর আশা না করে বরং ব্যবসা ছোট রেখে বেশি অবসর সময় হাতে রাখা উচিত, যাতে স্ট্রেস কমানো সম্ভব হয়। আমাদের এখনকার সময়ে সমাজে যদিও ‘হাসল এন্ড গ্রো কালচার’-এই মানুষ অভ্যস্ত, তাই মানুষ তাদের ক্ষমতার চেয়ে বেশি কাজ হাতে তুলে নিতে পছন্দ করছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের তুলনায় তথ্যকর্মীদের নিজেদের কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি থাকে। তবুও দেখা যায় এরা খুব ঠিকঠাক নির্ধারিত সময়মতো কাজ করতে চায়না। এরা সবসময়ই অতিরিক্ত ২০% কাজ করতে চায় যাতে তারা ক্লান্ত ও হয়, আবার নিজেদের লক্ষ্যপূরণও করতে পারে। কিন্তু এই অতিরিক্ত ২০% কাজই প্রচুর পরিমাণে স্ট্রেস তৈরি করে। ফাঁকা সময়ে ক্রমাগত কাজের জন্য আসা ই-মেল কখনওই শান্তি দেয় না তাদের মানসিকভাবে।
প্যান্ডেমিকের পর কাজের চাপ ও কাজের ধরন নিয়ে নতুন করে ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছে। যে নতুন কাজের রুটিন ভাবা হচ্ছে ইদানিং, তাতে সপ্তাহে ৪ দিন ১২ ঘন্টা করে কাজ করার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু এই রুটিন কোনওভাবেই বিশেষ ফ্লেক্সিবিলিটি বা মানসিক শান্তির জায়গা তৈরি করতে পারছে না কর্মীদের মধ্যে,তা সাম্প্রতিক কিছু গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে একসঙ্গে সব কাজ কিছু ঘন্টায় করতে হলে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি হচ্ছে কর্মীদের উপর। গবেষকরা আরও বলছেন, কাজের ক্ষেত্রে উৎপাদন আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটা ভারসাম্য তৈরি করা গেলে এই অতিরিক্ত ২০% কাজের চাপ থেকে কর্মীদের মুক্তি দেওয়া যাবে।
এই পরিস্থিতিকে কার্ল মার্ক্স এর ‘কনফ্লিক্ট থিওরি’ সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছে । বর্তমানে মানুষের অতিরিক্ত কাজের প্রবণতা এবং নিজের কর্মক্ষেত্রে উন্নতির উচ্চাশাকে পুঁজিবাদের ফল বলে ব্যাখ্যা করেছে এই তত্ত্ব। এই তত্ত্ব দাবি করে যে, পুঁজিবাদীরা মানুষের শ্রমকে শোষণ করছে। তারা প্রতক্ষ ও পরোক্ষভাবে অত্যাধিক চাপ বাড়িয়ে অথবা এই ওভারওয়ার্কিং এর সংস্কৃতিকে মান্যতা দিয়ে জনপ্রিয় করে তুলতে চাইছে। এর সমাধান হিসেবে মার্ক্স সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের দ্বারা সংগঠিত বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ বদলের কথা ভেবেছেন। এক্ষেত্রে শ্রমিক, কৃষকরা যাদের কাজের নিয়ন্ত্রণ তাদের মালিকদের হাতে রয়েছে, তারা ইউনিয়ন এর মাধ্যমে বা শ্রম আইন বদলের মাধ্যমে কিছুটা সাফল্য পেতে পারে।কিন্তু যাদের কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ তাদের নিজেদের হাতেই রয়েছে সে রকম তথ্যকর্মী বা ছোট ব্যবসায়িক উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে নিজেকে নিজের কাজের চাপ থেকে মুক্তি দিতে হলে তাদের পুঁজিবাদের এই 'বিসি কালচার'কে আগে বুঝতে হবে এবং তারপর আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কাজের চাপ নিজের উপর কমাতে হবে। কাজের জায়গায় মাথার উপর কোনও মালিক না থাকলে, কাজের স্বাধীনতা নিজের কাছে থাকলে সেক্ষেত্রে যদি কোনো সঠিক প্ল্যানিং না থাকে তাহলে সেই কাজের চাপ লাগামছাড়া হয়ে উঠতে বাধ্য । তাই অতিরিক্ত চাপ কমাতে গেলে যুক্তিপূর্ণ ভাবে কোন কাজ নেওয়া উচিত আর কোন কাজ ছাড়া উচিত সেই ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। তথ্যকর্মীরা অর্থাৎ যারা অধ্যাপনা করেন বা মাঝারি মাপের কোনও কার্যনির্বাহী পদে আছেন অথবা যারা ফ্রিল্যান্সিং করেন তাঁদের যেহেতু কোনও সুপারভাইসার থাকেন না, সেইজন্য তাদের উচিত সারাদিনের কাজের একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে নানারকম অনুরোধ, প্রশ্ন, সুযোগ, আমন্ত্রণ ইত্যাদি বেছে নেওয়া । দরকার পড়লে কোনো জুম মিটিংয়ের আমন্ত্রণ ও এক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করতে হতে পারে। এর ফলে হয়তো সহকর্মীরা ক্ষুণ্ণ হবে বা নিজের ভাবমূর্তি খানিক নষ্ট হবে প্রতিষ্ঠানের কাছে, কিন্তু তাতে যদি কাজের চাপ কিছুটা কমে ও তার ফলে নিজের স্ট্রেস কমে, তাহলে সেটুকু ক্ষতি মেনে নেওয়াই মঙ্গল।
কিছু খ্যাতনামা ব্যবসায়ী অন্য একটি গবেষণায় জানিয়েছেন যে, সাধারণত যে সব কাজের মাথার উপর কোনও বস থাকে সেক্ষেত্রে কাজগুলো 'পুশ টু পুল' পদ্ধতিতে চলে। কিন্তু তথ্য বা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে পুশ মেথডে এই সব কাজ হয় অর্থাৎ যখন তোমার কাজ শেষ করতে হবে, তখন তুমি অন্য পুশ করো যাতে সে সেটা শেষ করে। এর ফলে কাজের চাপ বেড়ে যায় অন্যদের ঔপর এবং তারা তখন প্রাধান্য দিতে না পেরে সব কাজ ঘেঁটে ফেলে। এর ফলে, কাজের চাপ অত্যাধিক হয়ে যায়। তাই এর বিকল্প উপায় হল পুল অ্যাপ্রোচ। এই পদ্ধতিতে যে সব কাজ অনেক ব্যক্তির মধ্যে ছড়ানো ছিল, সে সব কাজ একটা কোথাও জমা করে একটি টিম টাস্ক বোর্ড গোছের জিনিস বানিয়ে সেখানে প্রতিটা কাজের বর্তমান অবস্থা আর গুরুত্ব উল্লেখ করে দেওয়া হবে। একজন একটি কাজ শেষ করে অন্য কাজ চেয়ে নেবে। এছাড়া, প্রত্যেকের জন্য কাজের চাপের একটা সঠিক মাত্রা বেঁধে দেওয়া হবে এবং তাকে সেই সীমার মধ্যেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পরপর শেষ করতে হবে। এই পদ্ধতিটি একটি মনস্ত্বাত্তিক পরীক্ষামূলক পদ্ধতি যা এখনও অবধি বেশ কিছু পেশাদারি ক্ষেত্রে দারুণভাবে সুফল দিয়েছে ,আবার কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে।
তাই পরিশেষে বলা যেতে পারে, এই পুঁজিবাদী সমাজের তৈরি করা 'বিসি কালচার'-কে মেনে নিয়ে, শুধুই কাজে মগ্ন থাকাকে উপভোগ না করে, আমাদের যে কিছু অবসর সময়ের প্রয়োজন আছে সামগ্রিক সুস্থতার জন্য,তা আমাদের বুঝতে হবে। আমরা যত এই বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারব, ততো আমরা নিজেদের ওপর কাজের বোঝা কমাতে সচেষ্ট হবো।