ইস্কুলজনিত সমস্যা: একটি ব্যক্তিগত পাঠ
School Teachers: স্কিলড লেবারদের নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ইস্কুলগুলোয় নিজেদের অজান্তেই দিয়ে চলেন শিক্ষকরা
পশ্চিমবঙ্গে সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত বাংলা মাধ্যম ইস্কুল ও স্কুলগুলি যে চূড়ান্ত সংকটের মুখোমুখি তা নিয়ে কোনও সচেতন মানুষের সন্দেহ থাকার কথা নয়। মধ্যবিত্তের সচেতন অংশটি একটা বড় সংখ্যক ইস্কুল উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেই নিজেদের উদ্বেগ সোচ্চারে প্রকাশ করে থাকেন। এই উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ গণতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তবে তেতো সত্যি কথাটিও সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ রয়েছে যাদের পরিবারগুলির সঙ্গে ইস্কুল তো বটেই, বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির সম্পর্কও চুকে গেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই। এই অংশটির পরিধি দিন দিন বাড়ছে। ইস্কুল ও স্কুলের মধ্যে পার্থক্যটি সুস্পষ্ট করি। ইস্কুল নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা একটু কঠিন। তবুও সাধারণীকরণের ঝুঁকি নিয়ে বলা যায়:
১) প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের পড়ুয়ারা পড়তে আসে।
২) পড়ুয়াদের অভিভাবকদের প্রায় কেউই তথাকথিত হোয়াইট কলার জব করেন না।
৩) অঞ্চল ভেদে পড়ুয়াদের বেশিরভাগ হয় পরিবারে শিশু-চাষি হিসেবে শ্রমদান করে, নইলে আংশিক সময়ের শিশু-শ্রমিক হিসেবে পরিবারের রোজগারে সাহায্য করে।
৪) প্রায় প্রতিটি ক্লাসে পারিবারিক ট্রমার শিকার ছাত্রছাত্রী থাকবেই।
৫) প্রায় প্রতিটি ক্লাসে বিশেষ ভাবে সক্ষম শিশুদের চিহ্নিতকরণ করা হবে দু-এক বছর পর।
৬) বোর্ডের পরীক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক রেজাল্ট ধারাবাহিক ভাবে খারাপ হবে অন্তত দুই-তিন দশক ধরে।
৭) পড়ুয়াদের বড় একটা অংশের নামের বানান জন্মের সার্টিফিকেট , প্রাথমিক ইস্কুলের স্কুলত্যাগের সময় দেওয়া শংসাপত্র এবং আধার কার্ডে একেক রকম থাকবে।
৮) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যে অঞ্চলে অবস্থিত সেখানে সাবর্ণ হিন্দু, আশরাফ মুসলমান এদের সংখ্যা হবে চোখে পড়ার মতো কম।
আরও পড়ুন- ভারতে বাড়ছে স্কুলছুট, আসল কারণ কী? ভয়াবহ ইঙ্গিত সমীক্ষায়
যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই বৈশিষ্ট্যগুলি থাকবে না সেগুলি স্কুল। গ্রাম, মফসসল ও শহর দিয়ে স্কুল ও ইস্কুলের ফারাক করা সম্ভবপর নয়। পশ্চিমবাংলার গ্রামে এমন সরকারি বাংলা মাধ্যম প্রাইমারি স্কুল আছে যেখানে প্রায় প্রতিটি ক্লাসই স্মার্ট ক্লাসরুম। পশ্চিমবাংলার শহরে এমন ইস্কুল রয়েছে যেখানে দশকের পর দশক ধরে মাধ্যমিকে পাশের হার পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ায় না। অঞ্চল ভেদে স্কুল ও ইস্কুলের প্রায় ধ্রুবক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় শুধুমাত্র আট নম্বর বৈশিষ্ট্যকে।
ইস্কুলগুলির বৈশিষ্ট্য দেখেই বোঝা সম্ভব যে স্কুলগুলির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বাংলা/হিন্দি/নেপালি মাধ্যম ইস্কুলগুলির সমস্যা ও সংকট ভিন্ন প্রকৃতির। পরিকাঠামোগত সমস্যা এবং শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ার ফলে শিক্ষকের ঘাটতিজনিত সমস্যা স্কুল ও ইস্কুলের ক্ষেত্রে বাইরে থেকে অনেকটা একরকম মনে হতে পারে। তবে একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় যে সমস্যাটা একই অভাব থেকে জন্ম নিলেও, সমস্যাটির প্রকৃতি দুই ক্ষেত্রে দু'রকম রূপ নিচ্ছে। স্কুলের ক্ষেত্রে শিক্ষক ও ছাত্রদের সংস্কৃতি, মনোজগৎ, ব্যক্তি ইচ্ছা ও সামাজিক ইচ্ছার মেলবন্ধন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বোঝাপড়ার দূরত্বে থাকে। ইস্কুলের ক্ষেত্রে এইসব বিষয়ে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের দূরত্ব অনেকটাই বেশি। ফলে বোঝাপড়ার চেয়ে সেখানে একজন শিক্ষক নিজের সমাজের চাওয়াপাওয়া ছাত্রের উপর চাপিয়ে দিতে অতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চাপিয়ে দেওয়ার এই অতি আগ্রহ একজন শিক্ষককে তার নিজের শিক্ষার্থী সত্ত্বাটিকে দ্রুত ভুলিয়ে দেয়। ফলত নামবাচক বিশেষ্যকে যে নিজের ইচ্ছামতো পালটে দেওয়া যায় না, সেই সামান্য জ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই তাদের লুপ্ত হয়। কোনো ছাত্র নিজের জন্মের নথিতে হাছিনা বা আনছারুল নামে নথিভুক্ত হলে ক্লাসের খাতায় 'শুদ্ধ' উচ্চারণ শেখাবার ও 'শুদ্ধ' উচ্চারণে বানান লেখাবার তাগিদে হাসিনা বা আনসারুল করে ফেলেন। ছাত্রটি যতক্ষণ না নিজের নাম হাসিনা বা আনসারুল বলে নিজেই মেনে নেয় ততক্ষণ অব্ধি এই আগ্রাসন বজায় থাকে। বোর্ডের রেজিস্ট্রেশনের সময় জন্ম সার্টিফিকেটের হাছিনা, হাসিনা হয়ে যায়। কপাল আরো খারাপ হলে আধার কার্ডে হাছিনা আরও কোনও অদ্ভুত টাইপো নিয়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। তিন-চারটি নথিতে দু-তিনটি নামে চিহ্নিত হয়ে থাকা যে নাগরিক হিসেবে তাকে বিপন্ন করছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরো বিপন্ন করে তুলবে, এইটা বোঝার আগেই তার তথাকথিত ছাত্রজীবন শেষ হয়ে যায়। এই সমস্যাটি থেকেই বোঝা যায় ইস্কুলের মূল সমস্যা লুকিয়ে রয়েছে পার্থক্যকে বুঝতে না চাওয়ার ঔদ্ধত্যে।
এই ঔদ্ধত্যের হেতুই আমি ক্লাস সিক্সের ছাত্র আবু বাঁকি মহম্মদের বাপকে কোন এক পাটভাপা শ্রাবণের দুপুরে ঝাঁঝিয়ে উঠি, 'কী খারিজি মাদ্রাসা চালান! নিজের ছেলেকে তো সরকারি ইস্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছেন বুদ্ধি করেই। এতিমগুলাকে আল্লাহের ভরসায় নিজের মাদ্রাসাতেই রেখে দিলেন!' আবু বাঁকি মহম্মদ এই বয়সেই সাংঘাতিক স্কিলড। তিস্তার চরে গত শীতে মটরশুঁটি বুনেছে। ভরা বর্ষায় উজানেও নৌকা বাইতে পারে। দেড় থেকে দুই মিনিটে টাই-এর নট বাঁধতে পারে এবং টিনের চাল থেকে নেমে আসা গরমের ভাপে যখন গোটা ক্লাসের ছাত্ররা জামার এক আধটা বোতাম খুলেও হাঁসফাঁস করে, সে টাই'কে সামান্য আলগাও করে না। তার চেহারা বয়সের তুলনায় বড়সড় হওয়ায় তার স্কুলড্রেস নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকে। আবু বাঁকি'কে যেন উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের পোশাক দিয়ে সমস্যার সুরাহা করা হয় এই নিয়ে তদ্বির করতে তার আব্বা বেশ কয়েকবার ইস্কুলে আসে। প্রতিবার একই পোষাকে। লম্বা ঝুলের কলারওয়ালা উজ্জ্বল সবুজ রঙের পাঞ্জাবি , সাদা আলিগড়ি পাজামা আর মাথায় সাদার উপর নীল সুতার কাজ করা ওমানি টুপি। একটা খারিজি মাদ্রাসায় বাচ্চাদের দেখভাল করেন। নিজের ছেলের জন্য ভালোটা ঠিক বুঝেছেন মনে করে আমার মেজাজ ও গলার স্বর খানিক চড়ে। ভীতু গলায় আবু বাঁকি মহম্মদের বাপ জানান যে তারও একদম ভালো লাগে না খারিজি মাদ্রাসার এতিমগুলোর দেখভাল করতে, সরকার যদি শুধু মিড-ডে মিল না দিয়ে এতিমগুলার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতো তাহলে বেশিরভাগ খারিজি মাদ্রাসা উবে যেত। আমার ঔদ্ধত্য বাধ্য হয় জীবনের মূল সুরটির কাছে মাথা নোয়াতে।
মাথা নোয়ানোর পর আমি বুঝতে পারি ইস্কুলগুলিতে যারা পড়তে আসে শ্রেণি হিসেবে তাদের সামাজিক গতিশীলতার প্রকৃতি অনেকটাই আলাদা। হোয়াইট কলার পেশাকে মুক্তির পথ হিসেবে ধরার সীমাবদ্ধতা এখানে নেই। এখানে যারা হোয়াইট কলার পেশার পড়াশোনার দিকেই একমাত্র ঝুঁকে তারা ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের এতটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে যে সে এই সমাজের অংশই থাকে না কিছুদিন পর। বাকিরা কাজ শেখে, কাজ করে এবং কামায়। এই কাজ শেখায় তাকে নিশ্চিত ভাবেই ইস্কুলের পড়াশোনা কোনো সাহায্যই করে না। এই কাজ শেখায় সে তার প্রাক-ঔপনিবেশিক কারিগরি সত্তার অবচেতনের সাহায্য পায়। তাকে সাহায্য করে তার অতিসচেতন এই বোধ যে কাজ না শিখলে পয়সা আসবে না। সে পয়সার জন্যই কাজ শেখে। হোয়াইট কলারের সোশাল স্টাটাস, হেজেমনি, কালচারাল ক্যাপিটাল ইত্যাদির পরিধির বাইরে নিজেকে আঁটিয়ে নেয় সে। ফলে সরকারের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবিশ্বাস্য খরচ বৃদ্ধি, সরকারি নীতির ফলে হোয়াইট কলার পেশার ক্রমসংকোচন এগুলি কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না তার জীবনে। ইস্কুলের কি কোনো গুরুত্বই তার জীবনে নেই? শুধু কি সে মিড-ডে মিল খেতে আর কিছু টাকা স্কলারশিপে পেতে ইস্কুলে আসে? মধ্যবিত্ত শিক্ষকদের একটা বড় অংশ এই প্রশ্নের উত্তরে সোচ্চারিত বা মৌনভাবে সম্মতি জানাবেন।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান: এক নতুন ভোরের সূর্যোদয়
এখানেই মানসিক দূরত্বটি আবার প্রকট হয়ে ওঠে। ভারতে স্কিলড লেবারদের বিশাল একটা অংশ পশ্চিমবাংলার ইস্কুলগুলির ছাত্র। ভারতের অর্থনীতিতে এদের অবদান অনস্বীকার্য। এই স্কিলড লেবারদের নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ইস্কুলগুলোয় নিজেদের অজান্তেই দিয়ে চলেন শিক্ষকরা। তারা যদি সচেতন ভাবে কাজটি করেন তাহলে আরো বেশি ফলপ্রসূ হবে সেই শিক্ষা। বোর্ডের বইগুলোতে শিক্ষকদের জন্য যে নির্দেশাবলী দেওয়া রয়েছে সেখানে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা রয়েছে ছাত্রের 'লিভড এক্সপেরিয়েন্স'কে গুরুত্ব দিয়ে পড়াতে। শিক্ষককে ভাবতে হবেই কী করে তিনি 'লিভড এক্সপেরিয়ন্স'-এর বদলে যাওয়া প্রেক্ষিত অনুযায়ী নিজের পাঠ'কে পাল্টাবেন। তাকে ভাবতে হবে কীভাবে তিনি তার ছাত্রকে একইসঙ্গে আইডেন্টিটি সম্পর্কে সচেতন ও আইডেন্টিটির সীমাবদ্ধতা নিয়ে সতর্ক করে তুলবেন। এইগুলো পাঠক্রম মেনেই করা যায়, আলাদা করে বলারই প্রয়োজন হয় না।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ক্লাস সেভেনের ইংরেজি বইয়ে জগদীশ চন্দ্র বোসের যে লেখাটি রয়েছে সেখানে স্পষ্ট ভাবে লেখা রয়েছে বাঙালি বর্ণহিন্দু সমাজে 'লোয়ার কাস্ট'কে 'ক্রিচার' হিসাবে দেখার প্রবণতার কথা। এই তথাকথিত 'ক্রিচার'রা কী করে কিশোর জগদীশের কাছে নদী, পাখি, গাছেদের একটা আলাদা জগৎ খুলে দিয়েছিল সে কথাও রয়েছে। এমন লেখা থেকে ইস্কুলের ছাত্রকে 'বহুজন' ও 'বহুজন' পরিসরের সঙ্গে প্রকৃতির যে অ-ধনতান্ত্রিক সম্পর্ক তা নিয়ে অবহিত করে তোলা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। নিজের রাজনৈতিক পরিসর সম্পর্কে সচেতন হলে তার কাজের জায়গাতেও সে নিজের অধিকার সম্পর্কে আরো সোচ্চার হবে। ইস্কুলের ছাত্রকে তার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাটুকু দেওয়া ও রাজনৈতিক ভাবে নিজের সম্পর্কে সচেতন করে তোলা ছাড়া ইস্কুলের শিক্ষকদের কোনো ভূমিকা থাকার প্রয়োজনই নেই। এর বাইরে গিয়ে যা কিছু করা হবে সেটাই আগ্রাসন। আর আগ্রাসন কখনই শিক্ষার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না।