বিখ্যাত সংস্থায় মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপে যুবতীর মৃত্যু! কেন তদন্তে নামল কেন্দ্র?
Anna Sebastian Perayil Death Overwork: কাজের চাপে আনা সেবাস্তিয়ান পেরাইলের মৃত্যুর অভিযোগ আসার পর কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক জানিয়েছে, যে পরিস্থিতির কারণে মৃত্যু হয়েছে তার তদন্ত হবে
৮ ঘণ্টার কাজের দাবি আর কেউই বোধহয় করেন না। অন্তত বেসরকারি প্রতি ক্ষেত্রেই ৯ থেকে ১৪ ঘণ্টার কাজ করতে বাধ্য হন কর্মচারীরা। প্রবল চাপের মধ্যে, একা হয়ে যেতে যেতে, সমস্ত আনন্দ-উদযাপন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে তারা কাজ করে যান। সবক্ষেত্রে আহামরি পারিশ্রমিকও নেই, কিন্তু চাকরি গেলে অন্য চাকরি না পাওয়ার অনিশ্চয়তা আছে ভরপুর। ফলে নিজেকে নিংড়ে-ছিবড়ে করে শরীর মাথা খাটিয়ে চলেন মানুষ। মস্তিষ্ক মারা যায়, একদিন প্রাণও উধাও হয়ে যায়। এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে সদ্য চাকরি করতে আসা যুবতীর সঙ্গে। অভিযোগ, প্রবল কাজের চাপেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর! আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং ইন্ডিয়ার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন বছর ২৬-এর যুবতী। বিখ্যাত সংস্থায় কাজের গর্বও ছিল পরিবারের। অথচ কাজের প্রবল চাপে যোগ দেওয়ার কয়েকমাসের মধ্যেই মৃত্যু হলো স্বপ্নদর্শী সেই যুবতীর। কাজের চাপে আনা সেবাস্তিয়ান পেরাইলের মৃত্যুর অভিযোগ আসার পর কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক জানিয়েছে, যে পরিস্থিতির কারণে মৃত্যু হয়েছে তার তদন্ত হবে।
আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান রাজীব মেমানিকে চিঠি লিখেছিলেন, আন্নার মা অনিতা অগাস্টিন। তিনি লিখে জানিয়েছিলেন, তাঁর মেয়ে কোম্পানিতে যোগদানের মাত্র চার মাস পরেই মারা গেছেন। কাজের সংস্কৃতি পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন অনিতা। মৃত কন্যার মা বলছেন, অতিরিক্ত কাজ করাকে এই সমস্ত অফিসে খুব বড় করে দেখা হয়, খুব গৌরবের ভাবা হয়। অথচ এই ব্যাপক পরিশ্রমের নেপথ্যে থাকা মানুষটির ভূমিকাকেই অবহেলা করা হয়।
আরও পড়ুন- রাতের পর রাত ঘুম নেই! কেমন জীবন বাঁচেন রেলচালকেরা?
অনিতা অগাস্টিন লিখছেন, "আমি এই চিঠিটি একজন শোকার্ত মা হিসাবে লিখছি। আমি নিজের আদরের সন্তান, আনা সেবাস্টিয়ান পেরাইলকে হারিয়েছি। আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত। এই শব্দগুলি লিখতে লিখতে আমার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তবু আমি বিশ্বাস করি, এই গল্পটি শেয়ার করা প্রয়োজন যাতে আমরা যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তা অন্য কোনও পরিবারকে যেন সহ্য করতে না হয়।”
মা লিখছেন, আন্না এক চমৎকার ছাত্রী ছিলেন। স্কুল ও কলেজে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। কঠিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পরীক্ষায় ডিস্টিংশন পেয়ে পাশ করেছিলেন। আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং ইন্ডিয়াই ছিল মেয়ের প্রথম চাকরি। এমন বিখ্যাত কোম্পানির অংশ হতে পেরে গর্ব ছিল তাঁর। "কিন্তু চার মাস পরে, ২০২৪ সালের ২০ জুলাই যখন আমি খবর পেলাম যে আন্না মারা গেছে তখন আমার পৃথিবীটাই ভেঙে যায়। ওর বয়স মাত্র ২৬ বছর," লিখেছেন কন্যাহারা মা।
"শনিবার, ৬ জুলাই, আমার স্বামী এবং আমি আন্নার সিএ সমাবর্তনে যোগ দিতে পুনে পৌঁছেছিলাম। রাতে পিজিতে পৌঁছনোর পর থেকেই ও জানায় গত এক সপ্তাহ ধরে বুকে ব্যথা করছে। আমরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পুনেতে ইসিজি স্বাভাবিকই আসে। কার্ডিওলজিস্ট আমাদের আশঙ্কা কমাতে বলেন মেয়ের পর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে না, অনেক দেরি করে খাচ্ছে, সেই সবেরই প্রভাব পড়েছে। ডাক্তার আমাদের আশ্বস্ত করেন সমস্যা গুরুতর কিছু নয়, অ্যান্টাসিড লিখে দেন। আমরা সেই কোচি থেকে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আসি। ডাক্তার দেখানোর পরেই মেয়ে বলেছিল, পরদিন অফিসে যাবে, যেতেই হবে কারণ অনেক কাজ বাকি আছে এবং রাতে ছুটি পাবে না। রবিবার আবারও দেরি করে বাড়ি ফেরে মেয়ে। ৭ জুলাই সমাবর্তনের দিন, সকালে আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল কিন্তু সেদিনও বিকাল পর্যন্ত বাড়ি থেকেই কাজ করেছিল। আমরাও দেরিতেই সমাবর্তনস্থলে পৌঁছেছিলাম," লিখছেন অনিতা অগাস্টিন।
আরও পড়ুন- ৭০ ঘণ্টা কাজের দাবি সত্যিই ন্যায্য? কতক্ষণ কাজ করেন এলন মাস্ক, সুন্দর পিচাইরা?
অনিতা আরও লিখেছেন, "আমার মেয়ের স্বপ্ন ছিল নিজের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে বাবা-মাকে নিজের সমাবর্তনে নিয়ে যাবে। মেয়েই আমাদের ফ্লাইটের টিকিট বুক করে দেয়। এসব বলতে বুক ফেটে যাচ্ছে, তবু বলি, শেষ যে দু'দিন আমরা ওর সঙ্গে কাটাই, সেই দুই দিনও ও কাজের চাপের জন্য উপভোগ করতে পারেনি।" অনিতা জানিয়েছেন, আনা গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন, এমনকি সপ্তাহান্তেও! নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগও পাননি, "মেয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার একবার রাতে ফোন করে একটা কাজ করতে বলেন যেটা সকালের মধ্যে জমা দিতে হবে। বিশ্রাম নেই, ঘুম নেই! যখন এই অসুবিধা নিয়ে মেয়ে কথা বলতে যায় তখন বলা হয়, 'তুমি রাতে কাজ করতে পারো, আমরা সবাই তাই করি'।"
"আনা একেবারে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে ঘরে ফিরত, কখনও কখনও জামাকাপড় না বদলেই শুয়ে পরত। খালি ফোন মেসেজে আরও রিপোর্টের চাপ দিত। মেয়ে সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে গেছে ডেডলাইন পূরণের জন্য। খুব কঠোর পরিশ্রম করেছে। আমরা বলেছিলাম এই কাজ ছেড়ে দিতে কিন্তু ও শিখতে চেয়েছিল, নতুন এক্সপোজার চেয়েছিল,” লিখছেন আন্নার মা। আন্নার পরিবার আরও জানিয়েছে, তারা গভীরভাবে আহত হয়েছেন কারণ অফিসের কেউই আন্নার শেষকৃত্যেও যোগ দেননি।
আন্নার মৃত্যু এবং কাজের চাপে মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পরে আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং ইন্ডিয়া একটি বিবৃতি জারি করে বলেছে যে আন্নার মৃত্যুতে সংস্থা গভীরভাবে শোকাহত। কাজের চাপের অভিযোগ ওঠার পর সংস্থা জানিয়েছে, "আমরা সমস্ত কর্মচারীদের ভালো থাকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই। সারা ভারতে আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং ইন্ডিয়ার যে ১ লক্ষ কর্মী আছেন, কীভাবে তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র তৈরি করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করব আমরা।"