নেই নিজস্ব রোজগার! সংসারেই সময় কেটে যায় বেশিরভাগ ভারতীয় মহিলার

ভারতীয় নাগরিক মহিলাদের ভেতর অনেকেই করোনা পরিস্থিতিতে জীবিকা খুইয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারি তথ্য অনুসারে, করোনা পরিস্থিতিতে কাজের বাজারে থাকা মহিলাদের হার রেকর্ড সংখ্যক কমেছে।

 

প্রজন্মের পর প্রজন্ম মেয়েরা কি কেবল ঘরসংসারই সামলাবেন? অর্থোপার্জন করার অধিকার কি নারীর জন্য নয়, তা কেবল পুরুষের অধিকার? এই নিয়ে ভারতীয় সমাজে বিতর্ক রয়েছে। এই বিতর্ক প্রসঙ্গে স্মরণীয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-র প্রধান মোহন ভাগবতের মন্তব্য। মোহন ভাগবত বলেছেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক চুক্তিভিত্তিক। সেই অনুযায়ী স্বামীর কর্তব্য হলো, বহির্জগতে কাজ করে অর্থোপার্জন করা। আর স্ত্রীর প্রধান কাজ ঘরদোর সামলানো। যতদিন পর্যন্ত সংসার এই নীতিতে চলবে, ঠিক ততদিনই সংসারে দাম্পত্য সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় থাকবে। সংসারটা ভেঙে যেতেই পারে যদি নারী এই চুক্তির খেলাপ করে।

সংঘপ্রধান মোহন ভাগবত দাম্পত্যজীবনের দায়বদ্ধতা চাপিয়ে দিয়েছেন মেয়েদের জীবনকে চুক্তিসাপেক্ষ করে। পুরুষের বশ্য হয়েই নারীকে জীবন কাটাতে হবে। মূলত স্ত্রীরই কর্তব্য স্বামীর কাছে নিজের আনুগত্য প্রমাণ করাটা। এই প্রসঙ্গে মোহন ভাগবত এড়িয়ে গিয়েছেন শুধুমাত্র অর্থোপার্জন করাই দাম্পত্যজীবনে পুরুষের প্রধান কর্তব্য হতে পারে। এমনকী, মানবজীবনেও নয়। সম্পর্কজনিত দায়বদ্ধতা বজায় রাখার দায় পুরুষেরও।

বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির যুগে স্ত্রীর ভরণপোষণ করা ছাড়া সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা চালানো পুরুষেরও কর্তব্য। যেহেতু নারী-পুরুষের সুস্থ সম্পর্ক আসলে পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। যদিও রক্ষণশীল ধ্যানধারণা ভারতীয় সমাজে শিকড় গেড়ে রয়েছে শত শত বছর। 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া'-র যুগেও মান্ধাতার আমলের সেইসব ধ্যানধারণাগুলির পরিবর্তন হয়নি।

আরও পড়ুন: সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার মাশুল! জাফর পানাহির গ্রেপ্তারি নিয়ে উত্তাল বিশ্ব

ভারতীয় নাগরিক নারীসমাজ উপার্জন হতে পারে এমন পেশাদারি কাজকর্ম করার সুযোগ পান পুরুষের তুলনায় অনেক কম ক্ষেত্রেই। কারণ কাজের বাজারে প্রকট লিঙ্গবৈষম্য। অন্যতম একটি দেশ ভারত, যে দেশে কাজের বাজারে নারীসমাজের যোগদানের হার দুনিয়ার অন্য দেশগুলির তুলনায় উদ্বেগজনক হারে কম। সমীক্ষা অনুযায়ী, এই হার মোটে ২১ শতাংশ। ১৫ বছর অথবা তার চেয়ে বেশি বয়সের মেয়েরা লিঙ্গবৈষম্য প্রকট হওয়ায় বঞ্চিত কাজের বাজারের সুযোগ থেকে। হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে কিংবা বহু মেয়ে বর্হিজগতে কাজের যোগদানের ক্ষেত্রে পারিবারের আপত্তি মেনে নিয়েছেন। এক শ্রেণির মহিলা গৃহবধূ হিসেবে পতিসেবা এবং সন্তান প্রতিপালনের গণ্ডিতেই জীবনে আবদ্ধ।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, শতাংশের হিসেবে ভারতীয় নাগরিক ৭৯ শতাংশ মহিলার নিজস্ব কোনও রোজগার নেই। ভরণপোষণের ভার পরিবারের পুরুষ সদস্যর কাঁধে। অস্বাভাবিক হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে একার রোজগারে সংসার চালানো অধিকাংশ পুরুষের পক্ষেই দুশ্চিন্তার বিষয়। এদিকে বেসরকারি সংস্থাগুলিতে কর্মরতদের জীবনে আচমকা চাকরি চলে যাওয়া ঘটনা ২০২০ সালে করোনা হানা দেওয়ার পরে বেড়েছে। বহু কর্মী আচমকা চাকরি হারিয়ে এখনও বেকার।

প্রতিবেশী দেশ চিন, বাংলাদেশেও কাজের বাজারে যোগদানকারী মহিলার সংখ্যা ভারতের চেয়ে তুলনায় বেশি। এক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে যে দেশগুলির নারীসমাজ, সেই তালিকায় ওপরের দিকে নাম রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের। বেসরকারি সমীক্ষা অনুসারে, এই দেশগুলিতে ভারতের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি কর্মরত মহিলা রয়েছেন, যাঁদের মাসিক উপার্জন রয়েছে।

গোটা পৃথিবীতে কাজের বাজারে মহিলাদের যোগদানের হার যেখানে ৪৭ শতাংশ, এই সংখ্যাটা ভারতে অর্ধেকের কম। এই ব্যাপারে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অশ্বিনী দেশপাণ্ডে বলেছেন, "গোটা দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে প্রচুর মহিলাই লিঙ্গবৈষম্যের শিকার। দক্ষিণ এশিয়ার নারীসমাজ দু'টি ভাগে বিভক্ত। একাংশ কাজের বাজারে অংশগ্রহণকারী, উপার্জনক্ষম। আর আরেক অংশ কাজের বাজার থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন। পরিবারের পুরুষ সদস্যের রোজগারের মুখাপেক্ষী ওঁরা।"

এই মহিলাদের একাংশ সংসারের খাটুনি সামলে বয়নশিল্পে, মৃৎশিল্পে পরিবারের পুরুষ সদস্যকে সহায়তা করলেও তাঁরা বিনা মজুরিতে কাজ করছেন। মহিলাদের বেকার শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ ভারতে বেশি।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির সমীক্ষায় প্রকাশ, তবে শিক্ষালাভের সুযোগে পুরুষের তুলনায় এগিয়ে মেয়েরা। এসত্ত্বেও কাজের বাজারে মেয়েদের প্রবেশাধিকার মোটে ২১ শতাংশ। এই সম্পর্কে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভারতজুড়ে কৃষিক্ষেত্রে মজুর হিসেবে নারী-পুরুষ দু'তরফেরই কাজের সুযোগ কমেছে। পুরুষরা ট্রাকচালক, মিস্ত্রির মতো অন্যান্য তথাকথিত পুরুষালি পেশা বেছে নিলেও মহিলাদের ক্ষেত্রে কাজের বাজারে তেমন কোনও বিকল্পও নেই।

ভারতে নারীসমাজ শুধু কাজের বাজার থেকেই বঞ্চিত নয়, এর পাশাপাশি ব্যাপক যৌন নির্যাতনের শিকার। গোটা দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই নারীর জীবনে এই পরিস্থিতি। নারীসমাজ ব্যাপক হারে যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম এবং কাম্বোডিয়াতেও। এমনকী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও প্রতি ১ মিনিট অন্তর কোনও না কোনও মহিলা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কর্মরত কিংবা কর্মরত নন, দুই ক্ষেত্রেই এই অসহায় পরিস্থিতির শিকার মেয়েরা।

ভারতীয় নাগরিক মহিলাদের ভেতর অনেকেই করোনা পরিস্থিতিতে জীবিকা খুইয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারি তথ্য অনুসারে, করোনা পরিস্থিতিতে কাজের বাজারে থাকা মহিলাদের হার রেকর্ড সংখ্যক কমেছে। তবে করোনা ভারতে হানা দেওয়ার আগেও কাজের বাজারে মহিলাদের সুযোগ ছিল কম। বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, দুনিয়ার যে দেশগুলিতে কাজের বাজারে মহিলাদের যোগদানের হার অত্যন্ত কম সেই দেশগুলির তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে ভারতের নাম । বছরের পর বছর ধরেই একই অবস্থা। এ-সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাঙ্ক যে পরিসংখ্যান পেশ করেছে, তাতে এও দেখা যাচ্ছে, ভারতে যে মহিলারা কাজের বাজারে আছেন এঁদের মধ্যে অধিকাংশই আবার অদক্ষ কর্মী অথবা শ্রমিক।

পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে অনুসারে, যে মহিলারা বাজারে কর্মরত, তাঁদের মধ্যে ৮৮ শতাংশই বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত। এছাড়া একই কাজে নিযুক্ত পুরুষ কর্মীর তুলনায় মহিলা কর্মীদের মজুরিও কম। শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত মহিলাদের দৈনিক অন্তত ১১ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হচ্ছে জীবিকার তাগিদে। এঁদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মহিলাই সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীবাদী গবেষক লুইস থম্পসন প্যাটারসন কাজের বাজারে কর্মরত মহিলাদের সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারতে যে মহিলারা নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হচ্ছেন, এঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তফশিলি জাতি-উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায় অথবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।

More Articles