মহিলা কুস্তিগীরদের দিনের পর দিন যৌন হেনস্থার অভিযোগ! কে এই বিজেপির বাহুবলী ব্রিজ ভূষণ?

WFI Chief Brij Bhushan Singh: কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগাট দাবি করেছেন, তিনি ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের আচরণ সম্পর্কে সবটা বলেছিলেন।

বয়স ৬৬। ছয়বারের সাংসদ। ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান। নিজের যৌবনে ছিলেন কুস্তিগীর। সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি। তারপর থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতির আঙিনাতেই তাঁর মল্লযুদ্ধ। অভিযোগ, দেশের শাসকদলের নেতা এই প্রাক্তন কুস্তিগীর, দিনের পর দিন ধরে দেশের কুস্তিগীর মহিলাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করে গিয়েছেন নিজের পদাধিকার বলে। বিজেপির সাংসদ এবং রেসলিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার (ডব্লিউএফআই) প্রধান ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন মহিলা কুস্তিগীর যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন। অবস্থা এতটাই আতঙ্কের ও অসহনীয় যে তারা সকলে বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন এবং দেশের একদা গর্ব এই কুস্তিগীরদের উপরই চলেছে শাসকের অত্যাচার! জানুয়ারি এবং এপ্রিল মাসে ভিনেশ ফোগাট এবং সাক্ষী মালিক সহ ভারতের শীর্ষস্থানীয় কুস্তিগীরদের প্রতিবাদে এখন সারা দেশ জুড়েই উত্তাল অবস্থা। ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং বলছেন, এসব যৌন হেনস্থার অভিযোগ আসলে স্রেফ 'রাজনৈতিক প্রতিহিংসা'। কেন হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রে এই বিজেপি নেতা, ব্রিজ ভূষণ আসলে কে?

WFI প্রধানকে গেরুয়া দলের বাহুবলী নেতা বলা যায়। উত্তরপ্রদেশে ব্রিজ ভূষণের জনপ্রিয়তা অকল্পনীয়। বির্জ ভূষণ শরণ সিং ছয়বারের সাংসদ - পাঁচবার বিজেপির হয়ে এবং একবার (২০০৯ সালে) সমাজবাদী পার্টির (এসপি) হয়ে। গোন্ডা, কায়সারগঞ্জ ও বলরামপুর আসনের সাংসদ হয়েছেন তিনি। গোন্ডা, বলরামপুর, অযোধ্যা সহ উত্তরপ্রদেশের অনেক জেলায় তাঁর দাপট চোখে পড়ার মতো।

উত্তর প্রদেশের গোন্ডা জেলার বাসিন্দা ব্রিজ ভূষণ নিজেও এককালে কুস্তিগীর ছিলেন। ১৯৮০-র দশকে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। অযোধ্যায় রাম মন্দির আন্দোলনের সময় ব্রিজ ভূষণ প্রথম নিজের জ্বালাময় 'হিন্দুত্ব ইমেজ' সামনে নিয়ে এসে নজরে আসেন।

আরও পড়ুন- ২০২৪ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বনাম কে? এখন থেকেই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় বিজেপি বিরোধীরা

ব্রিজ ভূষণ সিং প্রথমবার নির্বাচনে লড়েন ১৯৯১ সালে। দশম লোকসভায় নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে লোকসভায় পুনঃনির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কায়সারগঞ্জ আসনে জয়লাভ করেন ব্রিজ ভূষণ। তখন তিনি সমাজবাদী পার্টির হয়েই লড়েছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যোগ দেন ব্রিজ ভূষণ এবং ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে বিজেপির টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে লোকসভায় নির্বাচিত হন। ব্রিজ ভূষণের ছেলে প্রতীক ভূষণও রাজনীতিতেই যোগ দিয়েছেন এবং তিনি গোন্ডার বিজেপি বিধায়ক।

ব্রিজ ভূষণ সিং ও বিজেপি

ব্রিজ ভূষণ সিং আর ভারতীয় জনতা পার্টির ভাব ভালোবাসা দীর্ঘদিনের। মাঝে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে তাঁর জুড়ে যাওয়াকে প্রায় বিপর্যয়ই বলা যায়। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন ব্রিজ ভূষণ, বাবরি ধ্বংসের মামলাতেও তাঁর নাম ছিল।

১৯৯৬ সালে, গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে টাডা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরে ব্রিজ ভূষণ সিংকে নির্বাচনের টিকিট না দেওয়া হলে তাঁর স্ত্রী কেকতী দেবীকে গোন্ডা থেকে বিজেপির প্রার্থী করা হয়। তিনি নির্বাচনে জিতেও যান।

নির্বাচনে জেতা ব্রিজ ভূষণের কাছে জলভাত। অযোধ্যা থেকে শ্রাবস্তী পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৫০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ব্রিজ ভূষণ সিংয়ের হাতের মুঠোয়। বিজেপির অন্দরের খবর, ব্রিজ ভূষণ সিংয়ের নির্বাচনী কৌশল কী, ব্রিজ ভূষণ কী করবেন, কীভাবে করবেন এই নিয়ে বিজেপি মাথা ঘামায় না। ব্রিজ ভূষণ এসব সিদ্ধান্ত নেন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। বিজেপি জানে ব্রিজ ভূষণকে তাদের দরকার, ব্রিজ ভূষণও জানেন বিজেপিকে তাঁর দরকার।

তবে বিজেপির সঙ্গে ব্রিজ ভূষণ সিংয়ের সম্পর্ক বর্তমানে কিছুটা টলোমলো। দলের হাইকমান্ড নাকি কুস্তিগীরদের এই প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রিজ ভূষণের ভিলেন হয়ে ওঠাকে ভালো চোখে দেখছে না। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও আজকাল ব্রিজ ভূষণ সিংকে এড়িয়ে চলতেই দেখা যায়। যদিও, এসব গা বাঁচিয়ে চলা যে আসলে বালখিল্যতা তা প্রমাণ করে দেয় দলের অবস্থান। বিজেপি এখনও ব্রিজ ভূষণ সিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তবে বিজেপি এই বিতর্ককে কীভাবে ধামাচাপা দেয় তা দেখার, কারণ লোকসভা নির্বাচন প্রায় সমাগত।

ব্রিজ ভূষণ সিংয়ের অন্যান্য বিতর্ক

বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন ব্রিজ ভূষণ। তবে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে এই বিজেপি সাংসদকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

রাজ ঠাকরে অযোধ্যায় ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁকে 'সবক' শেখানোর হুমকি দিয়েছিলেন ব্রিজ ভূষণ।

আর এখন খোদ WFI প্রধান ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগাট দাবি করেছেন যে, তিনি ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের আচরণ সম্পর্কে সবটা বলেছিলেন। অর্থাৎ খোদ প্রধানমন্ত্রী সব জেনেও কিচ্ছু করলেন না?

জানুয়ারিতে যখন প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়, তখন বিজেপি বিষয়টি নিয়ে সামান্য নড়ে বসে। ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে দলের মধ্যেই 'বহিরাগত' করে তোলা হয়। বারবার সামনে আনা হয় যে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ আর বাবা রামদেবের সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠতা নেই তাঁর। জানুয়ারিতে, কুস্তিগীরদের সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয় যে সমস্যার সমাধান করা হবে। আন্দোলনকারী কুস্তিগীররা সরে দাঁড়ান। কিন্তু জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে এমন কী ঘটল ফের?

আরও পড়ুন- একমাত্র এই চালেই পরাজিত হতে পারে বিজেপি, যে উপায় বাতলে দিলেন প্রশান্ত কিশোর

বিজেপি সম্ভবত ভাবেওনি যে কুস্তিগীররা ফের প্রতিবাদে নামবেন নতুন উদ্যমে। জানুয়ারির তুলনায় এপ্রিলের তাঁদের এই প্রতিবাদে বিরোধী দলগুলিও নেমে পড়ে সমর্থনে এবং কুস্তিগীরদের প্রতিবাদ ধীরে ধীরে 'রাজনৈতিক হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতা সেখানে গিয়েছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল থেকে শুরু করে কংগ্রেস নেতা প্রিয়াঙ্কা গান্ধি বঢরা, আরএলডি প্রধান জয়ন্ত চৌধুরী, প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক এবং সিপিআই-এম নেত্রী বৃন্দা কারাতকে দেখা গিয়েছে কুস্তিগীরদের পাশে।

বিজেপি এই বিক্ষোভকে 'বিরোধীদের ষড়যন্ত্র' বলে চালিয়ে দেওয়া চেষ্টা করলেও এই ইস্যুটি আরও গভীরে যেতে থাকে। দিল্লি পুলিশ ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে দু'টি এফআইআর দায়ের করে। এবার জোড়া বিপাকে পড়তে থাকে বিজেপি। একদিকে এই ইস্যুর ক্রমে রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠা অন্য দিকে ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের জেদ। জানুয়ারিতেই ব্রিজ ভূষণকে পদ থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয় বিজেপি কিন্তু ব্রিজ ভূষণ মনে করেন পদত্যাগ করলে অপরাধ স্বীকার করা হবে।

বিষয়গুলিকে আরও জটিল হয়ে উঠছে জাতপাতের নিরিখে। ব্রিজ ভূষণের সমর্থকরা বলছেন, পুরো বিষয়টিই হরিয়ানার জাটদের কৌশল। জাটরা কুস্তি ফেডারেশন দখল করার জন্যই এই বিতর্কের ধুয়ো তুলেছে। যেহেতু ব্রিজ ভূষণ অন্য রাজ্যের প্রতিনিধি তাই তাঁর বিরুদ্ধে 'জাট লবি' কাজ করছে।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রতিবাদে নেতৃত্বদানকারী অনেক কুস্তিগীরই - ভিনেশ ফোগাট, সাক্ষী মালিক এবং বজরং পুনিয়া - জাট।

More Articles