স্পেন আগেই জানত, তিনি দুর্ভেদ্য! কেন মরক্কোর গোলরক্ষককে চিনতেই হবে

World Cup 2022, Spain vs Morocco: স্পেনকে দেশে ফেরালেন একা ইয়াসিন বুনো। ‌রচনা করলেন এক নতুন রূপকথা।

গ্রুপ স্টেজের শেষ ম্যাচে জাপানের কাছে হারলেও বিশ্বকাপের ফেভারিট তালিকায় সবসময়ই ছিল স্পেন। মঞ্চ প্রস্তুত ছিল তাদের জন্য। সামনে ছিল উত্তর আফ্রিকার দল মরক্কো। পুরো ম্যাচের দখলও ছিল স্পেনের হাতে। কিন্তু তবুও পুরো ম্যাচে গড়পড়তা পারফর্ম করা স্পেন শেষমেষ টাইব্রেকারে হেরে আরও একবার বিদায় নিল বিশ্বকাপ থেকে। গ্রুপ পর্বে সবাইকে চমকে দেওয়া মরক্কো এবার ইতিহাসের জন্ম দিয়ে প্রথমবার জায়গা করে নিল বিশ্বকাপের শেষ আটে। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন মরক্কোর গোলরক্ষক বুনো। অঘটনের বিশ্বকাপে যুক্ত হল এক নতুন পালক।

আল রাইয়ানের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে শেষ আটে যাওয়ার লড়াইয়ে প্রথম থেকেই বল দখলে লড়াইয়ে এগিয়েছিল স্পেন। কিন্তু তবুও গোছানো আক্রমণ করতে অসমর্থ ছিল এই দেশটি। এর মূল কারণ ছিল মরক্কোর দুর্দান্ত ডিফেন্স তার সঙ্গে বুনোর দারুন রক্ষণ। ১১ মিনিটের মাথায় ডি-বক্সের সামনে, বাইরে ফ্রি-কিক পেয়েছিল মরক্কো। কিন্তু আশরাফ হাকিমির শট ক্রস বারের ওপর দিয়ে চলে যাওয়ায় লিড নিতে পারেনি মরক্কো। ২৭ মিনিটের মাথায় জোর্ডি আলবার ক্রস থেকে বল পেয়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারলেন না মার্কো আসেনসিও। ৩৩তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে মরক্কোর মাসাওয়ির শট ঠেকিয়ে দেন উনাই সিমন। ফলে প্রথমার্ধ পুরোপুরি দখলে ছিল স্পেনের। তবে আধিপত্য থাকলেও গোলের অভিমুখে মাত্র একটি শট নিতে পেরেছিল স্পেন, এবং সেটাও ছিল লক্ষ্যভ্রষ্ট। নিজেদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমার্ধে স্পেনের সবচেয়ে কম শট নেওয়ার ইতিহাস ছিল এটি।

দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় সমান খেলল দুই দল। দুই দলই বেশ কিছু আক্রমণ করল, কিন্তু কোনওটি গোলমুখী ছিল না। ৯০ মিনিটের খেলায় দুই দল সমান চারটি শট নেয়, যার মাত্র একটি ছিল টার্গেটে। দুই দল মাঝমাঠের দখল নিতে বেশি আগ্রহী ছিল, তাই প্রতিপক্ষের রক্ষণে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে কোনও দল গোল করতে না পারায় খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। অতিরিক্ত সময়েও সেই একইরকম অবস্থা। অতিরিক্ত সময়ে সহজ গোলের সুযোগ পেয়েছিল দু'টি দল কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি। ফলে খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। দ্বিতীয় আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে পেনাল্টি শুটআউটে গেছিল মরক্কো। এর আগে ২০১০ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের বিপক্ষে ঘানা টাইব্রেকারে হেরে যায়। কিন্তু এবার মরক্কোর কাছে ছিল সুবর্ণসুযোগ।

আরও পড়ুন: অধ্যাপনা ছেড়ে ফুটবল! বিশ্বকাপ ফুটবলে অনুপ্রেরণার অনন্য নজির এই রেফারি

টাইব্রেকারে মরক্কোর ২ শটে সাবেরি আর জিয়াস গোল করলেও, টাইব্রেকারে মরক্কোর জয়ের নায়ক হন তাদের গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনো।

গোটা ম্যাচ তো বটেই, টাইব্রেকারে একের পর এক পেনাল্টি রুখে দেওয়া ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চির ইয়াসিন বুনো এখন মরক্কোর রূপকথার নায়ক। তার গ্লাভসের দৌলতেই তিকিতাকা-র গল্প শেষ হয়েছে বিশ্বকাপে। কানাডায় জন্ম হওয়া এই ছেলেটি আজ মরক্কোকে পরিচিতি দিয়েছে ফুটবল বিশ্বে। যদিও পেনাল্টি বাঁচানোর জন্য এই প্রথম নয়, দীর্ঘদিন ধরেই সুখ্যাতি রয়েছে মরক্কোর এই গোলরক্ষকের। ফুটবল জীবনে এখনও পর্যন্ত ৫০টি পেনাল্টির সামনে দাঁড়িয়েছেন তিনি আর তার মধ্যে বাঁচিয়েছেন ১৩টি পেনাল্টি। শতাংশের হিসেবে দেখতে গেলে ২৬ শতাংশ পেনাল্টি তিনি বাঁচিয়েছেন এখনও পর্যন্ত নিজের ফুটবলজীবনে। গোলরক্ষক হিসেবে এই কৃতিত্ব কম গর্বের নয়। মঙ্গলবার স্পেনের নামীদামি তারকারা পেনাল্টি নিতে এলেও তিনি ছিলেন একেবারে অকুতোভয়, আত্মবিশ্বাসী। আর সেই আত্মবিশ্বাসের দৌলতেই আজ তার সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হলো স্পেন।

মরক্কোর হয়ে খেললেও, বুনোর জন্ম হয়েছিল কানাডার মন্ট্রিল শহরে ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল। তারপর খুব অল্প বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে চলে যান মরক্কোতে। বাবা চাকরিসূত্রে দীর্ঘদিন কানাডায় বসবাস করতেন। বোনের কৈশোরের আগেই ছেলেকে নিয়ে দেশে ফিরে যান তাঁরা। ছোট থেকেই বাড়ন্ত ছিলেন তিনি। প্রথমে বাস্কেটবল খেলতেন। তারপর হঠাৎ বছরদশেক বয়সে গোলরক্ষণ করা শুরু করেন মরক্কোর একটি ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। এখানেই তাঁর উচ্চতা এবং তাঁর ক্ষিপ্রতা দেখে কোচ বুঝেছিলেন, তিনি হতে চলেছেন লম্বা রেসের ঘোড়া। মরক্কোতে থাকাকালীন ওয়াইদাদ কাসাব্লাঙ্কা-র হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন বুনো। মরক্কোর এই ক্লাবে গোলরক্ষকের ভূমিকা পালন করতেন তিনি।

এই দল তাঁর ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এই দলে খেলার সময় ২০১১ সালে সিনিয়র দলে অভিষেক করার সুযোগ পান বুনো। মরক্কোতে সেই সময় ফুটবল নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি। তার এক বছর আগে প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ পেয়েছিল তার ক্লাব। একবছর এই ক্লাবের হয়ে খেলে বুনো চলে আসেন স্পেনে এবং যোগদান করেন লা লিগা-র অন্যতম দল অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ক্যাম্পে। প্রথমে রিজার্ভ বেঞ্চে থাকলেও, এরপর মূল দলের তৃতীয় গোলকিপার হিসেবে জায়গা পান বুনো। সেই সময় যদিও তিনি খুব একটা বেশি সুযোগ পেতেন না মাঠে নামার।

যদিও ২০১৪ সালটা তার জন্য হয়ে ওঠে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। সেই বছর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের দল থেকে বেরিয়ে আসেন তাদের দুই প্রধান গোলরক্ষক থিবো কুর্তোয়া এবং ড্যানিয়েল আরানজুবিয়া। অ্যাটলেটিকোর প্রথম গোলকিপার হিসেবে সে-বছর ২৪ জুলাই অভিষেক ঘটে বুনোর। প্রাক-মরশুম প্রস্তুতি ম্যাচে ১-০ গোলে জয়লাভ করে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। যদিও, খুব একটা বেশি সুযোগ পাচ্ছিলেন না বুনো। মাদ্রিদে থাকাকালীন একটিও ম্যাচে খেলার সুযোগ পাননি বুনো।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বুনোকে লোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লা-লিগার আরেক দল রিয়াল জারাগোজাতে। সেখানে প্রথমে গোলকিপার হিসেবে তিনি সুযোগ পাননি। তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে অবশেষে অভিষেক ঘটে বুনোর। সেই মরশুমে ১৬টি ম্যাচে খেলার সুযোগ পান তিনি। সুযোগ ঘটে বিশ্ব ময়দানে তেকাঠি রক্ষণের। যদিও জারাগোজার সঙ্গে খুব একটা বেশি দিন খেলা হয়নি বুনোর। ২০১৬ সালে বুনো যোগ দেন জিরোনায়। সেই দলের হয়ে চার বছরে ৮৩টি ম্যাচ খেলেন তিনি। জিরোনাতে খেলার সময় একবার ভারতে এসেছিলেন বুনো। ২০১৯ সালে কেরলের কোচিতে আয়োজিত হয়েছিল লা লিগা বিশ্ব সিরিজ এবং সেখানেই জিরোনা দলের হয়ে মেলবোর্ন সিটির বিরুদ্ধে খেলেছিলেন বুনো। তবে কেরলের বিরুদ্ধে খেলার সময় তাকে দেখা যায়নি।

২০১৯ সালে লোনেই সেভিয়ায় যোগ দেন বুনো। ঘরের কাপে ক্লাবের হয়ে প্রতিটি ম্যাচে খেলেন তিনি। এখনও পর্যন্ত এই দলের গোলরক্ষক তিনিই রয়েছেন। ২০১৯ সালে সেভিয়া ইউরোপা লিগ জিতেছিল আর সেই টুর্নামেন্টে প্রশংসিত হয়েছিলেন বুনো। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল বিশ্ব ময়দানে বুনোর জয়যাত্রা। ইউরোপা লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে উলুভারহ্যাম্পটনের বিরুদ্ধে রাউল জিমেনেজের একটি পেনাল্টি বাঁচিয়ে দিয়ে সবাইকে চমকে দেন তিনি।

বুনোর গোলরক্ষণ যে কোন মানের হতে চলেছে, ‌সেটা আগে থেকেই জানত স্পেন। তাই মরক্কোর বিরুদ্ধে খেলতে নেওয়ার আগে একহাজারটি পেনাল্টি মারার অনুশীলন করে নেমেছিল স্পেন। কিন্তু স্পেনের ক্লাব ফুটবলে খেলা এই ছেলেটি যে কীভাবে বুস্কেটসদের শট আটকে দিল, সেটাই ছিল স্পেনের কোচের কাছে বিস্ময়। ‌

গতকাল ডমিনিক লিভাকোভিচের হাতে বিদায়-ঘণ্টা বেজেছিল জাপানের। টাইব্রেকারে পেনাল্টি সেভের হ্যাটট্রিক করে ক্রোয়েশিয়াকে শেষ আটে পৌঁছে দিয়েছিলেন লিভাকোভিচ।‌ আর মঙ্গলবার স্পেনকে দেশে ফেরালেন বুনো। ‌রচনা করলেন এক নতুন রূপকথা।

More Articles