আপনি আনারস খাচ্ছেন না আনারস আপনাকে- প্রশ্ন সেটাই!

এ দেশে প্রতি বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস অবধি বাজারে প্রচুর পরিমাণে আনারস বিক্রি হতে দেখা যায়। লাঞ্চ সেরে ফ্রিজ থেকে হালকা নুন আর চিনি মাখানো আনারস খাওয়ার কথা ভাবলে জিভে জল চলে আসে না এমন মানুষের খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু, আপনি কি জানেন, যখন মানুষ আনারস খায়, তখন আনারসও মানুষদের খায়? ভাবছেন এটা আবার কেমন ঠাট্টা, কেমন রসিকতা? একেবারেই রসিকতা করছি না! আনারস সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র সুস্বাদু ফল, যা মানুষের মুখে যাওয়ার পর, মানুষকেই খেতে শুরু করে! কি এতদিনে কখনও শোনেননি এরকম অদ্ভুতুড়ে কথা, তাই তো? তবে আসুন আজ বিস্তারিতভাবে শুনে নিন আনারসের ব্যাপারে এমন কিছু তথ্য, যা আপনাকে চমকিত করতে বাধ্য। 

তার আগে জেনে নিই আনারসের ইতিহাস। এই পৃথিবীতে প্রথম আনারস চাষ হতো ব্রাজিলে। পরে তা ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান উপকূলবর্তী দেশগুলোতে। ১৪৯২ সালে যখন ক্রিস্টোফার কলম্বাসের পা পড়ে আমেরিকার বুকে তখন তাঁর হাত ধরে ১৪৯৩ সালে আনারস পা দেয় ইউরোপ তথা বহির্বিশ্বে। ইংল্যান্ডে প্রথম আনারস পৌঁছয় ষোড়শ শতাব্দীতে এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে সে দেশে তা রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এতটাই যে, তখনকার দিনে এক একটা আনারস যে দামে বিক্রি হতো ইংল্যান্ডে, তা আজকের দিনে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪,৫০,০০০ টাকার সমান! বড় বড় লোকেদের পার্টিতে ধনী ব্যক্তিরা বগলদাবা করে নিয়ে যেতেন একটি আনারস। শুনতে ভীষণ অবাক লাগলেও, এটাই সত্যি। 

সময়ের সঙ্গেই আনারস ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে। এখন ভারতবর্ষেও আনারসের প্রচুর ফলন হয়। ফলত, খোলা বাজারে আনারস বিক্রি হয় খুবই স্বল্প দামে। বাজারের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে মা-কাকিমার হাতে পড়ে ছাড়ানো আনারস যখন পৌঁছায় আমাদের মুখের ভিতর, তখনই শুরু হয় আনারসের খেলা! কখনও মুখের ভিতর আনারস থাকাকালীন মনে হয়েছে জিভটা কীরকম যেন করছে, অনেকটা স্যান্ডপেপারের মতন অবস্থা হচ্ছে জিভের, যেন অ্যসিড ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ জিভে অল্প মাত্রায়? হয়েছে তো? কিন্তু কেন হয় এরকম? অ্যালার্জি? না। ইন্টারনেটে খুঁজলে দেখা যায়, অনেক মানুষের ক্ষেত্রে, আনারস খাওয়ার পর জিভ দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে, মারী দিয়ে রক্তক্ষরণও হয়েছে। 

কিন্তু কেন? তারই উত্তর খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা বছরের পর বছর গবেষণা করেছেন আনারসকে নিয়ে। এবং শেষমেষ আবিষ্কার করেছেন এক চমকপ্রদ তথ্য! আমরা যখন আনারস খাই, তখন আনারসও আমাদের খায়! মানুষের শরীর তৈরি প্রোটিন দিয়ে। আমরা বিভিন্ন খাদ্যের মাধ্যমে শরীরের ভিতর প্রোটিন জমা করি। আনারসের ভিতরে থাকে ব্রোমেলাইন উৎসেচক। ব্রোমেলাইন কী করে? এই অদ্ভুত উৎসেচকটি প্রোটিন খেয়ে নেয়। অর্থাৎ আমরা যখন আনারস খাই, তখন আনারসের ভিতরে থাকা ব্রোমেলাইন উৎসেচক আমাদের শরীরে থাকা প্রোটিন খেতে শুরু করে। তবে, এক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা করার কোনও ব্যাপার নেই। যখনই আনারস আমাদের খাদ্যনালীর মাধ্যমে পেটে পৌঁছায়, তখন আমাদের পেটের ভিতরে থাকা বিভিন্ন অ্যসিড ব্রোমেলাইন উৎসেচকের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। 

তবে কি আনারস খাওয়া উচিত নয়? উত্তরটা হল, উচিত। 

আনারসের মধ্যে থাকা এই ব্রোমেলাইন এনজাইম বা উৎসেচক কি শুধু মানুষের মুখে ঠোঁটে বা জিভে ক্ষতি সাধনই করে? উত্তরটা হল, না, শুধু ক্ষতি করে না।

মানব শরীরে এই উৎসেচকের ব্যবহার বিভিন্ন ধরনের উপকারও করে। যেমন, ব্রোমেলাইন উৎসেচক আমাদের শরীরের ভিতরে হওয়া বিবিধ ক্ষরণ রোধ করতে সাহায্য করে। সার্জারির পর যে জন্য ডাক্তাররা আনারস খেতে বলেন রুগীদের। 

এ ছাড়াও আনারসের মধ্যে উপস্থিত ব্রোমেলাইন উৎসেচক দিয়ে এখন ক্যানসারের চিকিৎসাও হচ্ছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যানসার এবং ওভারিয়ান ক্যানসার নিরাময়ের ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যকর সারা পাওয়া গেছে ব্রোমেলাইন উৎসেচক ব্যবহারের পর। এই উৎসেচক একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছে যাওয়ার পর ক্যানসারের কোষদের মেরে ফেলে। যদিও, এখনও এই পুরো পদ্ধতিই গবেষণা প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। 

প্রকৃতির বুকে আনারসই একমাত্র সূত্র, যেখান থেকে পাওয়া যায় ব্রোমেলাইন উৎসেচক। যা একাধারে মানুষের শরীরে উপস্থিত প্রোটিন খেয়ে নেয় আবার অন্যদিকে মানুষের শরীরে উপস্থিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। তাই আনারস খাবেন। তবে পরের বার যখন আনারসের একটা টুকরো মুখের মধ্যে নেবেন, তখন অনুভব করার চেষ্টা করে দেখবেন আপনি আনারস খাচ্ছেন না আনারস আপনাকে খাচ্ছে?!

More Articles