হু হু করে বাড়ছে নতুন মায়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা! কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন মেয়েরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত হস্তক্ষেপ করলে অনেক সময় এই ধরণের ঘটনা আটকানো যায়। সাইক্রিয়াটিস্ট বিজয় কুমার বলেন, ভারত সরকার ২০১৮ সালে আত্মহত্যার প্রতিরোধে যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছিল, তা এতগুলি বছর পরও কার্যকর হয়নি।
নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা...।
২১ শতকে নারী মুক্তি নিয়ে নানা তর্জন গর্জন শোনা গেছে। এরপরও আজকে দাঁড়িয়ে প্রমাণ হয়েছে, এই কথাগুলো শুধুই কথার কথা। কারণ ভালো নেই নতুন মায়েরা। সন্তানের জন্ম দিয়েও কোন সমাজিক ব্যধি তাঁকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না? আশঙ্কার মেঘ এই কারণে ঘনীভূত হচ্ছে যে, এঁদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। বিভিন্ন সংস্থা যে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করছে, তাতে ভয়ঙ্কর পরিণতির ছবি সামনে আসছে।নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা থেকে এখনও বেরতে পারছেন না আজকের নারীরা, বিশেষ করে নতুন মায়েরা। এই সমস্যাগুলো কী?
অকালে বিয়ের পিঁড়িতে বসা
ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্স অর্থাৎ স্বামীর দ্বারা হিংসা
পুত্র সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য সামাজিক চাপ।
এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকা
মূলত এই সব কারণেই আজকের নতুন মায়েরাও জীবনের চরম পথ বেছে নেওয়ার কথা ভাবেন। একজন মেয়ের অন্তঃসত্ত্বা হওয়া মানে নতুন প্রাণের আগমনের দিনগুলো খুশির কারণ হতে পারে। পরিবারেও তাঁকে নিয়ে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ স্বাভাবিক। কিন্তু দিল্লির গরিমা মল্লিক এর ক্লিনিকে যে মহিলারা আসছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ করে ভিন্ন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সেখানে মায়েদের মধ্যে নতুন প্রাণের আগমণের উচ্ছ্বাস নেই, আছে একরাশ হতাশা। কেউ কাঁদেন, কেউ কেউ ক্ষিপ্ত, হতাশায় বিধ্বস্ত।
মনোবিদরা বলছেন, এর কারণ গার্হস্থ্য হিংসা। তাঁরা আতঙ্কিত যে তাঁরা গর্ভাবস্থায়ও সুরক্ষিত নন, তাঁদের প্রিয়জনদের হাত থেকেও। কাউন্সিলর আরও বলেন, তাঁরা আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নেওয়ার কথাও বলেন। তখন তাঁদের বোঝানো হয়, আগামী প্রজন্মের জন্য এবং তাঁর নিজের জন্য এই সিদ্ধান্ত কতটা ভয়ঙ্কর! কীভাবে তাঁরা পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন, তাও তাঁদের বোঝানো হয়। কখনও কখনও তাঁরা এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। এক মনোবিদের কথায়, এখানে যে মহিলারা আসেন, তাঁদের পরীক্ষা করে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, অনেকেই অন্তসঃত্ত্বা অবস্থায় শারীরিক ও মানসিক হিংসার শিকার। কারণ তাঁরা অনেক সময় গর্ভাধারণের পর প্রথম অবস্থায় বা সন্তানের জন্মের পরে পরেই শারীরিক মিলনে রাজি থাকেন না, তখন তাঁদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার। শুধু তাই নয়, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে তাঁরা সমাজের বঞ্চনার শিকার হন কখনও কখনও।
ওই মনোবিদ আরও বলছেন, তাঁরা এমনও দেখেছেন যে, যে সব ভারতীয় মহিলা গর্ভাবস্থায় বা সন্তান জন্মের কথা ভাবেন, তাঁদের পরিবার থেকে তাঁরা কোনও সাহায্যে পান না। যে বয়সে মহিলারা মা হন, সেই বয়সে ভারতে বেশি করে মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে আত্মহত্যা। বিভিন্ন পরীক্ষায় এমনটাই উঠে এসেছে। দ্য ল্যানসেট মেডিক্যাল জার্নালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে সারা বিশ্বের তুলনায় ভয়ঙ্করভাবে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে।
তবে একটাই সুখবর যে, মেটারনাল মর্টালিটি অর্থাৎ প্রসূতি মৃত্যুর হার গত ২ বছরে অনেক কমেছে। ২০০৪ সালে প্রতি এক লাখে ( লাইভ বার্থ) ২৫৪ জন মায়ের মৃত্যু হয়। ২০১৯ এ এই সংখ্যাটা কমে হয় ১০৩। রাষ্ট্রসংঘ ২০৩০ এ এই সংখ্যাটা আরও কমিয়ে ৭০ এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে। তবে এই সাফল্যের পেছনে একটা বড় ব্যর্থতার ইঙ্গিত রয়েছে, সেটা হল, অনেক মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসে না। সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, কম আয়ের মহিলাদের ক্ষেত্রে দ্রুত গর্ভ ধারণের ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার এই সমস্যা সমাধানে তেমন কিছুই করে না।
আরও পড়ুন-কারো আছে ল্যামবোর্গিনি, কারো ২,২০০ কোটির বাড়ি || এই নেতাদের সম্পত্তি দেখে লজ্জা পাবেন কুবেরও
সাইক্রিয়াটিস্ট এবং হু এর ইন্টারন্যাশনাল টেনওয়ার্ক ফর সুইসাইড রিসার্চ অ্যান্ড প্রিভেনশন এর সদস্য লক্ষ্মী বিজয়কুমার বলেন, ভরত ব্যাপক হারে নতুন মায়েদের হারাচ্ছে। আমাদের দেশে এই নিয়ে কোনও কার্যকর মেকানিজম, পরিকল্পনা বা কৌশল নেই। বারবার বলা সত্ত্বেও এই নিয়ে সরকারের ঘুম ভাঙানো যায়নি।
সমস্যার শিকড়
ভারতে প্রসূতি মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, এর বড় কারণ হল বাড়ির পরিবর্তে বিনা পয়সার গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব। সরকারি এই সাফল্যের মূল কারণ হল প্রত্যন্ত এলাকায় সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অর্থ সাহায্য দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছে সরকার।
প্রসূতি মৃত্যু কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কেরালার সাফল্য সবচেয়ে বেশি। প্রতি এক লাখ জন্মের ক্ষেত্রে দেখা গেছে এখানে ৪২ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এই সাফল্যের বড় কারণ, এখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রসব করানো হয় পরিষ্কার ও সুরক্ষিত স্থানে। এই কারণে মৃত্যুর হার কমানো গেছে। কেরালা একমাত্র রাজ্যে এখানে প্রসূতি মৃত্যু ৬৬ থেকে কমে ৪৩ এ নেমেছে। তবে গর্ভাবস্থায় বা তার সন্তান জন্মের পরেও এখানে গত কয়েক বছরে পরিসংখ্যান বলছে, মায়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা তো কমেইনি, উল্টে বেড়েছে। ২০১০ সালের ২.৬ শতংশ থেকে ২০১৯-২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৮.৬ শতাংশ।
দ্রুত হস্তক্ষেপ জরুরি
নতুন মায়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। তাতে যে কারণগুলি প্রধান বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল – মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, অকাল বিয়ে, গার্হস্থ্য হিংসা। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে ভারতীয় মহিলাদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ইন্টিমেট পার্টনার অর্থাৎ স্বামীর দ্বারা হিংসার শিকার। ফলে তাঁরা চরম পথ বেছে নেন। এমনকী সন্তানকে মেরে মরার কথাও ভাবেন। বৈবাহিক ধর্ষণ আমাদের দেশে আইনসিদ্ধ নয়, এরপরও এই নিয়ে কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যায়। সমাজ যে ব্যধির কবলে ডুবে আছে, তার বড় কারণ হল প্রতিদিন নিজের ঘরেই ধর্ষিতা হয়ে চলেছেন মেয়েরা।
মুম্বইয়ের সংগঠন স্নেহা এর হেড অফ প্রোগ্রাম অন দ্য প্রিভেনশন অফ ভায়োলেন্স এগেন্সট উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন নারায়ণ দুরাওয়ালা বলেন, গর্ভাবস্থায় আত্মহত্যার প্রবণতা কেন বাড়ছে, একে দু’টি ক্যাটিগরিতে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।
এক, একজন মহিলা অন্তঃসত্ত্বা হলে তাঁকে পুত্রসন্তান জন্মের জন্য চাপ দেওয়া হয়। অনেকক্ষেত্রে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কের পর তাঁর পার্টনার বিয়ে করতে না চাইলে তিনি চরম পথ বেছে নেওয়ার কথা ভাবেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা সামাজিক সমর্থনও পান না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত হস্তক্ষেপ করলে অনেক সময় এই ধরণের ঘটনা আটকানো যায়। সাইক্রিয়াটিস্ট বিজয় কুমার বলেন, ভারত সরকার ২০১৮ সালে আত্মহত্যার প্রতিরোধে যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছিল, তা এতগুলি বছর পরও কার্যকর হয়নি।
আজ নারী শক্তি উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে কত কথা আওড়ে চলেছে এই সমাজ। এরপরও দেখা যাচ্ছে, সামাজিক ব্যধির হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না নবজাতককে পৃথিবীতে নিয়ে আসা মায়েরা। আজ তাঁরা বিপন্ন।