দশজন সেরা ক্রিকেটার যাদের উপেক্ষা করেছেন অধিনায়ক কোহলি
এখন আর অধিনায়ক নন বিরাট কোহলি। তারপরও তাঁর অধিনায়কত্বের সময়ের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখ পড়তে হচ্ছে কিং কোহলিকে। সব চেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠছে তার দল নির্বাচন নিয়ে। তবে এখনই প্রথম নয়। অধিনায়ক থাকাকালীনও একাধিক বার এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। আসুন জেনে নেই অধিনায়ক কোহলি জমানায় উপেক্ষিত দশজন ক্রিকেটারের কথা।
সুরেশ রায়না
যুবরাজ সিংয়ের পরে, সম্ভবত সুরেশ রায়না সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের সেরা বাঁ হাতি মিডিল অর্ডার ব্যাটার। ২০০৭ টি ২০ বিশ্বকাপ বাদে, রায়না ভারতের হয়ে খেলতে শুরু করার পর থেকে সমস্ত বড় টুর্নামেন্টের দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অধিনায়ক এমএস ধোনির সময় লোয়ার মিডল অর্ডারে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন রায়না। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জয়ে তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। কিন্তু অধিনায়ক বিরাট কোহলি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রায়নাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে মিডল অর্ডার নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠে ছিল, তখনও রায়না কে উপেক্ষা করেছে ক্যাপ্টেন কোহলি। এই আক্রমণাত্মক বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান তার ক্যারিয়ারে মোট ৩২২টি ম্যাচ আন্তর্জাতিক খেলে ৭৯৮৮ রান করেছেন। রায়নারও সংগ্রহে রয়েছে ৬২ উইকেটও।
১৫ আগস্ট, ২০২০-এ, রায়না আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা করেন।
আম্বাতি রায়ডু
আম্বাতি রায়ডু ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে দুর্ভাগা ক্রিকেটারদের একজন। খুব অল্প বয়সে, রায়ুডকে বলা হত ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন বিদ্রোহী লিগে। কিন্তু মূলধারার ক্রিকেটে ফিরে আসার পর, রায়ডুর ব্যাট তাঁর জাত চেনাতে শুরু করে। আর তিনি চলে আসেন জাতীয় নির্বাচকদের নজরে। রায়ডুর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে অভিষেক হয়েছিল - ২৪ জুলাই, ২০১৩-এ। তিনি ২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপের জন্য ভারতের ১৫-সদস্যের দলে নির্বাচিত হন। কিন্তু টুর্নামেন্টে কোনও ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। অধিনায়ক বিরাট কোহলি ২০১৯ বিশ্বকাপের জন্য রায়ডুকে ভারতের নড়বড়ে মিডল অর্ডারে চার নম্বরে ব্যাটার হিসাবে পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বকাপের ঠিক আগে কয়েকটা ম্যাচে স্নান করতে না পারায় দল থেকে বাদ পড়েন তিনি।
আরও পড়ুন-নাদালের যাত্রাপথ এখন টেনিস ছাড়িয়ে জীবনযুদ্ধের অনুপ্রেরণা
আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯-এর জন্য ভারতের ১৫ সদস্যের দল থেকে বাদ পড়ার পর, আম্বাতি রায়ডু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা করেন।
করুণ নায়ার
সম্ভবত অধিনায়ক বিরাট কোহলির যুগের সবচেয়ে বড় অপকর্ম করুণ নায়ারকে উপেক্ষা করা। একজন ক্রিকেটার যিনি তাঁর তৃতীয় টেস্ট ম্যাচে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন, তিনি তার পরে মাত্র তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কি হতে পারে?
২০১৬ সালে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার তৃতীয় টেস্টে অপরাজিত 303 রান করে নায়ার। তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে তার প্রথম সেঞ্চুরিকে ট্রিপল সেঞ্চুরিতে রূপান্তরিত করার নজির তৈরি করেন।
নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের তৃতীয় ইনিংসে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে করুন নায়ার টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ইনিংস খেলে ট্রিপল সেঞ্চুরি করা ব্যাটার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ২০১৬ সালে চেন্নাইতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার তৃতীয় টেস্টে, কর্ণাটক ব্যাটসম্যান ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিলেন। বীরেন্দ্র শেবাগের পর তিনি ভারতের দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান।
করুণ নায়ার তার শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ধর্মশালায় - ২৫-২৮ মার্চ, ২০১৭। এটি ছিল তার ষষ্ঠ টেস্ট ম্যাচ।
এরপর অধিনায়ক বিরাট কোহলি কখনোই তাকে প্লেয়িং ইলেভেনে রাখেন নি। কিন্তু তিনি অনেক দিন ভারতীয় দলের অংশ ছিলেন। বিরাট কোহলি ২০১৮ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করুণ নায়ারের পরিবর্তে হনুমা বিহারিকে পছন্দ করেছিলেন। তারপর থেকে তিনি ভারতীয় দলের বাইরেই রয়েছেন।
করুণ নায়ার ভারতের হয়ে মোট আটটি ম্যাচ খেলে ৪৪০ রান করেন।
সঞ্জু স্যামসন
প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলতে শুরু করার পর থেকেই সঞ্জু স্যামসন দেশের প্রতিশ্রুতিবান তরুণ ক্রিকেটারদের একজন। হারারে - ১৯ জুলাই, ২০১৫-তে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে তাঁর টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়েছিল৷ তারপর থেকে, সঞ্জু স্যামসন ভারতের হয়ে মাত্র একটি একদিনের ম্যাচ এবং দশটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন৷ তিনি আইপিএল এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক রান সংগ্রাহকদের একজন।
স্যামসন যে পরিমাণ রান করেছেন তাতে তিনি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতীয় মিডল অর্ডার ব্যাটিং লাইন আপের একজন অটোমেটিক চয়েজ হওয়ার কথা। তিনি একজন উইকেটরক্ষকও। তাই ধোনির পর স্যামসনই হতে পারেন টিম ইন্ডিয়ার আরেকটি পছন্দ হতে পারতেন। কিন্তু তিনিও অধিনায়ক বিরাট কোহলির উপেক্ষার পাত্র।
উমেশ যাদব
অধিনায়ক বিরাট কোহলির ব্যক্তিগত পছন্দের আরেক শিকার উমেশ যাদব। উমেশ যাদবের পরিবর্তে ইশান্ত শর্মাকে সব সময় বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। তবে উমেশ ইশান্ত শর্মার চেয়ে অনেক দ্রুত গতির বোলার। বলে সুইং ও বেশি করেন। টেস্ট ও ওডিআই উভয় ক্ষেত্রেই উমেশ যাদবের স্ট্রাইক রেট অনেক ভালো। কিন্তু অধিনায়ক বিরাট কোহলি সবসময়ই ইশান্ত শর্মা কে খেলাতে বেশি পছন্দ করেছেন।
২৮ মে, ২০১০-এ বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ভারতের হয়ে উমেশ যাদব তার অভিষেক করেন। তারপর থেকে, তিনি মোট ১৩৪টি ম্যাচ খেলে ভারতের হয়ে ২৭৩টি উইকেট পান।
মুরলি বিজয়
তামিলনাড়ুর ওপেনিং ব্যাটার মুরলি বিজয় ক্যাপ্টেন কোহলির যুগের শুরুর দিকে টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্যের অন্যতম কারিগর। ভারতের হয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে তার বুদ্ধিমত্তা, সংগঠিত এবং ধৈর্যশীল ব্যাটিং খুবই কার্যকর ছিল।
মুরলি বিজয় ভারতের হয়ে তার ক্যারিয়ারে মোট ৮৭টি ম্যাচ খেলে ৪৪৯০ রান করেছেন।
তিনি শেষবার ভারতের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পার্থে খেলেছিলেন - ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে। তারপর থেকে, অধিনায়ক বিরাট কোহলি তাঁকে আর বিবেচনায় রাখেননি।
অমিত মিশ্র
অমিত মিশ্র ভারতের আরেক জন সবচেয়ে দুর্ভাগা ক্রিকেটার। তিনি যখন লেগ-স্পিনার হিসাবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, তখন অনিল কুম্বলে তার ক্যারিয়ারের পিকে ছিলেন। তাই দেশের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি হরিয়ানার এই লেগস্পিন বোলার। আর মিশ্র যখন তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো ফর্মে ছিলেন, নিয়মিত উইকেট নিচ্ছেন, অধিনায়ক বিরাট কোহলি তখন তাকে উপেক্ষা করেছেন।
অমিত মিশ্র ভারতের হয়ে তার শেষ ওডিআই খেলেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশাখাপত্তনমে -২৯ অক্টোবর, ২০১৬। সেই ম্যাচে মিশ্র পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন। তার বোলিং ফিগার ছিল ৬-২-১৮-৫। তিনি 'প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ' হয়েছিলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সিরিজে তিনি মোট ১৫ উইকেট নিয়েছিলেন এবং 'প্লেয়ার অফ দ্য সিরিজ' নির্বাচিত হন।
তারপরে ধোনি ২০১৭ সালের শুরুতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে ওডিআই সিরিজের ঠিক আগে ভারতের সীমিত ওভারের অধিনায়ক হিসাবে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। নতুন অধিনায়ক হন বিরাট কোহলি।
অমিত মিশ্র তখন টেস্ট, ওডিআই এবং টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে ছিলেন। কিন্তু সিরিজের শেষ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। বেঙ্গালুরুতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে - ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ মিশ্র ভারতের হয়ে তার শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন। ওই ম্যাচে তার বোলিং ফিগার ছিল ৪-০-২৩-১।
আইপিএল এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে উইকেট পেলেও অধিনায়ক বিরাট কোহলির আমলে অমিত মিশ্র আর দলে জায়গা পাননি।
অমিত মিশ্র ভারতের হয়ে ৬৮টি ম্যাচ খেলেছেন এবং ১৫৬টি উইকেট পেয়েছেন।
জয়দেব উনাদকাট
এক সময় কিংবদন্তি ওয়াসিম আক্রম তাঁক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু সেই বাঁহাতি ফাস্ট বোলার জয়দেব উনাদকাট এখন জাতীয় দলে থেকে বহুদূরে।
সম্প্রতি অতীতে বাঁহাতি ফাস্ট বোলারের বিরুদ্ধে ভারতীয় ব্যাটাররা একাধিকবার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। ট্রেন্ট বোল্ট, শাহীন আফ্রিদির সামনে ভারতীয় টপ অর্ডারের দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছে । কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিনায়ক বিরাট কোহলি কখনোই উনাদকাটের প্রতি আগ্রহ দেখাননি।
যদিও, ঘরোয়া ক্রিকেটের পাশাপাশি আইপিএলেও তিনি ধারাবাহিক পারফরমার।
তিনি শেষবার ভারতের হয়ে কলম্বোতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে খেলেছিলেন- ১৮ মার্চ, ২০১৮। উনাদকাট ভারতের হয়ে পুরো ফরম্যাটে ১৮টি ম্যাচ খেলেছেন এবং ২ উইকেট পেয়েছেন।
খলিল আহমেদ
অধিনায়ক বিরাট কোহলির মেজাজ মর্জির আরেক উদাহরণ খলিল আহমেদ। এই বাঁ-হাতি মিডিয়াম পেসার অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট থেকে সরাসরি ভারতীয় দলের ড্রেসিং রুমে ঢুকে পড়েন।
২০১৮ সালে, তৎকালীন কোচ রবি শাস্ত্রী ভারতীয় পেস বোলিং বিভাগে বৈচিত্র খুঁজছিলেন। তাই ১৯ বছর বয়সী খলিল আহমেদ এশিয়া কাপ ২০১৮-এর জন্য নির্বাচিত হন। সেই টুর্নামেন্টে হংকংয়ের বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে তাঁর ওডিআই অভিষেক হয়। এক মাস পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়।
কিন্তু এক বছরের মধ্যেই দল থেকে ছিটকে যান তিনি। খলিল আহমেদ ভারতের হয়ে মোট 25টি ম্যাচ খেলে 28টি উইকেট পেয়েছেন।
অভিনব মুকুন্দ
অভিনব মুকুন্দ ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের জন্য ভারতের স্কোয়াডের অংশ ছিলেন। তিনি তার ঘরোয়া ক্যারিয়ারে শুরু করেছিলেন দুরন্ত ভাবে।
কিন্তু তার টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল খুবই খারাপ। অভিনব মুকুন্দ কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তার টেস্ট অভিষেক হয়েছিল - জুন ২০ - ২৩, ২০১১।
তিনি অধিনায়ক বিরাট কোহলির অধীনে তার শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে গ্যালে - 26-29 জুলাই, 2017। সেই ম্যাচে, তিনি দ্বিতীয় ইনিংসে ৮১ রান করেছিলেন। অভিনব মুকুন্দ মোট ৭টি ম্যাচ খেলে ভারতের হয়ে ৩২০ রান করেছেন।