কলকাতাকে ভয়? ১১০ বছর আগে কেন দিল্লিতে সরানো হয়েছিল রাজধানী
History of Capital Delhi: নতুন রাজধানীটিকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল তৎকালীন অবিভক্ত পঞ্জাব প্রদেশ থেকে এবং ১৯২৭ সালে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘নয়া দিল্লি’।
তখন উত্তাল বাংলা। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে দুই বাংলাকে ভেঙে দেয় ব্রিটিশরা। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বঙ্গ ও হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ। এই ঘটনার পরে উত্তাল হয়ে ওঠে কলকাতা। আন্দোলনের দমকে নাকানি চোবানি খায় ইংরেজরা। অচিরেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ক্রমেই তীব্র আকার নেয়। তখন লর্ড হার্ডিঞ্জ বুঝতে পারেন, কলকাতায় শাসনকার্য চালানোর সুবিধা থাকলেও নানা অসুবিধা তৈরি হচ্ছে। হার্ডিঞ্জ তাঁর পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার কথা লিখে পাঠান এবং তা অনুমোদন পেয়ে যায় রাজা পঞ্চম জর্জের কাছ থেকে। তিনি জানান, কলকাতার পরিবেশ ঠান্ডা করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করার সঙ্গে রাজধানীও অন্য কোথাও স্থানান্তর করতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ভারতের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বইয়ের অনেক পাতা খরচ হয়ে থাকে, কিন্তু যে প্রশ্নটা বারবার নাড়া দেয়, তা হল বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে সেদিন যে আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছিল, তাই কি ধাক্কা দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের ভিতে? এই ভয় থেকেই কি ইংরেজরা কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যায় দিল্লি?
অবিভক্ত ভারতের নতুন রাজধানী হিসেবে ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লি যাত্রা শুরু করে। রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে রাজকীয় অনুষ্ঠানে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর নতুন রাজধানী হিসেবে দিল্লির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। এর ২০ বছর পর, ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড আরউইন নতুন রাজধানী হিসেবে নয়াদিল্লির উদ্বোধন করেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের মাহেন্দ্রক্ষণে দেশ স্বাধীনতার অমৃতমহোৎসব পালন করেছে। এই সময়ে প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে এই প্রশ্ন, কী কারণে ইংরেজরা কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরাতে বাধ্য হয়েছিল দেশের রাজধানী?
আরও পড়ুন- আর কিছুদিনেই পরিত্যক্ত নগরী হতে চলেছে রাজধানী দিল্লি! বিষের বাষ্পে যে ইঙ্গিত
ভারতের পূর্বাঞ্চলের শহর কলকাতা। ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল এটি। অপরদিকে দিল্লির অবস্থান ভারতের উত্তরাঞ্চলে। তাই ব্রিটিশ সরকারের মনে হয়েছিল, দিল্লি থেকে ভারত শাসন করা অপেক্ষাকৃত সহজতর হবে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রস্তাব ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে রাখা হয়েছিল।
চিঠিটি ১৯১১ সালের ২৫ অগাস্ট পাঠানো হয়েছিল সিমলা থেকে লন্ডনে। প্রাপকের ঘরে নাম লেখা ছিল তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া, আর্ল অভ ক্রুইর। হার্ডিঞ্জ সেখানে গুরুত্বারোপ করেছিলেন যে, ভারতের চরমভাবাপন্ন এলাকা কলকাতা থেকে গোটা অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি সেখানে আরও লিখেছিলেন, রাজধানী হিসেবে ভারতবর্ষের প্রয়োজন আরও কেন্দ্রীভূত একটি শহর।
ভারতের রাজধানী হিসেবে কলকাতার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে স্বভাবতই বঙ্গভঙ্গের বিষয়টি চলে আসে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের শুরু থেকেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি কিংবা অর্থনীতি ও বাণিজ্য, সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা। কিন্তু ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর, প্রশাসনিক সুবিধার্থে, বাংলাকে ভেঙে দুইভাগ করে দেয় ব্রিটিশরাজ। এক অংশে ছিল মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা, অন্য অংশে হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলা।
‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অনুযায়ী বঙ্গভঙ্গ করা হয়েছিল। কিন্তু এ নীতি পশ্চিম বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদী চেতনায় আঘাত হানে। তখন তাঁরা সব বিদেশি পণ্য বর্জনের ঘোষণা করেন। বঙ্গভঙ্গ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন এক পর্যায়ে এমন চরম রূপ নেয় যে, বোমাবাজি ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কলকাতার নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়। কলকাতার আকাশ-বাতাস যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তখন লর্ড হার্ডিঞ্জ বেশ ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছিলেন কলকাতা আর তাঁদের জন্য শাসনকার্য পরিচালনার উপযোগী শহর নেই। তাই তিনি চাইছিলেন যত দ্রুত সম্ভব এই শহর ত্যাগ করতে হবে। হার্ডিঞ্জ তাঁর পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার কথা লিখে পাঠান, এবং তা অনুমোদন পেয়ে যায় রাজা পঞ্চম জর্জের কাছ থেকে। তিনি ঘোষণা করেন কলকাতার পরিবেশ ঠান্ডা করতে বঙ্গভঙ্গ রদ করার পাশাপাশি রাজধানী অন্য কোথাও স্থানান্তর করতে হবে।
অবিভক্ত ভারতবর্ষের নতুন রাজধানী হিসেবে ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নয়া দিল্লি যাত্রা শুরু করে। তবে এ যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। রাজা পঞ্চম জর্জের মাধ্যমে দিল্লি দরবার নামক রাজকীয় অনুষ্ঠানে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর নতুন রাজধানী হিসেবে নয়া দিল্লির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। এর ২০ বছর পর, ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড আরউইন নতুন রাজধানী হিসেবে নয়া দিল্লির উদ্বোধন করেন।
নিঃসন্দেহে শাহজাহানবাদ (পুরনো দিল্লি) ছিল মুঘল যুগের রাজধানী। কিন্তু তারপরও ব্রিটিশদের ধারণ করার মতো পর্যাপ্ত যোগ্যতা তখনও ছিল না এই শহরের। তাই দুই ব্রিটিশ স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েন্স ও স্যার হারবার্ট বেকারের উপর দেওয়া হয়েছিল শহরটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব। নতুন রাজধানীটিকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল তৎকালীন অবিভক্ত পঞ্জাব প্রদেশ থেকে এবং ১৯২৭ সালে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘নয়া দিল্লি’।
প্রাথমিকভাবে সকলে ভেবেছিল, নতুন রাজধানীটিকে প্রস্তুত করে ফেলতে প্রয়োজন হবে বড়জোর চার বছর। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে নষ্ট করে দেয় যাবতীয় পরিকল্পনা। তাই চার বছর শেষমেশ গিয়ে স্পর্শ করে বিশ বছরে। প্রথম বিশযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশরাজ। তাই তাৎক্ষণিকভাবে নয়া দিল্লিতে নতুন কাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাদের হাতে ছিল না।
১৯১২ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের বসবাসের জন্য একটি সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংও তৈরি হয়ে যায় এবং রাইসিনা হিলসে স্থাপিত হয় উত্তর ও দক্ষিণ ব্লকগুলো। যেভাবে কাজ এগোচ্ছিল, তাতে লুটিয়েন্স ও বেকারের পক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলা খুব একটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল ও অর্থনৈতিক সংকটে খেই হারিয়ে ফেলেন তাঁরা, এবং নয়া দিল্লি পুরোপুরি সংস্কার হতেই লেগে যায় ১৯৩১ সাল। তারপরই সম্ভব হয়েছিল এটিকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের নতুন রাজধানী হিসেবে উদ্বোধন করা।
আরও পড়ুন- কালো জলের কুয়োর নিশির ডাক! দিল্লির এই প্রাচীন স্থাপত্য ঘিরে আজও দানা বাঁধে রহস্য
কী কারণে এই স্থানান্তর, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণগুলি হল-
১. কারণ হিসেবে প্রাধান্য পায় বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রসহ দিল্লির অবস্থান। কলকাতা যেখানে অবস্থিত দেশের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে, সেখানে দিল্লির অবস্থান দেশের উত্তরাঞ্চলে।
২. ব্রিটিশরাজের বিশ্বাস ছিল কলকাতা অপেক্ষা দিল্লি থেকেই সমগ্র ভারতবর্ষ শাসন করা তাদের জন্য সুবিধাজনক হবে।
৩. মূল কারণ হল কলকাতা থেকে দেশ শাসন করতে পারছিল না ইংরেজরা। কারণ আন্দোলনের দমক। তখন বঙ্গভঙ্গের জেরে আন্দোলনে ফুটছিল এই শহর। তাই ইংরেজদের রাজধানী সরাতে হয়েছিল।
ব্রিটিশ প্রজারা যাঁরা কলকাতায় থাকতেন ও ভারতের বিরাট বাণিজ্য পরিচালনা করতেন তাঁরা নিজেদের চারটি ইংরিজি কাগজের সাহায্যে- ইংলিশমান, স্টেটসম্যান, ক্যাপিটাল ও কমার্স দ্বারা নিজেদের অনুভূতি ও বাণিজ্যের অসুবিধার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ গভর্মেন্ট তাঁদের কোনও কথাই শুনল না I ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সব মিলিয়ে কলকাতা থেকে যাবতীয় প্রশাসন নয়া দিল্লিতে স্থানান্তরের পেছনে ব্রিটিশ সরকারের খরচ হয়েছিল চার মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড!
কলেজ স্কোয়ারে একটি জনসভায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন-
"future generation would point to December 12 as the start of a new epoch in Bengali History."
আজকে বোঝা যায় যে বাংলার দুরবস্থার শুরু এই দিন থেকেই হয়েছিল। রাজনৈতিক আসন টলে গেল, সঙ্গে অর্থনৈতিক রাজধানীও স্থানান্তরিত হলো। এটি হয়তো একটি ঐতিহাসিক ভুল যার সম্যক ধারণা সেদিন অনুভব করা যায়নি। তবে একটা কথা ঠিক, সেদিন বাংলার কপালে যাই লেখা হয়ে থাকুক না কেন এবং ব্রিটিশরা তাদের সুবিধার যা আয়োজনই করে থাকুক না কেন, মোদ্দা কথা হল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির বিরুদ্ধে এমন রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের যে দরকার ছিল, তা বলাই বাহুল্য। এর পরিণাম যাই হোক, ব্রিটিশ সরকারের ভিত নড়াতে সেদিন একটা সজোর ধাক্কার প্রয়োজন তো ছিলই। যার নাম বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন।