বাংলা সিনেমার শ্মশানযাত্রা! যে যে নিয়মে পুড়ছে সিনেমাপাড়া

Tollygunge Cinema Industry: ইনস্ক্রিপ্টকে পরিচালক সুব্রত সেন জানিয়েছেন, গত বছর মুক্তি পাওয়া বাংলা সিনেমার সংখ্যা ছিল ১৩২টি। এবছর বাংলা সিনেমা হয়েছে মাত্র ৩৭টি!

পর্ব ৪

টালিগঞ্জের চলচ্চিত্রজগতের সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাঁদের একটা বড় অংশের অভিযোগের মূলত দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমত তাঁরা মনে করছেন, বিনোদনের জগতে রাজনীতির দাদাগিরিতে সমস্ত শিল্পসমাজটিই বিষিয়ে গেছে। টাকার দুর্নীতি থেকে শুরু করে সরাসরি রাজনীতিতে চলচ্চিত্র কর্মীদের ব্যবহার করার পিছনে ব্যাপকভাবে ‘থ্রেট কালচার’ কাজ করেছে। আর এই সবটাই হয়েছে যোগ্যতাহীন স্বরূপ বিশ্বাসের নেতৃত্বে যিনি আবার চালিত হচ্ছেন তাঁর বিধায়ক দাদা অরূপ বিশ্বাসের নির্দেশে। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, এই হুমকির সংস্কৃতি এবং ফেডারেশনের অদ্ভুত নিয়মের জালে পড়ে খাবি খাচ্ছে বাংলা সিনেমা। বাইরের পরিচালকরা আর এখানে কাজ করতে চান না। রাজ্যের পরিচালকরা এই নিয়মের নিগড়ে হাঁসফাঁস করেন। ফেডারেশন ঠিক কোন কোন নিয়মকানুন চালু করেছে যার জেরে টালিগঞ্জে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে কাজ করাই হয়ে উঠেছে অসম্ভব?

১) ফেডারেশনের নিয়ম বলছে, একজন চলচ্চিত্রকর্মী যদি কোনও গিল্ডের সদস্য না হন তাহলে তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজই করতে পারবেন না। যদি একান্তই কাজ করেন, তাহলে সেই সমস্ত বিভাগে গিল্ডের লোকজনদের নেওয়ার পরে বাড়তি সদস্য হিসেবে তাঁকে নিয়োগ করা হবে। এই নিয়ম কিন্তু খোদ সংবিধান বিরোধী। ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় দেশের সমস্ত নাগরিকের আইনি যে কোনও কাজে নিজেদের ইচ্ছামতো নিযুক্ত হওয়ার অধিকার রয়েছে। কোনওভাবে কোনও ট্রেড ইউনিয়ন সেই অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। সহজ করে বলতে গেলে, কোনও সংস্থায় নিযুক্ত হওয়ার পর কোনও কর্মী তাঁর নিজের ইচ্ছামতো ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হতে পারেন, ইচ্ছে না থাকলে নাও হতে পারেন। এটা তাঁর নাগরিক অধিকার। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য নন বলে তিনি কোনও চাকরিই পাবেন না এটা ভারতের কোথাও ঘটে না এবং এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।

২) চলচ্চিত্রে আগ্রহী ও দক্ষ কোনও কর্মী আবার চাইলেই গিল্ডের সদস্য হতে পারবেন না। কেউ যদি মনে করেন, গিল্ডের সদস্য হওয়ার পরে তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করবেন সেখানেও তিনি আটকে যাবেন কারণ গিল্ডের সদস্যপদ সম্পূর্ণভাবেই গিল্ডগুলির সেক্রেটারি এবং সভাপতিদের ইচ্ছানুসারে দেওয়া হয়। টালিগঞ্জে গিল্ডের কার্ড পাওয়ার চেষ্টায় বহু যোগ্য কর্মী দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করে আছেন। এমনকী রাজ্য সরকার পরিচালিত রূপকলা কেন্দ্রের পড়ুয়ারাও গিল্ডের সভাপতি এবং সম্পাদকদের ইচ্ছা ছাড়া কার্ড পান না বলেই অভিযোগ। স্বাভাবিকভাবেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রভূত সমস্যায় পড়েন তাঁরা, যোগ্যতা সত্ত্বেও। টালিগঞ্জের অন্দরের খবর, ২০১৮ সালের পর থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর্স গিল্ড কোনও নতুন কার্ড ইস্যু অবধি করেনি।

প্রথম পর্ব- টলি কেলেঙ্কারি: সিনেমাপাড়ায় থ্রেট কালচারই শেষ কথা?

৩) এক অভূতপূর্ব নিয়ম রয়েছে ফেডারেশনের। বেশ কিছু গিল্ড সদস্যপদ দেওয়ার জন্য পরীক্ষা নেয়। গিল্ড বস্তুত একটি ট্রেড ইউনিয়ন। কোনওভাবেই ভারতের কোনও নাগরিকের কোনওরকম যোগ্যতার পরীক্ষা নেওয়ার কোনও আইনি অধিকার ট্রেড ইউনিয়নের নেই।

৪) ফেডারেশনের নিয়মে, প্রযোজক বা পরিচালক যদি গিল্ড মেম্বার নন এমন কর্মীদের নিজেদের ইউনিটে নেন, সেটা তাঁদের করতে হয় ফেডারেশন যে সংখ্যক মেম্বারদের নেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে সেই সংখ্যার পূর্তির পরেই। ফলে আবারও, প্রযোজনার খরচ অনেক বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিকভাবেই বহু যোগ্য মানুষকে পরিচালক বা প্রযোজকরা কাজ দিতেই পারেন না।

৫) অভিযোগ, যে যে নিয়মগুলি ফেডারেশন চালু করে রেখেছে সেগুলি নিয়ে ফেডারেশন WATP এবং EIMPA-র সঙ্গে দু’টি মেমারেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি করে রেখেছে। মজার কথা হলো, তারা নিজেরাও জানে যে এই MOU সম্পূর্ণ বেআইনি। ফলত কেউ সেখানে সই করেন না। নতুন নতুন নিয়ম তারা মৌখিকভাবে, কখনও হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের মাধ্যমে, কখনও প্রোডাকশন কন্ট্রোলারদের দিয়ে প্রযোজক বা পরিচালকদের জানিয়ে দেয়। ফেডারেশন একটি ট্রেড ইউনিয়ন হয়ে কীভাবে আইন তৈরি করতে পারে?

৬) সিনেমা, সিরিয়াল, ওটিটি- প্রটি মাধ্যমেই প্রত্যেক দিনের শুটিংয়ের জন্য কতজন কর্মী নিতে হবে ফেডারেশন ন্যূনতম সেই সংখ্যা নির্ধারণ করে রেখেছে। ফলে যে সমস্ত দৃশ্যের জন্য খুব ছোট ইউনিট নিয়েও কাজ সম্ভব সেখানেও ৭০-৮০ জনের ইউনিট নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সামান্য রাস্তার দৃশ্য শ্যুট করতে হলেও পূর্ণদৈর্ঘ্যের দ্বিতীয় ইউনিট নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে পরিচালকদের। সিনেমায় কোন ট্রলির ব্যবহার না থাকলেও দু’জনকে নেওয়া বাধ্যতামূলক করে রাখা হয়েছে। আউটডোর শুটিং হলেও একজন ক্যাটওয়াক কর্মী সেখানে নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ ক্যাটওয়াক কর্মীদের লাগে শুধুমাত্র স্টুডিওতে শুটিং করলেই। ফলে ইউনিটের আকার যত বাড়ে, ততই বেড়ে যায় শুটিংয়ের সময় এবং খরচাও। অভিযোগ, ব্যবসায়িক লাভ না থাকায় অনেক প্রযোজকই এগিয়ে আসেন না।

৭) সারা ভারতবর্ষ জুড়ে শুটিং শিফটের সময়সীমা হচ্ছে ১০ ঘণ্টা। একমাত্র কলকাতায় শিফটের সময়সীমা ৮ ঘণ্টা করে রাখা হয়েছে। এর ফলেও কলকাতায় শুটিং করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।

৮) বাংলা ছাড়া যে কোনও ভারতীয় ভাষায় শুটিং হলে গিল্ড কর্মীদের দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দেওয়ার নিয়ম চালু আছে এখানে। ইংরেজি বা যেকোনও বিদেশি ভাষায় শুটিং হলে পারিশ্রমিক তিনগুণ। বিজ্ঞাপন ফিল্মের জন্য পারিশ্রমিক দ্বিগুণ। এই নিয়মগুলির ফলে কলকাতার বাইরের কোনও প্রোডাকশন কোম্পানি নিতান্ত বাধ্য না হলে এখন আর কলকাতায় শুটিং করতে চায় না। অভিযোগ, বাইরে থেকে আসা কাজের পরিমাণ অত্যন্ত কমে যাওয়াতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন টেকনিশিয়ানরাই।

৯) সারা পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী, যে জায়গায় শুটিং শুরু সেইখানে পৌঁছনোর পর থেকে শিফটের সময় শুরু হয়। অথচ টালিগঞ্জের নিয়মে, শুট যেখানেই হোক না কেন, শিফটের ঘড়ি শুরু হয় টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে রিপোর্ট করার টাইম থেকে। এর ফলেও শুটিংয়ের খরচা অনেকটা বেড়ে যায়।

১০) যদি কলকাতার কোনও প্রোডাকশন, অন্য কোন রাজ্য থেকে কোনও বিশিষ্ট বিভাগীয় প্রধান যেমন ক্যামেরাপার্সন বা প্রোডাকশন ডিজাইনার বা মেকআপ শিল্পী নিয়ে আসে (এবং তাঁরা যদি সর্বভারতীয় ফেডারেশনের সদস্যও হন) তারপরও কলকাতা থেকে এই প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদা লোক নিতেই হবে। সেই সমস্ত সদস্যরা শুটিংয়ে এসে বসেই থাকবেন কিন্তু গিল্ড নির্ধারিত পূর্ণ পারিশ্রমিক তারা পান। স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন থাকলেও এই কারণেই ভারতবর্ষের অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি থেকে কোনও টেকনিশিয়ানকে টালিগঞ্জে ব্যবহার করতে পারা যায় না বলেই অভিযোগ পরিচালকদের একাংশের।

১১) কোনও প্রোডাকশন সংস্থা যদি বিদেশে শুট করতে চায়, তাহলে বাধ্যতামূলকভাবে সেই সংস্থাকে কলকাতা থেকে ১৯ জন গিল্ড সদস্যকে নিয়ে যেতেই হবে। এমনকী সেই সব দেশেও এদের নিয়ে যেতেই হবে যেখানে এই সমস্ত বিভাগের কর্মীদের স্থানীয়ভাবে পাওয়া খুব সহজ। এই ১৯ জনের টিকিট, ভিসা, হোটেল ও খাবার খরচ ইত্যাদি জুড়ে যাওয়ার ফলে বাংলা সিনেমার বিদেশে শুটিং করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

দ্বিতীয় পর্ব- টলি কেলেঙ্কারি: স্বরূপ বিশ্বাসের উত্থান কখন, কীভাবে, কতটা?

১২) পরিচালকদের অনেকেই জানিয়েছেন, ফেডারেশন সম্প্রতি কম বাজেটের সিনেমার জন্য কিছু নিয়ম চালু করেছে। ফেডারেশন স্থির করেছে কম বাজেটের সিনেমার ঊর্ধ্বতম বাজেট ৩০ লক্ষ টাকা। কেন ৩০ লক্ষ ধরা হলো, এর কোনও হিসেব ফেডারেশন প্রকাশ করেনি। ফেডারেশন এক্ষেত্রে গিল্ডের কর্মী সংখ্যা কিছুটা হ্রাস করেছে ঠিকই তবে এও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে যে এই সব শুটে Alexa, Venice-এর মতো উচ্চমানের ক্যামেরা ব্যবহার করা যাবে না। কারণ তাহলেই সেটা আর কম বাজেটের সিনেমা হবে না। এই অধিকার কি ফেডারেশনের আছে? প্রশ্ন তুলেছেন পরিচালকরা।

১৩) সম্প্রতি বহু ওটিটি প্লাটফর্মের জন্য সিরিজের শুটিং হচ্ছে কলকাতা শহরে। সেখানেও ফেডারেশন নিয়ম করেছে, টেলিভিশন সিরিয়ালের মতো একদিনে ১৪ ঘণ্টার বেশি শুটিং করা যাবে না। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে ১৪ ঘণ্টার নিয়মের যথেষ্ট যুক্তি আছে কারণ সেখানে সারা বছর ধরেই শুটিং হয়। এই পরিশ্রমের পর কর্মীদের বিশ্রামের প্রয়োজন থাকে। কিন্তু ওটিটির কাজ ১৫ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে শেষ হয় এবং সেটা সিনেমার মতোই একটি নির্দিষ্ট প্রজেক্ট। সেখানেও এই নিয়ম চালু থাকার ফলে যে কোনও ওটিটি-র কাজের খরচ বহুগুণ বেড়ে যায়।

১৪) অভিযোগ, ফেডারেশন নিজের সুবিধামতো নানা সময় ইন্ডাস্ট্রিতে ছুটি ঘোষণা করে দেয়। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানের জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে চালু থাকা দ্বিতীয় রবিবারের ছুটি বাতিল করে অন্য একদিন ছুটি ঘোষণা করেছে বলেও জানা গেছে। বহু প্রোডাকশনে নানা বিষয়ের পরিকল্পনা অনেকমাস আগেই করা থাকে। অনেকক্ষেত্রেই বাইরে থেকে শিল্পী আসেন। কখনও বিশেষ দিনে নির্দিষ্ট লোকেশন অনেক টাকা খরচ করে আগেভাগে বুক করে রাখা হয়। অভিযোগ, ফেডারেশন এক্তিয়ার বহির্ভূতভাবে ছুটির দিন বদলালে এই সমস্ত প্রোডাকশনের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি ঘটতে থাকে।

১৫) সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে ফেডারেশন বিভিন্ন শুটে নানান বিভাগে নিজেদের ইচ্ছেমতো কর্মী পাঠাচ্ছে, যা টালিগঞ্জে আগে কখনও হয়নি। কর্মী নির্বাচন সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করত প্রযোজক, পরিচালক এবং প্রোডাকশন কন্ট্রোলারের উপর। কিন্তু কাজ কমে যাওয়া, অযোগ্য সদস্যকে নতুন সদস্য পদ দেওয়ার ফলে ফেডারেশনের দায় হয়েছে এই সমস্ত লোকেদের কাজ দিতে বাধ্য থাকা। এই কাজের বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকা মানুষরাও কাজ করেন, টাকা পান অথচ তাদের থেকে কোনওরকম পেশাদারি সাহায্য পাওয়া অসম্ভবই হয়ে ওঠে।

এই অপেশাদার মানুষদের জন্য খরচ বেড়ে যাওয়াতে সমস্যায় পড়েন পরিচালক এবং প্রযোজকরাই মূলত। তাহলে এমন অদ্ভুত নিয়ম মেনে নেন কেন তাঁরা? কেন প্রযোজকরা এই নিয়ে কিছু বলেন না? অতীত ঘাঁটলেই দেখা যাবে, ফেডারেশনের দাদাগিরিতে বড় প্রযোজনার ব্যানারে হতে চলা সিনেমার বিদেশে শুটিং অবধি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনের প্লিমাথের কাছে টরকো-য় হিমাংশু ধানুকা প্রযোজিত একটি বাংলা সিনেমার শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়া হয় রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই তথা ‘ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’র সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের আপত্তিতেই। ফেডারেশনের নিয়ম মেনে ১৯ জন টেকনিশিয়ানই নিয়ে যেতে হবে বাইরে। সেই সময় ভিসা পেয়েছিলেন ১৭ জন। সেই আপত্তিতেই আটকে যায় শ্যুটিং। এত বড় প্রযোজনার সিনেমাই যদি আটকে দেওয়া হয় নিয়মের বেড়াজালে, তাহলে সহজেই অনুমেয় ছোট বহরের সিনেমার ক্ষেত্রে কতখানি ভয়ে ভয়ে কাজ করতে হয়!

টালিগঞ্জের দীর্ঘদিনের এক প্রযোজক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, কোনও প্রযোজকই এই নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারবেন না কারণ বললেই, তাঁর কাজ করাই বন্ধ করে দেওয়া হবে নানা উপায়ে। ওই প্রযোজক বলছেন, "পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা তো জানেনই। দীর্ঘদিন ধরে এখানে মুম্বই থেকে কাজ করতে আসার সংখ্যা কমছে। এখানে এত ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও তা সারা ভারতের কাছে আর পৌঁছতেই পারছে না এই ঝামেলার কারণে। এখানে ৮ ঘণ্টার শিফট, ফলে সময় লেগে যায় শুটিং সারতে। বাইরে কোথাও এই নিয়ম নেই। ফলে বাংলা সিনেমার পরিমাণও কমে যাচ্ছে দ্রুত।"

তৃতীয় পর্ব- টলি কেলেঙ্কারি: বিস্ফোরক হিসাব খাতা ফাঁস! চরম দুর্নীতি সিনেমাপাড়াতেও?

বাংলা সিনেমার সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে আঁতকে ওঠার মতো পরিসংখ্যান দিয়েছেন পরিচালক সুব্রত সেন। ইনস্ক্রিপ্টকে সুব্রত জানিয়েছেন, গত বছর মুক্তি পাওয়া বাংলা সিনেমার সংখ্যা ছিল ১৩২টি। এবছর বাংলা সিনেমা হয়েছে মাত্র ৩৭টি! তাহলে বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর যে আকুতি শোনা যায়, সেই সিনেমাই যদি বন্ধ হয়ে যায় সার্বিকভাবে বিনোদন শিল্পের ভবিষ্যৎ তাহলে কী? ফেডারেশনের লক্ষ্য এর সঙ্গে জড়িত কলাকুশলীদের কল্যাণসাধন এবং বাংলা সিনেমার উন্নতি। সেখানে এই হুমকির সংস্কৃতিতে পড়ে সিনেমার নিজস্ব সংস্কৃতিই তো শ্মশানগামী প্রায়! পরিচালক সুব্রত জানাচ্ছেন, একবছর আগেও, প্রত্যেকদিন ৪৫টি সিরিয়ালের কাজ হতো। এখন সেই সংখ্যাটা নেমে দাঁড়িয়েছে ২৯-এ! সুব্রত সেন বলছেন, "দ্রুত প্রযুক্তি বদলাচ্ছে। এই বদলে যাওয়া প্রযুক্তির সঙ্গে টেকনিশিয়ানদের পরিচিত করার, দক্ষ করে তোলার কাজ তো ফেডারেশনেরই। সেই দিকে হেলদোল নেই। ট্রলির কাজ এখন কমে গেছে অনেকাংশে। বাড়ছে গিম্বল অপারেশনের কাজ। তাহলে ট্রলির কর্মীরাই যাতে গিম্বল অপারেশনের কাজও শিখতে পারেন, এই দায়িত্ব ফেডারেশনের নেওয়া উচিত। কন্টিনিউটির জন্য আগে স্টিল ফটোগ্রাফি ছিল বাধ্যতামূলক। এখন প্রচারের কারণে বিহাইন্ড দ্য সিন ভিডিও দরকার পড়ছে, সেই জন্য লোকও দরকার পড়ছে। স্টিল ফটোগ্রাফারদেরই যদি বিটিএস শুটিংয়েও ব্যবহার করা যায় তাহলেই একটা ধাপ উন্নতি হয়। অথচ সেই আসল বিষয়গুলি ফেডারেশনের কাছে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত।"

একটি বিষয় পরিষ্কার করে জানিয়েছেন প্রযোজক থেকে পরিচালক সকলেই। নতুনদের কাজ করা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে এই শিল্পজগতে। যে যত দুর্বল, তাঁকে ভয় দেখানো ততই সহজ। ফলে বছরে সিনেমার সংখ্যা কমে তলানিতে ঠেকে যাওয়া নিয়ে হা-হুতাশ করার আগে মাথায় রাখতে হবে, এর নেপথ্যের দীর্ঘ দুর্নীতি, হুমকি এবং ভয়ভীতির আবহকে। ফেডারেশনের এই অবাস্তব অযৌক্তিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে আইনের দ্বারস্থ হয়েছে পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া বা ‘ডিএইআই’। সংগঠন জানিয়েছে, টলিপাড়ার এই সমস্যা মেটাতে মুখ‌্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায় পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে কমিটির ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ারও কথা ছিল। চার মাসেও সেই কমিটি গঠনও করে ওঠা হয়নি। করার কথাও নয় কারণ সরকার ট্রেড ইউনিয়নের সমস্যা মেটাতে কোনও কমিটি আইনত তৈরি করতেও পারে না। পরিচালক তথা ডিএইআই-এর সভাপতি সুব্রত সেন জানিয়েছেন, তাঁদের তরফ থেকে মামলার সমস্ত কাগজপত্র দিল্লিতে ‘কম্পিটিশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া’র কাছে পাঠানো হয়েছে।

বাংলা সিনেমা বাঁচবে কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর সিনেমাপাড়া জানে কি? প্রশ্ন সহজ, উত্তরও তো জানাই। বিনোদনের নিজস্ব একটি রাজনীতি থাকে। কোনও কোনও শিল্পী আজীবন সেই পথে হাঁটেন। কেউ কেউ সহজ পথ বেছে নেন। সেই রাজনীতি কিন্তু দলীয় রাজনীতি নয়। অচলায়তন ভাঙার রাজনীতি। টলমলে এই সময়ে, পেশিশক্তি আর নেতাভক্তির শামিয়ানার তলায় কতজন পঞ্চক হয়ে উঠতে পারেন, সেটাই দেখার। 

More Articles