সেদিন আরএসএস-এর বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি শ্যাম বেনেগাল

Shyam Benegal: শ্যাম বেনেগাল বলছেন নেহরু ছাড়া আমদের দেশ হতো না অথচ মোদির নিন্দাও করতে চাননি তিনি।

৯০ বছর বয়সে শ্যাম বেনেগালের মৃত্যু হলো। ভারতে সমান্তরাল সিনেমা, নাগরিক পরিভাষায় যাকে আর্ট ফিল্ম বলে, তার অন্যতম স্থপতি শ্যাম বেনেগাল। এই সমান্তরাল সিনেমার প্রশ্নে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বহু কিংবদন্তি যথা আদুর গোপালকৃষ্ণন, জি অরবিন্দন, গোবিন্দ নিহিলানি বা জন আব্রাহামের পাশেই বসবে তাঁর নাম।

প্যারালাল সিনেমা মানে কী? মুখ্যধারা বা বলিউড সিনেমায় মনোরঞ্জনের নামে মানুষকে অন্য জগতে নিয়ে যায়। সেটা বাস্তব থেকে অনেক দূরের। নাচ, গান, মারপিট, সেক্স, ভায়োলেন্স, ট্র্যাজেডি, কমেডির হাত ধরে লোককে অন্য জগতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাস্তব থেকে দূরের জগত সেটা। ছবিতে ফুটে ওঠে ভারতীয় সমাজের জটিলতা, বাস্তবতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এবং বলা হয় যে ভারতবর্ষে সাধারণ মানুষ এই ধরনেরই ছবি দেখতে চান।

শ্যাম বেনেগালের মতো নির্দেশকরা মনে করতেন, আমরা এমন ছবি বানাতে পারি যা ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাস্তবের কাছাকাছি। যে ছবির জন্য দূরে যেতে হচ্ছে না। যারা দর্শক তারা ছবি দেখতে দেখতে অন্য জগতে যাচ্ছে না। আমাদের দেশের বাস্তবটা কী? আমাদের দেশের গরিব মানুষদের উপর শোষণ করা হয়। জাত-ধর্মের নামে শোষণ করা হয়। পুরুষ মেয়েদের শোষণ করে চলে। এই ধরনের সমাজনিবিড় বিষয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন শ্যাম।

ব্রিটিশ শাসনাধীন হায়দরাবাদে শ্যাম বেনেগাল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শ্রীধর বি বেনেগাল একজন ফটোগ্রাফার ছিলেন। ১২ বছর বয়সেই প্রথম ক্যামেরা ব্যবহার করতে শুরু করেন। হায়দরাবাদ ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হায়দরাবাদ ফিল্ম সোসাইটি। একটা সময় এফটিআইআই-তে পড়িয়েছিলেন। সেখানের চেয়ারম্যানও ছিলেন। তেলঙ্গনার আদি বাসিন্দা ছিল তাঁর পরিবার। পরিবারে শিল্প সংস্কৃতির ছোঁয়া ছিলই। শ্যাম বেনেগালের রক্তের ভিতরে সিনেমা ছিল। গুরু দত্ত বেনেগালের তুতো ভাই ছিলেন। তাঁর ঠাকুমা এবং গুরু দত্তের দিদিমা দুই বোন ছিলেন। শ্যাম বেনেগালের সাথে গুরু দত্তের ছোটবেলায় রেষারেষি ছিল। কারণ, ছোটবেলায় বেনেগাল মনে করতেন তাঁর তুতো ভাই গুরু দত্ত বেশি বিখ্যাত ছিল।

১৯৫৯ থেকে তিনি বিজ্ঞাপনের জগতে ঢুকে পড়েন। ৯০০-র বেশি ছোট বিজ্ঞাপন বানান এবং ৭০-এর বেশি তথ্যচিত্র এবং শর্ট ফিল্ম বানান। ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রথম ছবি 'অঙ্কুর' মুক্তি পায়। ২০২৩ সালে বেনেগাল শেষ ছবি তৈরি করেছিলেন 'মুজিব : দ্য মেকিং অ্যা নেশন'। প্রায় ২৫টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়েছিলেন শ্যাম।

অঙ্কুর মুক্তি পেতেই বিখ্যাত হয়ে যান তিনি। এই ছবিতেই প্রথম শাবানা আজমি অভিনয় করেন। অঙ্কুর ভারতের শ্রেণি ও লিঙ্গর বৈষম্যের এবং গ্রামীণ মহিলাদের সংগ্রামের ছবি ফুটে ওঠে। ছবির বিষয় এক দলিত মহিলার সঙ্গে বাড়িওয়ালার অবৈধ সম্পর্ক।

আরও পড়ুন -টানা ১১ বার পথের পাঁচালী দেখেছিলাম : শ্যাম বেনেগাল

অঙ্কুরের দু'বছর পর ১৯৭৫সালে 'নিশান্ত' মুক্তি পায়। 'নিশান্ত' অর্থাৎ রাতের শেষ। গ্রামীণ ভারতের যৌন শোষণের ছবি তুলে ধরে নিশান্ত। একজন শিক্ষকের স্ত্রীকে জমিদার ধর্ষণ করে। সরকার শিক্ষককে কোনো রকম সাহায্য করে না এটাই ছবিটার মূল বিষয়। পরের বছর, ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় 'মন্থন'। গুজরাতের ৫ লক্ষ কৃষক দু'টাকা করে দিয়েছিল মন্থন। ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে এই ছবিটি বানানো হয়েছিল। গুজরাতের ডেয়ারি শিল্প,  আমুল ও মাদার ডায়েরি প্রতিষ্ঠাতা ভার্গিস কুরেন-এর উপর এই ছবি নির্মিত হয়। আমূল দুধ সংগ্রহ করার একটা সমবায় সমিতি কীভাবে গঠন করা হয়, তাই তুলে ধরেন বেনেগাল।

১৯৭৭ সালে তাঁর চতুর্থ সিনেমা 'ভূমিকা' মুক্তি পায়। খ্যাতনামা মারাঠি অভিনেত্রী হানসা ওয়াদকরের প্রথাভাঙা আপোষহীন জীবন কাহিনি নিয়ে নির্মিত এই ছবি। ছবিতে মূল চরিত্রে ছিলেন স্মিতা পাটিল। প্রথম প্রথম চারটি ছবিতেই (অঙ্কুর, নিশান্ত, ভূমিকা, মন্থন) তিনি একাধিক বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যেমন প্র‍্য়াত ওম পুরী, স্মিতা পাটি  এবং নাসিরুদ্দিন শাহ, কুলভূষণ খারবান্দাদের সিনেমা জগতের সঙ্গে পরিচয় করান। এরা সকলেই এফটিআইআই এবং এনএসডি তে পড়াশোনা করেছিলেন।

শশী কাপুরকে নাম ভূমিকায় রেখে শ্যাম তৈরি করেছিলেন জুনুন (১৯৭৮), মহাভারতের গল্প অবলম্বনে তৈরি করেছিলেন কলিযুগ (১৯৮১), স্মিতা পাটিল এবং  শাবানা আজমির অনবদ্য অভিনয়ে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে হায়দরাবাদের যৌনপল্লির আখ্যান মান্ডি (১৯৮২)। শ্যাম সত্যজিৎ রায়, জহরলাল নেহেরু উপর তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের জীবন নিয়ে 'বোস: দ্য ফরগটেন হিরো চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন।

১৯৮৮ সালে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ার উপর নির্ভর করে নির্মিত করেন 'ভারত এক খোঁজ'। তিনজন মুসলমান মহিলার জীবন কেন্দ্র করে তিনটি ছবি বানিয়েছিলেন। মামো (১৯৯৪), সর্দারি বেগম (১৯৯৬), জুবেইদা (২০০১)।

আরও পড়ুন- নিরাপদ নির্মাণ: শ্যাম বেনেগালের সিনেমা

সারাজীবন অজস্র সম্মান পেয়েছেন শ্যাম। জাতীয় পুরস্কার-সহ পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২ সালে তাঁকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৮ বার ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যওয়ার্ড পেয়েছেন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে অ্যওয়ার্ড দেওয়া হয়। সিনেমার জগতে সবচেয়ে বড় সম্মান এটি।

২০২৩ সালের জুলাই মাসে শ্যাম বেনেগালের একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সাক্ষাৎকারটি দু'ঘণ্টার, তিন ভাগে এটা প্রকাশ হয়েছিল। বর্তমান ভারতে যারা ক্ষমতায় রয়েছে তারা যেভাবে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানাতে চাইছে এবং সেই প্রক্রিয়া এখনও চলছে। আমি ভেবেছিলাম, শ্যাম বেনেগাল এদের নিন্দা করবেন। কিন্তু তিনি করলেন না। একদিকে এই বিজেপি সরকার জহরলাল নেহরুকে পছন্দ করে না। অন্যদিকে শ্যাম বেনেগাল বলছেন নেহরু ছাড়া আমাদের দেশ হতো না। অথচ বেনেগাল মোদির নিন্দাও করতে চাননি। আরএসএস-এর বিরুদ্ধে কথা বলতে চাননি। আমি কিছুটা হতাশ হয়েছি। আমার মেয়ে আমার সঙ্গে গিয়েছিল। সে আমাকে বলছে, তুমি কেন এই আশা নিয়ে গিয়েছিল? উনি তো ভারত সরকারের টাকা নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন। এনএফডিসি (ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন) ভারত সরকারের। হ্যাঁ, এই হতাশা আমার ব্যক্তিগত। তবে, দিনের শেষে, শ্যাম বেনেগাল অসাধারণ চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন। মানতেই হবে, শ্যাম সমান্তরাল সিনেমার অগ্রদূত ছিলেন।

More Articles