ভয়ংকর ভূস্বর্গে ফেলুদা এত নিষ্প্রভ, আড়ষ্ট কেন?

Bhuswargo Bhayankar: রায় পরিবারের অনুমোদনের নিরিখে এটিই তাঁর ফেলুদাকে নিয়ে শেষ ছবি।

ফেলুদা প্রথম দেখা দিয়েছিলেন ১৯৬৫ সালের 'সন্দেশ' পত্রিকায়, ডিসেম্বর সংখ্যায়। গল্পের নাম 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি'। সেই হিসেবে ফেলুদা এবার ৬০ বছরে পা দিলেন। এ বছর শেষ হতে না হতেই মুক্তি পেল 'ভূস্বর্গ ভয়ংকর'। পরিচালনায় সৃজিত মুখার্জি। যদিও সিরিজের মূল নামে ওই ঐতিহ্যের বিস্তার। 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি'। বিশেষ প্রদর্শন হলো গত ১৯ ডিসেম্বর প্রিয়া সিনেমায়। কেননা, এটি একটি ওটিটি. প্ল্যাটফর্মের ধারাবাহিক হিসেবে দেখানো হবে হইচই-তে। 

ছবি শুরুর আগে সেকথা মনে করিয়ে দিলেন পরিচালক। মে-ফ্লাইয়ের একদিনের আয়ুষ্কালের তুলনা টেনে জানালেন, সিনেমা হিসেবে 'ভূস্বর্গ ভয়ংকর'-এর বয়স মাত্র একদিন। রায় পরিবারের অনুমোদনের নিরিখে এটিই তাঁর ফেলুদাকে নিয়ে শেষ ছবি। যদিও অভিনেতারা এবং দর্শকবৃন্দ এই ঘোষণায় যৎপরোনাস্তি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। 

ওটিটি-র জন্য নির্মিত বলেই হয়তো, চরিত্রলিপি এবং নাম তালিকার চিরাচরিত ছায়াছবি প্রকরণ এখানে দেখা যায়নি। এর আগে সৃজিত যে ত্রয়ী এবং চলচ্চিত্র কৌশল ফেলুদার ছবিতে ব্যবহার করেছেন, সেই ধারা অব্যাহত। অর্থাৎ, একটা সিপিয়া বা পুরনো দিনের কালার টোন এবং নবায়িত থিম সং যার কাঠামো অটুট। এবারে গেয়েছেন, শিলাজিৎ, অনিন্দ্য আর সিধু। 'নয় অপেক্ষা নয় রে আর, বাঁধলো কাণ্ড ধুন্ধুমার...।' 

আরও পড়ুন- কেন হু হু করে কমছে ফেলুদা-ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তা, কতটা দায় টলিউডের পরিচালক ও প্রযোজকদের?

প্রথমেই বলে রাখি, আমার ভালো লেগেছে সব-মিলিয়ে। একথাও স্পষ্ট করে জানানো ভালো, মহাকায় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলনায় গিয়ে খুব লাভ নেই। নতুনের স্বীকৃতি এবং তার সঙ্গে সংলাপ, সমালোচনা, বিবাদ-বিতর্ক এবং বিনিময়ের মধ্য দিয়ে নতুনকে স্বাগত জানানোই সমীচীন, হয়তো ভবিতব্যও। নতুবা, ফেলুদা-ফিল্মগুলির গায়ে ন্যাপথলিন লেগে যাবে। 

এই যে 'ভূস্বর্গ ভয়ংকর' ছবিটি, তার সঙ্গে কোথাও কোথাও আমার দ্বিমত আছে। বলব সে কথা। কিন্তু, বাতিল একেবারেই করব না। কেননা, ফেলুদা যদি আগামীদিনে সেসব কূটভাষ্যে জর্জরিত হয়ে রুপোলি পর্দা থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তাহলে এক জীবন্ত কিংবদন্তি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এমনিতেই কথাবার্তা বলে যেটুকু বুঝলাম সেদিন, ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত 'ভূস্বর্গ ভয়ংকর' দাস্তানটি শিশু-কিশোরদের বেশ বড় অংশের কাছেই অজানা। জানি না, ইংরেজি-লালিত নতুন প্রজন্মকে ধরতেই কিনা, এ ছবিতে মাত্রাতিরিক্ত ইংরেজির অনুপ্রবেশ। ইদানীং, বহু বাংলা ছবিতেই দেখছি, বাংলা সংলাপের ইংরেজি সাব-টাইটেল, কিন্তু বড় বড় ইংরেজি কথাবার্তা অংশগুলি সাব-টাইটেলহীন। বাংলা সাবটাইটেলের এই অনুপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধাঁচে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, 'কে দেখায়, কে দেখে'। আগামীদিনে তর্জমায় ফেলুদা-সিনেমা বানানো হলে আশ্চর্য হব না। তবুও ফেলুদাকে চাই। চাইব। 'বাংলা'-য়।

পুরো সিনেমা জুড়ে সৃজিত অবশ্য দুর্নিবার উৎসাহে ফেলুদা পরম্পরাকে জাপটে ধরতে মরিয়া চেষ্টা করেছেন। আমরা যারা সাত-আট দশকে কৈশোর কাটিয়েছি, তাদের কাছে ফেলুদা অস্তিত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছেলেদেরই বেশি, নিঃসন্দেহে। তারই টানে এই ছবিতে নানা ফেলুদার এক মালা গেঁথে তুললেন সৃজিত। সঙ্গ-অনুষঙ্গে উপন্যাস এবং রুপোলি পর্দা মিশে যেতে লাগল, শুধু দৃশ্যে নয় ইশারা এল ইঙ্গিতেও। সেই ইশারায় কখনও ভেসে এল আবহসঙ্গীত, কখনও শট বা ফ্রেম। অনবদ্য কিছু ইঙ্গিতবাহী মুহূর্ত তৈরি হলো, ঘোড়ায় জটায়ুর ওঠার সময়, কিংবা ফেলুদার শীর্ষাসনের পা দেখানোর মুহূর্ত। কখনও কখনও অবশ্য আমার মনে হয়েছে, ছবিটি আরেকটু বিস্তার পেতে চাইছে। এডিটিং প্রায়শই জবরদস্তি করে নানা অংশ উড়িয়ে দিয়েছে। আমি ভুলও হতে পারি, কিন্তু সিদ্ধেশ্বর মল্লিকের সঙ্গে প্রথম আলাপের অংশটা মনে হলো, অনেকটাই কাটা গেছে। সময় বিষয়ে এত কড়াকড়ি কেন? ছবি তো খুব বড় নয়।

আরও পড়ুন- কলকাতায় সত্যিই রয়েছে ফেলুদার বাড়ি?

মূল গল্পের সঙ্গে একটা ছোট্ট উপকাহিনি এ ছবিতে জুড়ে দিয়েছেন সৃজিত। সেই সূত্রে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, সীমা সুরক্ষা বল, পুলিশ এবং ফেলুদার প্রথমে সংঘাত এবং পরে মৈত্রী। সেইসূত্রে হালকা জাতীয়তাবাদ, সামান্য পাকিস্তান আগ্রাসন এবং শেষ দৃশ্যের চমক! সব কিছু খোলসা করে বলব না, তাহলে উত্তেজনা ফুস্‌ হয়ে যাবে। ফলে, সেটির সুপ্রযোজ্যতা নিয়ে কিছু করতালি, কিছু সংশয় খোলসা করলাম না। তবে এখানে একটা বুদ্ধিদীপ্ত সংযোজন আছে। বিশ্বের যে কোনও আখ্যান নির্মাতা তথা নাট্যকার অবরে-সবরে নানা উপাদান গ্রহণ করেন নিজের জীবন এবং অভিজ্ঞতা থেকে। এই কাহিনিতে যেমন সত্যজিৎ এনেছিলেন 'প্রয়াগ' নামের এক চরিত্রকে। পরিচারক এবং প্রয়াগ বললেই মন চলে যায় 'যখন ছোট ছিলাম'-এর পৃষ্ঠায়। 'বুড়ো চাকর' প্রয়াগ আর উশ্রী নদীর কথায়। তারই সমান্তরে এই ছবিতে সৃজিত নিয়ে এসেছেন একে ফর্টি সেভেন হাতে (নাকি কালাশানিকভ?) একটি গম্ভীর চরিত্র যার নাম বংশী চন্দ্রগুপ্ত। যিনি সত্যজিৎ রায়ের নির্ভরযোগ্য শিল্প নির্দেশক ছিলেন। এছাড়াও স্মরণীয় কাজ করেছেন মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, কুমার সাহানি, তরুণ মজুমদার এবং অপর্ণা সেনের সঙ্গে। ৩৬ চৌরঙ্গী লেন সিনেমায় প্রথমেই ফুটে উঠেছিল - 'To Bansi'। সত্যজিতের জীবনতথ্যকে ঘুরিয়ে একই কায়দায় ব্যবহার করলেন সৃজিত। 

ছবিতে একটা দুর্দান্ত উপস্থিতির নাম - 'কাশ্মীর'। তার পর্বতশৃঙ্গ, নদী, সানুদেশ, উপত্যকা, তুষারাবৃত শিখরসমূহ এবং দীর্ঘ বৃক্ষরাজি চোখ জুড়িয়ে দেয়। সৃজিতের একটি সিগনেচার শট আছে, টপ অ্যাঙ্গেল থেকে ট্রলিতে দ্রুত এগিয়ে দৃশ্যকে আনুভূমিকে ধরা। কাশ্মীর সূত্রে এই ধরনের শট চমৎকার দৃশ্যকল্প এবং উন্মোচন উপহার দিয়েছে। ড্রোন শটগুলিও ভালো। অভিনেতাদের মধ্যে অনির্বাণ চক্রবর্তী (জটায়ু) সপ্রতিভ এবং নিজস্বতায় উজ্জ্বল, এই ছবিতে তোপসে কল্পন মিত্র আগের তুলনায় যথেষ্ট সাবলীল। রজতাভ দত্ত বেশ ভালো। পুত্রের ভূমিকায় শাওন চক্রবর্তী তো মনে রাখার মতো। রজতাভ-শাওন জুটিও বেশ মনোগ্রাহী। দেবেশ চট্টোপাধ্যায় প্ল্যানচেটের টেবিলে ছাপ ফেলে যান। অন্যত্র তাঁর খুব কিছু করার ছিল না। ফেলুদা চরিত্রে টোটা রায়চৌধুরী যেন খানিকটা নিষ্প্রভ এবং আড়ষ্ট। 'ছিন্নমস্তার অভিশাপ'-এ তিনি একটু আড়ষ্ট থাকলেও সর্বদা চোখে পড়েনি। এখানে তাঁর হাসিও যেন একটু মাপা। তিনি যেন অভিনয়ের মধ্যে থেকেও একটু উদাসী। 

শেষ পর্বে রহস্য উন্মোচনের বৈঠকে তাঁর অভিনয় ফিরে আসে সেই স্বাচ্ছন্দ্যে এবং ছবি উতরে যায়। 'টিনটোরেটোর যিশু' ছবিতে তাঁকে অনেক নির্ভার মসৃণতায় অভিনয় করতে দেখেছিলাম। ফেলুদার ভূমিকায় তিনি কেন অভিব্যক্তি এমনকী হাসির ক্ষেত্রেও সংযত হয়ে থাকছেন, জানি না। প্রশংসনীয় স্বাভাবিক অভিনয় করেছেন ঋদ্ধি সেন এবং প্রয়াগ চরিত্রের অভিনেতা। স্বপ্ন দৃশ্যটি অতিরিক্ত দীর্ঘ। নাকি শুধুই অতিরিক্ত বলব?

আরও পড়ুন- নিছক গোয়েন্দা নয়, সে ‘সত্যান্বেষী’! কেন নিজেকে এমনটা বলত শরদিন্দুর ব্যোমকেশ?

সৃজিত একইসঙ্গে মৃত্যুদণ্ড এবং অপরাধ নিয়ে মৌলিক প্রশ্নও তুলতে চেয়েছেন। আমি তো মূল উপন্যাস থেকে তাঁকে এক ধাপ এগিয়ে হয়তো বা বিচারব্যবস্থার ফাঁক ফোকর এবং ব্যক্তিগত রায় দিয়ে মৃত্যুর দিকে মানুষকে ঠেলার ভ্রান্তিবিলাস প্রসঙ্গে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। পুলিশি তদন্তের একমাত্রিকতা নিয়েও একটু ব্যঙ্গ আছে। আবারও বলছি, ছবির দ্রুততা অনেক সময় চরিত্র এবং সংঘাতের বাস্তবতাকে দৃঢ়প্রোথিত হতে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। বরং শেষাংশে ছবিটি অনেক জমাট বেঁধেছে। সেখানেই সৃজিতের সিদ্ধি। নেশা, নেশাগ্রস্ততা, রিহ্যাব এবং মানুষের সর্বনাশ পরিণতির দিকে তাঁর ইঙ্গিতও ছবিতে ধরা পড়তে দেখি। বিশাল বিপুল হিমালয় যেন সেই ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তিকেই চিহ্নিত করে। ব্যক্তি থেকে বিশ্বে উত্তরণের কথা বলে।

সৃজিত পরে আবার ফেলুদা সিনেমা করুন, এটাই মনোবাসনা। তবে তাঁকে দু'টি অনুরোধ। প্রথমত, তোপসের মুখে আরও বেশ কিছু সংলাপ চাই। অ্যাকশনও। দ্বিতীয়ত, লালমোহনবাবু প্রধানত 'হাস্যকর' এক চরিত্র, কিন্তু তাঁর 'অতিরিক্ত' এক মাত্রাও বর্তমান। 'ভূস্বর্গ ভয়ংকর' উপন্যাসের শেষে জটায়ু একটি মোক্ষম প্রশ্নে ফেলুদাকে কাত করে দেন। ফেলুদা ব্যঙ্গ দিয়ে আক্রমণ ঢেকে তারপর একটু ওভারস্মার্ট উত্তর দিয়ে কোনওক্রমে ম্যানেজ করেছেন। এক্ষেত্রে, ভ-এর অনুপ্রাস তথা বারংবার ফেলুদাকাহিনিতে অনুপ্রাসের নামকরণ তো জটায়ুর পথেই! বহুমাত্রিক সেই জটায়ুকে ধরাই আসল চ্যালেঞ্জ!

'সোনার কেল্লা' জুড়ে ছিল মরুভূমি আর বালি। কাশ্মীরে ফেলুদার চতুর্দিকে পর্বতমালা আর শ্বেতশুভ্র তুষার। ফেলুদার সঙ্গে আমরা ভ্রমণপিপাসুরা শুধু রহস্য নয়, বিশ্ব-রূপেরও দর্শনার্থী। ওদিকে গ্যাংটক, কেদারনাথ আর এদিকে কলকাতা, পরের বার কোথায় নিয়ে যাবেন সৃজিত?

More Articles