জালিয়ানওয়ালাবাগ প্রথম নয়, ১৫০০ আদিবাসীকে গণহত্যার আতঙ্ক আজও তাড়া করে এই গ্রামকে
Mangarh Massacre: সন্ধে নামার পর ব্রিটিশ এজেন্ট হ্যামিল্টন সাহেবের আদেশ পেয়েই ঝলসে ওঠে সেসব আগ্নেয়াস্ত্র। মুহূর্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চল। লুটিয়ে পড়ে প্রায় দেড় হাজার দেহ।
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। জালিয়ানওয়ালাবাগে জড়ো হয়েছেন প্রায় ১৫-২০ হাজার ভারতীয়। তাঁদের অধিকাংশই শিখ সম্প্রদায়ের। ভারতীয়রা সেখানে একত্র হয়েছেন পঞ্জাবি নববর্ষ উদযাপন করতে। পঞ্জাবের নবান্ন উৎসব পালনের পাশাপাশি তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল দমন-নিপীড়নমূলক রাওলাট আইনের বিপক্ষে প্রতিবাদ জানানো। এই আইনের ফলে খর্ব হয়েছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শুরু হয় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার এবং অনির্দিষ্ট সাজার অন্যায্য সুযোগ। ফলে সাধারণ মানুষ এককাট্টা হয়ে নির্বিচারে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ ছাড়া জাতীয় দুই নেতা সত্য পাল এবং ড. সইফুদ্দিন কিশ্লের নির্বাসন আদেশ প্রত্যাহার করার দাবি জানান তাঁরা। বৈশাখী উৎসব পালন করতে আসা জনতা তখনও জানে না কী অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য।
হঠাৎ করেই বাগানে ঢুকে পড়েন ৫০ জন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা। কর্নেল রেজিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে সাধারণ নাগরিকদের বাগান থেকে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আদেশে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে সৈনিকেরা। টানা ১০ মিনিটে প্রায় ১৬৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে তারা। কী হচ্ছে তা বুঝে ওঠার আগেই প্রাণ হারায় উপস্থিত জনতা। পালানোর পথ না পেয়ে দেওয়াল বেয়ে উপরে উঠে অন্য পাশে যাওয়ার চেষ্টা করে অনেকে। কেউ সফল হয়ে কোনওমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে যান, কেউ ব্যর্থ হয়ে প্রাণ হারান। বুলেটের আঘাত থেকে বাঁচতে অনেকে কুয়োয় ঝাঁপ দেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেন। ব্রিটিশদের হিসাবে এই হত্যাকাণ্ডে নিহত হয় ৪০০ জন। কিন্তু ভারতীয়দের হিসাবে তা ১ হাজারের কাছাকাছি।
ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যতম কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড এইটি। কিন্তু ফিরে যেতে হবে আরও ৬ বছর আগে। প্রায় একই রকমভাবে ব্রিটিশ সেনা ১৫০০ আদিবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করে সেদিন। পঞ্জাবের এই হত্যাকাণ্ডের বছর ছয়েক আগেই আরও এক গণহত্যার সাক্ষী হয়েছিল ভারত। সেবার অকুস্থল ছিল রাজস্থান। প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় ১৫০০ ভিল আদিবাসী। কিন্তু কেন রক্ত ঝরাতে হয়েছিল তাঁদের? কীসের দাবিতেই বা বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন তাঁরা?
আরও পড়ুন- চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দি মানুষ! কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী ওটা বেঙ্গার কাহিনি সভ্যতার লজ্জা
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এই এলাকায় প্রায় ১৫০০ জন আদিবাসীকে গণহত্যা করেছিল। এই এলাকায় এখনও প্রচুর উপজাতির মানুষ বাস করেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে তাঁদেরই সম্মান জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত মাসে এই এলাকায় আসেন তিনি। স্বাধীনতা আন্দোলনে আদিবাসীদের ভূমিকার কথা স্মরণ করে মানগড় ধামকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ হিসেবে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। এই মানগড় ধামের গায়ে যে রক্ত লেগে আছে, তা মনে করায় জালিয়ানওয়াবাগ। কেন এদিন রক্ত ঝরেছিল?
উনিশ শতকের ষাটের দশক সেটা। সদ্য নিভেছে সিপাহি বিদ্রোহের আগুন। দুঙ্গারপুর জেলার বাঁশিয়া গ্রামে এক বানজারা পরিবারে জন্ম গোবিন্দ গিরি তথা গুরু গোবিন্দের। সাধারণত রাজস্থান এবং উত্তর গুজরাটের কিছু অঞ্চলেই বসবাস বানজারা সম্প্রদায়ের মানুষদের। মূলত তাঁরা যাযাবর। ‘নিচু জাত’ হওয়ায় সভ্য সমাজে পা রাখা ছিল তাঁদের অপরাধ। এই কারণে, ছোটো থেকে পড়াশোনার শখ থাকলেও, কোনওদিনও গ্রামের স্কুলে পা রাখা হয়নি গুরু গোবিন্দের। তবে তাঁর সেই অধরা শখ পূরণ করেন এক গ্রামের পুরোহিত। শুধু লিখতে-পড়তেই নয় বরং চিন্তার জাল বুনতে শিখিয়েছিলেন তিনি। আঙুল তুলে দেখিয়েছিলেন, তাঁর ‘সহোদর’ ভাই-বোনের সঙ্গে কীভাবে প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহার করে চলেছে তথাকথিত সভ্য সমাজ।
১৮৯৯-১৯০০ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হয় তৎকালীন বম্বে প্রোভিন্স এবং দাক্ষিণাত্য। খাদ্যাভাবে প্রাণ হারান প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভিলরাই। গুরু গোবিন্দকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য করেছিল তা হল, যাঁদের জন্য প্রতিনিয়ত বন্ডেড লেবার হয়ে রক্ত ঝরায় ভিলরা, তাদের উপর বিন্দুমাত্রও আঁচ পড়েনি এই দুর্ভিক্ষের। বুঝতে পেরেছিলেন, একমাত্র শিক্ষা এবং সমবেত প্রতিবাদই মুছে ফেলতে পারে এই বৈষম্যের বেড়াজাল।
বিশ শতকের প্রথম থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর এই লড়াই। একত্রিত করেন রাজস্থান ও গুজরাটের ভিল আদিবাসীদের। শুরু হয় আদিবাসী অধিকার আদায়ের লড়াই— ভগৎ আন্দোলন। বছর খানেকের মধ্যে মানগড় পাহাড়ে গড়ে ওঠে ভারতের প্রথম উপজাতি সম্প্রদায়ের আশ্রম।
সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে এই সমবেত প্রতিবাদ সেসময় নৈতিকতার প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সম্ভ্রান্ত সমাজকে। ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ আশ্রিত জায়গিরদার ও জমিদারদের। মানগড় ছাড়িয়ে এই আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দুঙ্গারপুর, বাঁশওয়াড়া, সান্তরামপুর অঞ্চলেও। মজুরির দাবিতে কৃষিকাজ বন্ধ করে দেয় হাজার হাজার ভিল সম্প্রদায়ের মানুষ।
এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতেই ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল রাজস্থান ও গুজরাতের তৎকালীন জমিদাররা। ১৯১৩ সালের শুরুর দিকেই ডুঙ্গারপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় গুরু গোবিন্দকে। মাস চারেক পর মুক্তি দেওয়া হলেও, রাজ্য থেকে নির্বাসিত হন তিনি। তারপর এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানো। কিন্তু এভাবেই কি আন্দোলনের আগুনকে নিভে যেতে দেওয়া যায়?
রাজ্যের বাইরে থেকেই ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে ফের প্রতিবাদ গড়ে তোলার তোড়জোড় শুরু করে দেন গুরু গোবিন্দ। ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাস। পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনার জন্য আরাবল্লির অরণ্যে অন্ততপক্ষে লাখ খানেক ভিল সম্প্রদায়ের মানুষকে একজোট করেন গুরু গোবিন্দ। অবশ্য এই গোপন খবরও হাওয়ায় হাওয়ায় পৌঁছে গিয়েছিল শাসকদের কানে। খানিকটা বিকৃত হয়েই। এবার নাকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং জমিদারদের উৎখাত করে স্বাধীন ভিল সাম্রাজ্য তৈরি করবেন গুরু গোবিন্দ। আর সেই সশস্ত্র বিপ্লবেরই প্রস্তুতি চলেছে অরণ্যে।
আরও পড়ুন- কেন আজও আদিবাসীদের ‘ভগবান’ বিরসা মুন্ডা, জেদেই ঘুম উড়িয়েছিলেন ব্রিটিশদের
দিনটা ছিল ১৭ নম্ভেবর। একদিকে যেমন আরাবল্লির সানুদেশে যজ্ঞের আয়োজন হয়েছিল ভিল সম্প্রদায়ের মঙ্গলার্থে, অন্যদিকে গোটা পাহাড়কে ঘিরে ফেলেছিল ব্রিটিশ সেনারা। মেশিনগান থেকে শুরু করে কামান— হাজির ছিল সবই। সন্ধে নামার পর ব্রিটিশ এজেন্ট হ্যামিল্টন সাহেবের আদেশ পেয়েই ঝলসে ওঠে সেসব আগ্নেয়াস্ত্র। মুহূর্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চল। লুটিয়ে পড়ে প্রায় দেড় হাজার দেহ।
গুরু গোবিন্দ সেই যাত্রায় প্রাণে বাঁচলেও দেশদ্রোহের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় তাঁর। দেশ এখন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করছে। মোদি নভেম্বরেই মানগড়ে এসেছেন। স্মরণ করেছেন স্বাধীনতার আন্দোলনে আদিবাসীদের কথা। গুজরাত ভোটের আগে তিনি কি দায়ে পড়েই এখানে এসেছিলেন? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ জায়গাটা রাজস্থান হলেও, মানগড় ধাম এবং গুরু গোবিন্দের প্রভাব রয়েছে গুজরাত ও রাজস্থান উভয় রাজ্যের মানুষের মধ্যে। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করতে গিয়ে ইসরো মহাকাশে তিরাঙ্গা উড়িয়েছে, তবে একই সঙ্গে যদি ভিল আন্দোলনের ইতিহাস স্মতির অতলে চলে যায়, তাহলে তা হবে সমাজ বৈষম্যের নির্লজ্জ প্রকাশ।