ফাইনালের আগেই ট্রফি গেল চুরি! কাপ খুঁজে বিশ্বকাপের নায়ক হয়েছিল এক কুকুর...

1966 World Cup Trophy Stolen: গোল বাঁধল ফাইনালের আগে। জুলে রিমে ট্রফিটাই গেল চুরি হয়ে।

১৯৬২-র বিশ্বকাপ

ভারত আর মালয়েশিয়ার কিছু জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, আর কিছু দিনের মধ্যেই পৃথিবী ধ্বংস হবে। কিন্তু জ্যোতিষার্ণবদের যাবতীয় ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যে প্রমাণ করে পৃথিবী ঘুরতেই থাকল, আর সূর্যকে ঘিরে পাক খাওয়ার অবসরেই তৈরি হয়ে গেল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সাত বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর আলজিরিয়ায় সত্যিই মুক্তির ভোর হল। ইজ়রায়েলে নাৎসিদের পাণ্ডা, ইহুদি খুনের নায়ক, অ্যাডলফ আইখমানকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হল। অস্ট্রিয়ার খনি শ্রমিকরা সর্বাত্মক হরতাল করল এবং পোপ জন ক্যাথলিকদের গির্জাকে ফের গরিবগুর্বো মানুষের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। ওদিকে পৃথিবীতে প্রথমবার কম্পিউটার ডিস্ক তৈরি হচ্ছে এবং লেজার বিম দিয়ে ডাক্তাররা শল্যচিকিৎসা শুরু করছে। মেরিলিন মনরো জীবনের প্রতি সব অনুরাগ হারিয়ে ফেলেছে।

আচ্ছা, কোনও একটা দেশের ভোটের মূল্য কত হতে পারে ভেবে দেখেছেন কখনও? দেড় কোটি ডলার, একটা পাকা সড়ক, নদীবাঁধ একখানা আর একটা হাসপাতালের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসে নিজেদের ভোটাধিকার বেচে দিয়ে হাইতি এমন অবস্থান নিল যে ওএএস সর্বসম্মতিক্রমে আমেরিকার কুলাঙ্গার কুবাকে বহিষ্কার করল! মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল, খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু! হেনরি মিলারের কর্কটক্রান্তি নিষিদ্ধ করতে চেয়ে মার্কিন মুলুকে পঁচাত্তরখানা মোকদ্দমা দায়ের হলো। এটাই ছিল উপন্যাসটির প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ। দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কারের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা লাইনাস পওলিং পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার বিরুদ্ধে হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভে যোগ দিলেন। ওদিকে বেনি পেরেত, কুবার লোকমুখে যে ‘খোকা’ বলেই বিখ্যাত ছিল, ম্যাডিসন স্কোয়্যারের বক্সিং রিংয়ে লড়তে নেমে না ফেরার দেশের দিকে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেল। বেচারাকে পিটিয়ে একেবারে মণ্ড পাকিয়ে ছেড়েছিল।

এলভিস প্রেসলি মেমফিস থেকে অবসর ঘোষণা করল। ততদিনে তার তিরিশ কোটি রেকর্ড বিক্রি হয়ে গেছে। যদিও অবসর ভেঙে স্বমূর্তিতে ফিরতে সে খুব বেশি দেরি করেনি। অতলান্তিকের ওপারে লন্ডনের ডেকা গ্রামোফোন কোম্পানি একদল ঝাঁকড়াচুলো ছেলেদের গানবাজনা রেকর্ড করতে অস্বীকার করে। ওই ছেলেগুলো নিজেদের বিটলস বলত। আলেহো কার্পেন্তিয়ারের গির্জায় বিস্ফোরণ প্রকাশিত হচ্ছে, হোসে জেলমান লিখছেন গোতান। আরহেন্তিনার সামরিক বাহিনী সেদেশের রাষ্ট্রপতি ফ্রন্দিসিকে ক্ষমতাচ্যুত করল। ব্রাজ়িলীয় শিল্পী ক্যানজিদু পোর্তিনারি ছবি আঁকার রঙে সিসের বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছেন। ব্রাজ়িলীয় ঔপন্যাসিক গিমারয়েসের আদি গল্প বইয়ের দোকানে চলে এসেছে। ব্রাজ়িলেরই কবি ভিনিচিয়াস দি মোরাইসের শুধু ভালোবাসার জন্য এই জীবন কবিতাবইও দোকানের তাকে এসে গেছে। বোসা নোভা গানবাজনার হোতা জোঁয়াও জিলবার্তো কার্নেগি হলে ‘ওয়ান নোট সাম্বা’র আবেগে শ্রোতাদের কাঁপিয়ে দিচ্ছে আর সপ্তম বিশ্বকাপ জেতার আশায় ব্রাজ়িলের জাতীয় ফুটবল দল চিলে পৌঁছে যাচ্ছে। সেবার ব্রাজ়িল ছাড়া গোটা আমেরিকা থেকে আরও পাঁচটা এবং ইওরোপ থেকে দশটা দল খেলতে এসেছিল।

’৬২-র বিশ্বকাপটা দি স্তেফানোর পক্ষে খুব শুভ ছিল না। সে এবার জন্মসূত্রে স্বদেশ নয়, বরং নিজের বেছে নেওয়া হিস্পানি দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলবে বলে সব ঠিক ছিল। ছত্রিশ বছর বয়সে এটাই ছিল তার শেষ সুযোগ। কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই ডান হাঁটুতে এমন চোট পেল যে ‘সোনালি চুলের ব্রহ্মাস্ত্র’, ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই খেলোয়াড়ের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। আরেক মহাতারকা পেলেও চিলের মাটিতে বেশি দূর এগোতে পারল না, শুরুতেই পায়ের পেশিতে এমন টান লাগল যে মাঠে নামতেই পারল না। ফুটবলের আরও এক দৈত্য, রাশিয়ার ইয়াসিন, গোটা টুর্নামেন্টে বিশুদ্ধ অশ্বডিম্ব প্রসব করল; বিশ্বের সেরা গোলকিপার কিনা কলম্বিয়ার সঙ্গে খেলতে নেমে চার-চারটে গোল হজম করল! হবে না, ও সাজঘরে পকেট থেকে নিপ বের করে বেশ ঢুকুঢুকু চালাচ্ছিল যে!

ব্রাজ়িল পেলেকে ছাড়াই ডিডির তুখোড় নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জিতল। পেলের জায়গায় খেলতে নেমে আমারদিলো রীতিমতো ঝলসে ওঠে। পেলের বদলি হিসেবে খেলাটা কখনই সহজ ছিল না, বুঝতেই পারছেন। জালমা সান্তোস রক্ষণে নিজেকে দেওয়ালের মতো অটল প্রমাণ করল, আর আক্রমণে গ্যারিঞ্চা নিজে তো প্রচণ্ড উদ্বুদ্ধ হয়ে ফুটবল খেলছিলই, সেইসঙ্গে গোটা দলকেও উজ্জীবিত করছিল। ব্রাজ়িল যখন চিলেকে পর্যুদস্ত করে দিল তখন সান্তিয়াগোর দৈনিক এল মেরকুরিও লিখল, "গ্যারিঞ্চা কোন গ্রহের খেলোয়াড়?" চিলে সেবার ইতালিকে নিখুঁত পরিকল্পনায় খেলে হারাল, তারপর সুইৎজ়ারল্যান্ডকে আর শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বধ করল। মানে তারা স্প্যাগেতি, চকলেট আর ভদকা হজম করে ফেললেও কফির পেয়ালায় তাদের হেঁচকি ওঠা থামল না। ব্রাজ়িলের কাছে চিলে ৪-২ গোলে হারল।

ফাইনালে ব্রাজ়িল চেকোস্লোভাকিয়াকে ৩-১ হারিয়ে ১৯৫৮-র বিশ্বকাপের মতোই গোটা টুর্নামেন্টে অপরাজিত থেকে চ্যাম্পিয়ন হল। আর একটা কথা তো বলাই হয়নি! এই প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল আন্তর্জাতিক স্তরে টিভিতে সম্প্রচারিত হল, যদিও তখন সাদা-কালো টিভির যুগ, আর খুব বেশি দেশে সরাসরি সম্প্রচার দেখাও যায়নি।

চিলে তৃতীয় স্থান পেল, বিশ্বকাপের এতকালের ইতিহাসে তাদের সেরা ফল। দ্রাগোশ্লাভ শেকুলারাৎস নামে এক শিকারি পাখির দৌলতে য়ুগোশ্লাভিয়া চতুর্থ স্থান পেল। প্রতিপক্ষের রক্ষণের কোনও খেলোয়াড়ই দ্রাগোশ্লাভের ধারে কাছে পৌঁছতে পারছিল না।

এই বিশ্বকাপে কোনও একজন সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়নি, বরং বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় চারটে করে গোল করেছিল; ব্রাজ়িলের গ্যারিঞ্চা আর ভাভা, চিলের স্যাঞ্চেজ়, য়ুগোশ্লাভিয়ার ইয়েরকোভিচ, হাঙ্গেরির আলবার্ট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ইভানভ।

আরও পড়ুন- ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?

চার্লটনের গোল

’৬২-র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড খেলছিল আরহেন্তিনার বিরুদ্ধে।

ববি চার্লটন প্রথম গোলটা করাল ফ্লাওয়ার্সকে দিয়ে। সে এমন জায়গায় বলটা ফ্লাওয়ার্সের দিকে পাঠিয়েছিল, যেখানে আরহেন্তিনার গোলকিপার রোমা ছাড়া তার সামনে আর কেউ ছিল না। কিন্তু পরের গোলটার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কৃতিত্ব ববির। চার্লটন ছিল ফুটবল মাঠের বাঁদিকের ঈশ্বর, সেদিন ও দু'নম্বর গোলটা করার পর আরহেন্তিনার রক্ষণভাগকে দেখে মনে হচ্ছিল চেপ্টে যাওয়া একটা মথ। সে তীব্র গতিতে দৌড়তে দৌড়তে একদিকে হেলে গিয়েও বলটা অন্য পায়ে নিয়ে নেয় এবং ডান পায়ের গোলায় গোলকিপারকে উড়িয়ে দিয়ে উইং থেকেই গোল ভরে দেয়।

ববির তো বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ওর বেশ কয়েকজন সহ খেলোয়াড় বিমান দুর্ঘটনায় ঝলসে মারা গিয়েছিল। মৃত্যু এই খনি শ্রমিকের সন্তানকে বোধহয় একারণেই রেহাই দিয়েছিল যে সে পরে ফুটবল মাঠে মানুষকে প্রভূত আনন্দ দেবে।

বল তার কথা মেনে চলত। ববি বলে শট নেওয়ার আগে সেই লাস্যময়ী কখনও কখনও নিজেই উড়ে গিয়ে জালের আরামে জড়িয়ে মিটমিট করে হাসত!

ইয়াসিন

লেভ ইয়াসিন গোলে দাঁড়ালে একটা আলপিন গলাবার জায়গাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হতো। মাকড়সার মতো লম্বা-লম্বা হাতের এই অসামান্য রুশি গোলকিপার সবসময় কালো পোশাক পরত। ওর খেলায় একটা আশ্চর্য সারল্য ছিল, বেফালতু কারিকুরি আর বেশি হাবভাব সে ভীষণ অপছন্দ করত। সে পছন্দ করত আগুন ছেটানো শট নিজের থাবায় ঠাণ্ডা করে দিতে। যেকোনও উচ্চতাতেই বল উড়াল দিক না কেন সে ঠিক লুফে নিত। ওর শরীর কিন্তু সেই সময় পাথরের মতো স্থির থাকত। একবার তাকিয়েই আলতো ঘুষিতে বল পোস্টের উপর দিয়ে বাইরে ফেলে দিতে পারত।

ইয়াসিন ফুটবল থেকে বহুবার অবসর নিয়েছে, ভক্তরা ভালোবাসায় জপিয়ে তাকে ফের মাঠে নামিয়েছে। তার মতো এমন রঙিন মানুষের দেখা পাওয়া ভার। পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে লেভ ইয়াসিন জালের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকশো পেনাল্টি রুখেছে, আর কত কত গোল আটকেছে তার কোনও হিসেব নেই। এমন অতুলনীয় খেলার রহস্যটা কী জানতে চাইলে সে বলত; বেশি কিছু না, সে নাকি স্নায়ু ঠান্ডা রাখতে বুকভরে সুখটান দিত আর পেশিগুলোকে সতেজ রাখতে কড়া কোনও পানীয় সটান গলায় ঢেলে নিত।

আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি

হেনতোর গোল

১৯৬৩ সালে রিয়াল মাদ্রিদ খেলছিল পোনতেভেদরার বিরুদ্ধে।

রেফারি খেলা শুরুর বাঁশি বাজিয়েছে কী বাজায়নি, দি স্তেফানো একখানা গোল করে ফেলল। তারপর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই পুশকাস আর একখানা গোল করল। আর এর ঠিক পরেই সমর্থকদের উৎকণ্ঠা বেড়ে গেল বহুগুণ। তার পরের গোলটার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, কারণ সেটা হবে রিয়াল মাদ্রিদের ২০০০তম গোল। সেই ১৯২৮ সাল থেকে রিয়াল সেদেশের লিগ খেলছে, দ্বিসহস্রতম গোলের একটা উন্মাদনা তো থাকবেই! রিয়াল মাদ্রিদের ভক্তরা স্বপ্নের গোল কামনা করে আঙুলে চুমু খেয়ে দু'হাতের তর্জনী আর মধ্যমা কাটাকুটি করে রাখে। প্রতিপক্ষের ভক্তেরা তর্জনী আর কড়ে আঙুল মাটির দিকে দেখিয়ে চলে যাতে কোনওভাবেই রিয়ালের স্বপ্নপূরণ না হয়।

খেলাও ধীরে ধীরে পালটে গেল। পোনতেভেদরা দাপট দেখাতে শুরু করল। সন্ধে নামার মুখে তখন আর সামান্য কয়েক মিনিট খেলা বাকি, বহুকাঙ্খিত গোল হওয়া তো দূরের কথা বল প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। এমন সময় আমানসিয়ো একটা বিপজ্জনক ফ্রি-কিক পেল। ও সোজা গোলে না মেরে বলটা দি স্তেফানোর দিকে বাড়াল, কিন্তু দি স্তেফানো বলের কাছে পৌঁছতে পারল না, বল পেল হেনতো। মাদ্রিদের বাঁদিকের উইংয়ের খেলোয়াড় হেনতো তার শরীরের চারপাশে লেপটে থাকা বিপক্ষের খেলোয়াড়দের ঝেড়ে ফেলে শট নিল এবং রিয়াল মাদ্রিদের বহু কাঙ্খিত দ্বিসহস্রতম গোলটি হলো। স্টেডিয়ামে তখন কানের পর্দা ফাটানো আওয়াজ।

ফ্রান্সিসস্কো হেনতোকে দলে নেবার জন্য প্রতিবার অনেকগুলো দলের হর্তাকর্তারা ঝাঁপাত কিন্তু সে চিরকালই পাঁকাল মাছের মতো পিছলে যেত। অবিশ্যি কখনও কখনও তাকে ফাটকে বন্দি হতে হতো, কিন্তু সেখান থেকেও সে নানাভাবে হড়কে বেরিয়ে যেত।

জ়িলা

ওর কথা মনে পড়লেই চোখে ভাসে হাতে ফেনা উপচে পড়া বিয়রের মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাসিখুশি অজাতশত্রু গোছের একটা মুখ। জার্মানির ফুটবল মাঠের ইতিহাসে সে ছিল সবচেয়ে বেঁটে আর সবথেকে হাট্টাকাট্টা; বেশ নিটোল এক হামবুর্গবাসী যে এলোমেলোভাবে পা ফেলে চলে। তার একটা পা অন্য পায়ের চেয়ে লম্বায় বড় ছিল। কিন্তু মাঠে নেমে উভ জ়িলা মাছির মতো লাফাত, খরগোশের মতো দৌড়ত, ষাঁড়ের মতো হেড করত।

১৯৬৪-তে হামবুর্গের এই সেন্টার ফরোয়ার্ড জার্মানির সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়। সে ছিল মনেপ্রাণে হামবুর্গ ফুটবল দলের সমর্থক, মুখে বলত; "আমি আর পাঁচজনের মতোই হামবুর্গের প্রবল ভক্ত, এই দলটাই আমার কাছে সব"। উভ জ়িলা ইওরোপের বড় বড় ক্লাবে খেলার লোভনীয় প্রস্তাবও ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে গেছে। সে মোট চারবার জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ খেলে। সেই দিনগুলোয় গ্যাল্যারিতে ‘উভ উভ’ বলে চেঁচানোই ছিল জার্মানির হয়ে গলা ফাটানোর সেরা উপায়।

আরও পড়ুন- পোলিওতে কাবু, দুই পা অসমান, বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়েই ফুটবলের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হয়েছিলেন গ্যারিঞ্চা

ম্যাথুজ়

১৯৬৫-তে স্ট্যানলি ম্যাথুজ়ের যখন পঞ্চাশ বছর বয়স, তখনও সে ব্রিটিশ ফুটবলে গণউন্মাদনার স্রোত বইয়ে দিয়েছিল। ইংল্যান্ডে যত লোকের চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল, মনোরোগের অত চিকিৎসক সেসময় তাদের দেশে ছিল না। এরা সবাই একেবারে সুস্থ-নীরোগ জীবন কাটাচ্ছিল, যতক্ষণ না স্ট্যানলি ম্যাথুজ় নামক ঠাকুরদার বয়সী একটা লোকের জন্য বিপক্ষ দলের ফুল-ব্যাকেদের অপরিসীম যন্ত্রণা দেখে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

রক্ষণের খেলোয়াড়রা তার জার্সি কিংবা হাফপ্যান্ট ধরে টেনে রাখত, তাকে কুস্তির প্যাঁচে জড়িয়ে ধরত, এমন লাথি মারত যার জন্য পুলিশের খাতায় নাম ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাকে ঠেকানো যাচ্ছিল না। আর ঠেকাবেই বা কী করে? তার ডানা দুটো তো আর কেটে ফেলা যায় না! সংক্ষেপে এই ছিল স্ট্যানলি ম্যাথুজ়, উইংয়ে খেলত, ইংল্যান্ডের মাঠগুলোয় সাইডলাইন ধরে তার মতো আর কোনও ফুটবলার এতটা উড়ে বেড়ায়নি।

রানি এলিজ়াবেথের কাছে কিন্তু সব খবর থাকত, তাই স্ট্যানলি ম্যাথুজ় পরে নাইটহুড লাভ করে।

১৯৬৬-র বিশ্বকাপ

ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনী সেদেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছিল। পাঁচ লাখ, না কি দশ লাখ! কত মানুষ খুন হয়েছে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। জেনারেল সুহার্তো তখনও পর্যন্ত বেঁচে থাকা লাল, গোলাপি এবং সন্দেহজনক মতাদর্শের অনেক মানুষকে কোতল করে দীর্ঘস্থায়ী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করল। ওদিকে আফ্রিকার মাটিতে ঘানার রাষ্ট্রপতি ও ঐক্যবদ্ধ আফ্রিকার প্রচারক নক্রুমাহ্‌কে সামরিক কর্তারা ক্ষমতাচ্যুত করল। তাদের আরহেন্তিনীয় বেরাদররা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নিজেদের দেশের রাষ্ট্রপতি ইলিয়াকে ছুঁড়ে ফেলল।

ভারতে প্রথমবার রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে একজন মহিলাকে দেখা গেল। ইন্দিরা গান্ধি প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ নিল। ছাত্রফৌজ ইকুয়েডরের সামরিক একনায়কত্ব উৎখাত করল। ওদিকে মার্কিনি সেনাবাহিনী নতুন উদ্যমে হ্যানয়ে বোম মারতে লাগল। কিন্তু মার্কিন নাগরিকরা ফুঁসছিল। তাদের দৃঢ়বিশ্বাস, অতখানি উজিয়ে ভিয়েতনাম যাওয়ার কোনও দরকারই ছিল না। তার চেয়ে ভিয়েতনামকে নিষ্কৃতি দেওয়াই মঙ্গলের, মার্কিনি বাহিনীর উচিত যথাশীঘ্র ভিয়েতনাম থেকে পাততাড়ি গুটনো।

সদ্য বেরিয়েছে ট্রুম্যান কাপোতির ঠান্ডা রক্তের খুনি, গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একশো বছরের নিঃসঙ্গতা বেরুবে বেরুবে করছে, কুবার ঔপন্যাসিক হোসে লেজ়ামা লিমার স্বর্গ বাজারে আসছে। কলম্বিয়ার পাহাড়ি এলাকায় লড়াই করতে করতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদে আস্থাশীল রোমান ক্যাথলিক যাজক ক্যামিলো তোরেসের মৃত্যু হল। ওদিকে চে গেভারা দোন কিহোতের রোসিনান্তের মতো হাড় জিরজিরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বলিভিয়ার গাঁ-গঞ্জ চষে ফেলছে। চিনে মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছেন। বেশ কিছু তাপ-পারমাণবিক বোমা ভুল করে পড়ল হিস্পানি সৈকতের আলমেরিয়ায়। সেখানকার লোকে অবিশ্যি হাইড্রোজেন বোমায় খুব একটা ডরায়নি। মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা বলে বেড়াচ্ছিল, খুব শিগগিরই নাকি ফিদেল কাস্ত্রোর পতন অনিবার্য। আর সেরেফ কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা শুধু!

লন্ডনে হ্যারল্ড উইলসন ভোটে জিতে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে পাইপ চিবুচ্ছিলেন। মেয়েরা দুর্দান্ত সব মিনিস্কার্ট পরতে শুরু করল, কার্নাবির অলিগলি হয়ে উঠল ফ্যাশনের রাজধানী। গোটা দুনিয়া বিটলসের সুরে গুনগুনিয়ে উঠল, আর অষ্টম বিশ্বকাপও শুরু হল।

এবারের বিশ্বকাপই গ্যারিঞ্চার শেষ বিশ্বকাপ ছিল। মেহিকোর গোলকিপার আন্তনিও কারবাখালেরও এটা শেষ বিশ্বকাপ ছিল। কারবাখালই সেসময় সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ খেলেছিল, মোট পাঁচবার।

ষোলোটা দল সেবার খেলে: ইওরোপের দশটা, আমেরিকার পাঁচটা আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে জায়গা পায় উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়াই কিন্তু ইতালিকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। প্যাক নামে পিয়ংইয়ং শহরের এক দন্তচিকিৎসকের গোলে ইতালি হারে, এই দন্তচিকিৎসক নাকি অবরে সবরে ফুটবল পেটাত। যদিও ইতালির দলে জিয়ান্নি রিভেরা, সান্দ্রো মাৎজ়োলার মতো দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় ছিল। পিয়ের পাওলো পাসোলিনি বলতেন, তাঁরা নাকি স্বাদু গদ্যের মতো ফুটবল খেলেন, যার শরীরে বোনা থাকে প্রকীর্ণ কবিতার চুমকি। কিন্তু পিয়ংইয়ং থেকে আসা ওই দন্ত চিকিৎসক সবার বাক্‌রোধ করে ছাড়ল।

আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল

এবারই প্রথম গোটা চ্যাম্পিয়নশিপ উপগ্রহের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ সাদা-কালো টেলিভিশনের সামনে বসে দেখল। বলতে বাধা নেই, গোটা দুনিয়া দেখল রেফারিরা কী জঘন্য ফুটবল খেলাল। আগের বিশ্বকাপে ইওরোপের রেফারিরা ছাব্বিশটা ম্যাচ খেলিয়েছিল। এবার মোট বত্রিশটা ম্যাচের মধ্যে ইওরোপের রেফারিরা খেলাল চব্বিশটা ম্যাচ। এক জার্মান রেফারি আরহেন্তিনার বিরুদ্ধে ম্যাচটা ইংল্যান্ডকে উপহার দিল। পালটা এক ব্রিটিশ রেফারি জার্মানিকে উপহার দিল উরুগুয়ে ম্যাচ। ব্রাজ়িলের বরাতেও ভালো কিছু জোটেনি; বুলগেরিয়া আর পর্তুগাল বেপরোয়া লাথি মেরে মেরে পেলেকে শিকার করার মহান ব্রত নিয়েছিল। ওদের জন্যই ব্রাজ়িল টুর্নামেন্টের বাইরে ছিটকে গেল।

রানি এলিজ়াবেথ ফাইনাল ম্যাচের দিন স্টেডিয়ামে পদার্পণ করেছিলেন! ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা গোল করলে মহারানিকে খুব একটা উল্লসিত হতে দেখা যায়নি বরং তিনি খানিক আলগাভাবেই তারিফ করছিলেন। ফাইনাল উঠেছিল দুরন্ত শট আর তুখোড় মার্কিংয়ের জন্য বিখ্যাত ববি চার্লটনের ইংল্যান্ড এবং সদ্য আন্তর্জাতিক ফুটবলে পা রাখলেও ততদিনে কায়দাকেতায় দিব্যি বাবুলাট বনে যাওয়া বেকেনবাওয়ারের পশ্চিম জার্মানি। গোল বাঁধল ফাইনালের আগে। জুলে রিমে ট্রফিটাই গেল চুরি হয়ে। অবিশ্যি পিকলস নামে একটা কুকুর লন্ডনের কোনও এক বাগান থেকে ট্রফিটা খুঁজে আনতে বিশেষ দেরি করেনি। ফলে ঠিক সময়েই বিজয়ীর হাতে ট্রফি উঠল। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতল ৪-২ গোলে। পর্তুগাল তৃতীয় হলো। চতুর্থ স্থান পেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। মহারানির তরফে বিশ্বজয়ী দলের কোচ অ্যালফ র‍্যামসেকে বিশেষ খেতাবে ভূষিত করা হল। আর পিকলসের কথা কী বলব! সে ততদিনে ইংল্যান্ডের জাতীয় নায়ক।
’৬৬ বিশ্বকাপের পুরোটাই ছিল রক্ষণাত্মক ফুটবলের কব্জায়। প্রত্যেক দলই সুইপার পদ্ধতিতে ফুলব্যাকেরও পেছনে গোললাইন বরাবর আরেকজন খেলোয়াড়কে দাঁড় করিয়ে খেলে গেল। তা সত্ত্বেও পর্তুগালের কৃষ্ণাঙ্গ তারকা ইউসেবিও ন'বার প্রতিপক্ষের দুর্ভেদ্য জাল ছিন্নভিন্ন করেছিল। সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ছ'টা গোল করে তার ঠিক পেছনে ছিল জার্মানির হ্যালা।

More Articles