'৯৪ এর বিশ্বকাপ ফাইনালের মাঠের ঘাস অবধি বিক্রি হয়েছিল পিৎজার মতো...
1994 World Cup Football: তারকারা ততদিনই বিশাল অঙ্কের টাকা পায় যতদিন তাদের ঔজ্জ্বল্য অটুট থাকে।
ওদের কেউ হিসেবের মধ্যেই ধরে না
’৯৪-এর বিশ্বকাপের পর মারাদোনা, স্তোইচকোভ, বেবেতো, ফ্রাঞ্চিকোলি (ফ্রান্সিসকোলি), লাউড্রপ, জ়ামোরানো, হুগো স্যাঞ্চেসের মতো তারকা ফুটবলাররা আরও অসংখ্যা খেলোয়াড়কে সঙ্গে নিয়ে ফুটবলারদের একটা আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন গড়ার চেষ্টা শুরু করেছিল।
জনমোহিনী ফুটবল এবং সেই খেলার তারকাদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো যেখানে নেওয়া হয় খেলোয়াড়দের তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। সর্বত্র ফিফার পেটোয়া লোক বসানো আছে। তাই স্থানীয় স্তরে যেমন, তেমনই ফিফার সভাগুলোতেও, যেখানে আসল বখরাটা হয়- ফুটবলারদের প্রবেশাধিকার নেই।
তাহলে খেলোয়াড়দের ভূমিকাটা কী? তারা মাদারির পোষা বাঁদর নাকি? রেশমের জামা পরালেই কি বাঁদরের মার্যাদা বেড়ে যায়? কখন, কোথায়, কীভাবে বাঁদরনাচন শুরু হবে তা নিয়ে বাঁদরের সঙ্গে মাদারির আলোচনার কথা কল্পনা করতে পারেন কি? ফুটবলের আন্তর্জাতিক মোহন্তরা নিজেদের খেয়াল-খুশিতে খেলার নিয়মও বদলে দেয়, সেখানেও ফুটবলারদের মতামতের কোনও মূল্য নেই। খেলোয়াড়রা জানতেই পারে না, তাদের পা বেচে ফিফা কত টাকা রোজগার করল। চিরচঞ্চলা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে শেষমেশ ফুটবল ব্যাবসায়ীরা কতটা শুষে নিল তা বোঝার কোনও উপায়ও নেই।
বহুদিনের ধর্না-হরতালের পর স্থানীয় স্তরে আজকাল খেলোয়াড়রা খানিকটা সুবিধেজনক চুক্তি পায়। কিন্তু হর্তাকর্তারা ফুটবলারদের যন্ত্রের বেশি কিছু ভাবে না, যাদের কেনা-বেচা কিংবা ধার দেওয়া যায়। নাপোলির সভাপতি বলত না "মারাদোনা হলো আমাদের আমানত!"
ইদানীং ইওরোপের তো বটেই লাতিন আমেরিকার অনেক ক্লাবেও, ক্লাব কেন বলছি, ওগুলো ফুটবলের কারখানা, একজন করে মনোবিদ নিয়োগ করা হয়। একেবারেই ভাববেন না যে ফুটবল-কারখানার মালিকরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত খেলোয়াড়ের পাশে দাঁড়াতে মনোবিদ নিয়োগ করছে। ব্যাবসাদারদের একটাই লক্ষ্য, যন্ত্রপাতির কলকব্জায় তেল খাইয়ে উৎপাদন বাড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। খেলায় উৎপাদন! হা ঈশ্বর!
শ্রমিক, থুড়ি ফুটবলারের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে উৎপাদন! যদিও এক্ষেত্রে শ্রমিকের হাতের বদলে ভাড়া করা পা-ই ভরসা। মোদ্দা কথা হলো, পেশাদার ফুটবলাররা সেইসব লোকের হাতে নিজেদের শ্রম বিক্রি করে যারা ফুটবলকে নিছক খেলা হিসেবে না দেখে জাঁকজমকে ভরা প্রদর্শনী হিসেবে আমাদের কাছে বেচে। খেলোয়াড়দের দাম নির্ধারিত হয় তাদের খেলার ক্ষমতার ওপর। তারা যত বেশি টাকা পায় ততই তাদের উপর আরও জেতার চাপ বাড়তে থাকে। তাদের প্রশিক্ষণের সারসত্য হল যেনতেন প্রকারে জিততে শেখা। খাটিয়ে-খাটিয়ে শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটুকুও শুষে নেয়। ঘোড়দৌড়ের ঘোড়াগুলোকেও ফুটবলারদের চাইতে বেশি তোয়াজ করা হয়। ইংরেজ ফুটবলার পল গ্যাসকোয়েন তো নিজেকে পোলট্রিতে বড় হওয়া মুরগির ছা ভাবত; মাঠে নেমে গতে বাঁধা নড়াচড়া, অনুশীলনে শৃঙ্খলার নামে জবরদস্তি, আগে থেকে ছকে রাখা কায়দা-কৌশলের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান।
তারকারা ততদিনই বিশাল অঙ্কের টাকা পায় যতদিন তাদের ঔজ্জ্বল্য অটুট থাকে। অবিশ্যি কুড়ি-তিরিশ বছর আগে তারকারা যা পেত এখন তার চাইতে অনেকটাই ভদ্রস্থ টাকা পায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞাপনের আয়, ফুটবলাররা নিজেদের নাম ব্যবহার করতে দিয়ে, টিভিতে মুখ দেখিয়ে আজকাল ভালোই কামায়। এই খেলার কিংবদন্তিরা কিন্তু উপকথার নায়কদের মতো খাজানার সন্ধান পায়নি কোনওদিন। ১৯৯৪ সালে ফোর্বস পত্রিকা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী চল্লিশজন খেলোয়াড়ের একটা তালিকা ছাপে। তাতে ইতালির রোবের্তো বাজ্জো ছাড়া আর কোনও খেলোয়াড়ের নাম তো ছিলই না, বাজ্জোও কোনওক্রমে সেই তালিকার শেষের দিকে ঝুলছিল।
কিন্তু সেইসব হাজার হাজার ফুটবলারের কথা একবার ভাবুন তো, যারা কখনও তারকা হতে পারেনি, প্রচারের আলো কোনওদিন যাদের মুখে এসে পড়েনি, যারা সারাজীবন একটা ঘোরানো দরজার পাল্লায় আটকে ক্রমাগত পাক খেয়ে গেল। আরহেন্তিনার প্রতি দশজন পেশাদার খেলোয়াড়ের মধ্যে মাত্রই তিনজন শুধু ফুটবল খেলে জীবনধারণ করতে পারে। যদি খেলোয়াড়ি জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের কথা মাথায় রাখেন তাহলে তাদের মাসমাইনেও এমন কিছু বেশি নয়। রাক্ষুসে কারখানাকেন্দ্রিক সভ্যতা চোখের পলকে এক একজনকে হজম করে ফেলে।
(২০১২ সালে অবিশ্যি বলে লাথি পিটিয়ে চারজন খেলোয়াড় ফোর্বস পত্রিকার প্রথম চল্লিশে উঠে এসেছে : ডেভিড বেকহ্যাম (#৮), ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (#৯), লিওনেল মেসি (#১১) এবং ওয়েন রুনি (#৩৮)। এই সব কোটিপতি খেলোয়াড়রা ফুটবলের জগতে নেহাতই ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমই যে নিয়মের স্বতঃসিদ্ধতা প্রমাণ করে, এ নিশ্চয় আপনাদের বুঝিয়ে বলার দরকার নেই।)
আরও পড়ুন- বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার
রপ্তানি শিল্প
দুনিয়ার দক্ষিণ দিকের ছোট ছোট দেশে যাদের পা ভালো চলে এবং ভাগ্যদেবী খানিকটা হলেও যাদের ওপর সদয়, এবার তাদের ভ্রমণপথের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেব। নিজের শহর ছেড়ে প্রথমে সে যায় সদরে, সেখান থেকে রাজধানীর ছোট কোনও ক্লাবে। একসময় তাকে তুলনায় বড় ক্লাবে বেচে দেওয়া ছাড়া সেই ছোট্ট ক্লাবটির আর কিছু করার থাকে না। আর বড় ক্লাবের কথা কী বলি মশাই, ঋণের জালে তারা এমন জড়িয়ে যায় যে, বড় কোনও দেশের আরও বড় কোনও ক্লাবে ছেলেটিকে বেচে দেওয়া ছাড়া তাদের উপায় থাকে না। খেলোয়াড়টি এভাবেই ইওরোপে হাজির হয়ে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে।
বেচাকেনার এই শৃঙ্খলে ক্লাবগুলো এবং ঠিকেদাররা, মধ্যস্বত্বভোগী যত আছে- তারাই টাকাপয়সার সিংহভাগ খেয়ে চলে যায়। প্রতিটি স্তরেই আর্থিক অসাম্য চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, তা সে গরিব দেশের দুর্দশাগ্রস্ত পাড়ার ক্লাবই হোক বা দেশের ফুটবল লিগের নিয়ন্ত্রক ইওরোপের সর্বশক্তিমান কোনও ক্লাব।
উদাহরণস্বরূপ যদি উরুগুয়ের কথাই ধরেন, উরুগুয়েতে ফুটবল একটা বিশুদ্ধ রপ্তানি শিল্প, যা আমাদের দেশের স্থানীয় ফুটবলের বাজারকে অবজ্ঞা করে। ক্রমাগত দেশের সেরা প্রতিভারা বাইরে চলে যাওয়া মানে আমাদের লিগটা আরও নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়া, আবেগতপ্ত সমর্থকের সংখ্যা ক্ষীয়মাণ হওয়া। বিশ্বকাপের সময় আমাদের ফুটবলাররা পৃথিবীর চারকোণ থেকে এক জায়গায় জড়ো হয়, সচরাচর তারা বিমানেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। বিশ্বকাপে উরুগুয়ে সাধারণত বেশিদিন টিকতে পারে না, সুতরাং অচিরেই একে অপরকে ‘আলবিদা’ বলে তারা ফের চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। এগারোটা মাথা, বাইশটা পা, কিন্তু একটাই হৃদয়- এমন একটা দল হয়ে ওঠার ন্যূনতম সময়টুকু তারা পায় না।
ব্রাজ়িল যখন চতুর্থবার বিশ্বকাপ জিতল, সেদেশের সাংবাদিকদের অনেকেই উদযাপনের আনন্দঘন মুহূর্তে নিজেদের স্বর্ণযুগের ফুটবলের কথা ভেবে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিল। হোমারিয়ো (রোমারিয়ো), বেবেতোরা নিখুঁত ম্যাচ খেলে জিতেছে ঠিকই, কিন্তু কবিতায় ওদের আগ্রহ নেই : ’৫৮, ’৬২, ’৭০-এ গ্যারিঞ্চা, ডিডি, পেলের দল যেভাবে দর্শকদের সম্মোহিত করে রাখত, এদের খেলায় তার ছিটেফোঁটাও নেই। একাধিক সাংবাদিকের মনে হয়েছে তাদের দলে প্রতিভার ঘাটতি আছে। বহু ধারাভাষ্যকার মন্তব্য করেছে ম্যানেজার যেভাবে দলকে খেলাচ্ছে সেখানেই দেদার গলদ। দলটা জিতছে বটে, তবে খেলায় ব্রাজ়িলের চিরাচরিত জাদু অনুপস্থিত। অবিশ্যি আমার মনে হয় একটা বিষয় কার্যত সবার নজর এড়িয়ে গেছে। ব্রাজ়িলের সেরা সময়ের দলগুলোতে যারা খেলেছে তারা মূলত নিজেদের দেশের ক্লাবেই খেলত। এদিকে ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপে ব্রাজ়িল দলে আটজন এমন খেলোয়াড় ছিল যারা সারা বছর ইওরোপে খেলে।
হোমারিয়োর কথাই যদি ধরেন, সে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি লাতিন আমেরিকার ফুটবলার। হিস্পানি দেশের ক্লাবে খেলে হোমারিয়ো একা যে টাকা পায় তা ১৯৫৮-র ব্রাজ়িল দলের সব খেলোয়াড়ের মোট রোজগারের চেয়েও বেশি। আশা করি, আমরা ভুলে যাব না, ’৫৮-র দলে যারা খেলেছিল তাদের ফুটবলের ইতিহাসের সেরা শিল্পী বলে মনে করা হয়।
আগেকার দিনের তারকা ফুটবলারদের সঙ্গে স্থানীয় ক্লাবের আবেগ জড়িয়ে থাকত। পেলে যেমন স্যান্তোসের, গ্যারিঞ্চা বোতাফোগোর। ডিডির যদিও একবার অল্পদিনের জন্য ইতালিতে গিয়ে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল, তবু দেশের হলুদ জার্সি ছাড়া তাকেও ভাবা যেত না। ব্রাজ়িলের খেলোয়াড়রা এভাবেই অভ্যস্ত ছিল। অন্য দেশেও ছবিটা খুব একটা অন্যরকম ছিল না। জাতীয় দলের জার্সির প্রতি খেলোয়াড়দের আনুগত্য আর আবেগ ছিল প্রশ্নাতীত। বিভিন্ন ক্লাবও চুক্তির নামে আদ্যিকালের সামন্ততান্ত্রিক প্রথা বলবৎ রেখেছিল। উদাহরণ হিসেবে যদি ফ্রান্সের কথা বলি, সেখানকার ক্লাবগুলো খেলোয়াড়দের চৌত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের ওপর কায়েমি স্বত্ব ভোগ করত। স্বাধীন হতে হতে ফুটবলাররা প্রায় ফুরিয়ে যেত। এই সেকেলে একুশে আইনের হাত থেকে বাঁচতে ফ্রান্সের ফুটবলাররা ১৯৬৮-র মে মাসের গণ-অভ্যুত্থানে যোগ দিয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক আন্দোলন, যখন পারি শহরের ব্যারিকেডে জনতার কল্লোল দুনিয়ার মানুষকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। রেমন্ড কোপার নেতৃত্বে সেদিন ফুটবলাররাও রাস্তায় নেমেছিল।
আরও পড়ুন- ৬ গোল হজমের শাস্তি! ভক্তদের পাথরবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ফুটবলাররা…
খেলা ভাঙার খেলা
বল ঘুরলে পৃথিবীও ঘোরে। বহু মানুষের বিশ্বাস সূর্য আসলে একটা জ্বলন্ত বল, যে সারাদিনের কাজ সেরে সন্ধেয় স্বর্গে গিয়ে এন্তার লাফ খায়, আর সেই সুযোগে চাঁদ টুক করে পৃথিবীর দিকে ফেরে। বুঝতেই পারছেন, বিজ্ঞান এসব কথায় আমল দেবে না। অবিশ্যি এব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহই নেই যে ফুটবলের তালে-তালেই দুনিয়া ঘোরে। কুড়ি লক্ষেরও বেশি মানুষ ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখেছে। ফুটবলের ইতিহাস ছেড়ে দিন, আমাদের নীল গ্রহে এত মানুষ সব কিছু ছেড়ে একই জিনিস দেখছে, এমনটাও আগে কক্ষনও হয়নি। ফুটবলের আবেগ প্রেমের মতোই সব সীমান্ত ছাপিয়ে যেতে চায়। তার অনুরাগীরা অনেকে মাঠে, থুড়ি সবুজ তৃণভূমিতে, তার সঙ্গে খেলে খেলে সময় কাটায়। আবার কোটি কোটি লোক বোকা-বাক্সের সামনে গদি আঁটা চেয়ারে বসে দাঁতে নখ খোঁটে! সামনের পর্দায় তখন বাইশজন খেলোয়াড় সেই রহস্যময়ীর প্রেমে আকুল হয়ে হাফপ্যান্ট পরে বল তাড়া করে কিংবা বলে শট নেয়। প্রেমের হাল কে বোঝে শালা!
’৯৪ বিশ্বকাপের পর ব্রাজ়িলে যত বাচ্চা জন্মেছে তাদের সবারই নাম হয়েছে হোমারিয়ো। শুধু তাই-ই নয়, লস অ্যাঞ্জেলেসের যে মাঠে ফাইনাল হয়েছিল, তার ঘাসের চাপড়া পিৎজ়ার মতো বিক্রি হয়েছে। কুড়ি ডলার করে দিলেই এক একটা টুকরো বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। একে কী বলবেন! মহৎ কোনও উদ্দেশ্যে খানিকটা পাগলামি বললে কি খুব আপত্তি হবে? না কি বেওসার সেই সেকেলে অশ্লীলতা? ফুটবলের হর্তাকর্তাদের পয়সা লোটার নতুন ফন্দি? আমি বিশ্বাস করি এই প্রশ্নগুলির প্রত্যেকটিই বৈধ, কিন্তু ফুটবল এর অতিরিক্তও কিছু দেয়। দর্শকদের কাছে ফুটবল হলো দেখার সুখ আর খেলোয়াড়দের কাছে শরীরের সুখ। এক সাংবাদিক জার্মানির গরিবদরদি ধর্মতত্ত্ববিদ ডরোথি জ়লেকে জিগ্যেস করেছিল, "কোনও শিশুর কাছে সুখ শব্দটাকে ব্যাখ্যা করতে হলে কীভাবে বোঝাবেন?"
উত্তরে ভদ্রমহিলা জানিয়েছিলেন, "আমি আদৌ ব্যাখ্যা করতে যাব না। তারচে বরং বাচ্চাটার সামনে একটা বল গড়িয়ে দেব যাতে সে প্রাণভরে খেলতে পারে।"
পেশাদার ফুটবল খেলাটাকে খোজা বানাতে আনন্দের অংশটুকু কেটে বাদ দেয়। তবু খেলার আশ্চর্য গুণ, তাকে যতই দাবিয়ে রাখার চেষ্টা হোক, সে ঠিক মাথা তুলে দাঁড়ায়। তাই ফুটবল আজও দর্শককে আবিষ্ট করার ক্ষমতা হারায়নি। আমার বন্ধু অ্যাঙ্খেল রুয়োকো যেমন হামেশাই বলে, মানুষকে চমকে দেওয়ার একবগ্গা স্বভাবই ফুটবলের সবথেকে বড় গুণ। প্রযুক্তিবিদরা যত খুঁটিনাটি ছকই কষুক না কেন, যত জবরদস্তই হোক তাদের প্রভাব, ফুটবল চিরকালই অসম্ভবের শিল্প রয়ে গেছে। যখন আপনি একেবারেই আশা করেননি, ফুটবলে তখনই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। বামনরাও তালঢ্যাঙাদের উচিত শিক্ষা দেয়। ফালতু কথার ওস্তাদ, ধনুকের মতো বাঁকা পায়ের কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটি বল নিয়ে মাঠে নেমে গ্রিসের প্রাচীন ভাস্কর্যে ফুটে ওঠা খেলোয়াড়কেও হাসিঠাট্টার পর্যায়ে নামিয়ে আনে।
ফুটবল কিন্তু তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। আমাদের সরকারি ইতিহাসের বয়ান কীভাবে ফুটবলকে এড়িয়ে যায় তা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। সমসাময়িক ইতিহাসকাররা ফুটবলকে তাদের চর্চায় ধরতে পারে না, এমনকী সেইসব দেশেও, যেখানে ফুটবল তাদের জাতিসত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ফুটবল খেলে বলেই অনেকে টিকে আছে; ফুটবলের ঘরানা সেসব জাতির অস্তিত্বের অভিজ্ঞান, অন্যদের সঙ্গে ফারাক চেনাতে ফুটবলই তাদের একমাত্র পথ। আমাকে যদি কারও খেলার ঘরানাটুকু বলেন, আমি কিন্তু বলে দেব কাদের কথা বলছেন। স্মরণাতীত কাল থেকে বিভিন্ন ঘরানায় ফুটবল খেলা চলে আসছে, প্রতিটি মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্যের স্মারকচিহ্নের মতো, নিজের সত্তার প্রকাশের মতোই। এই ঐকান্তিক বৈচিত্র্যই আজকের দিনে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি জরুরি। আজকাল হয়েছে কী, সব কিছুকেই একছাঁচে ঢালার বাধ্যতামূলক ঐক্যের নীতি চালু হয়েছে। শুধু ফুটবলেই নয়, সমাজের যেকোনও ক্ষেত্রেই খেয়াল করলে ব্যপারটা সহজেই বুঝতে পারবেন। পৃথিবীতে এত অসাম্যও আগে কক্ষনও ছিল না, তাই মনে হয় জবরদস্তি করে সমস্ত কিছুর উপর একই বৈশিষ্ট্য আরোপের খুল্লামখুল্লা চেষ্টা চলছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ কয়েক বছরে এসে আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে, না খেতে পেয়ে যদি লোকে না-ও মরে, একঘেয়েমির বিরক্তিতে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত।
বছরের পর বছর ধরে আমি এখনকার ফুটবল আর ফেলে আসা দিনে যে ফুটবল দেখেছি তার স্মৃতি-সংঘর্ষ বুকে করে বেঁচে আছি। আমার লেখালিখির মূল কারণই হলো ফুটবল পাগল বিপুল জনতা যে বৈচিত্র্যময় ভাষায় একই আবেগ দেশে-দেশে সঞ্চারিত করে গেছে দিনের পর দিন, তাকে ফুটিয়ে তোলা। পায়ে যে কাজ আমি করতে পারিনি, হাত দিয়ে লিখে তার খানিকটা করার চেষ্টা আর কী! মাঠে নেমে গণ্ডমূর্খের মতো আনাড়িপনা না দেখিয়ে বল দিয়ে আশৈশব যা করতে চেয়েছিলাম, তা-ই শব্দ সাজিয়ে করতে চেষ্টা করলাম।
এই স্পর্ধা নিয়েই, প্রায়শ্চিত্ত-স্বস্ত্যয়ন যাই বলুন না কেন- এই বইখানার জন্ম। ফুটবলের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফুটবলের আলোয় উদ্ভাসিত হতে চাওয়া, ফুটবলের অভিশপ্ত দিকগুলোর সমালোচনা করা। আমি জানি না আমার লেখা ফুটবলের অন্তরাত্মাকে ছুঁতে পারল কিনা। কিন্তু গোটা লেখাটা আমার ভেতরে তৈরি হয়েই ছিল, লিখতে লিখতে যার শেষের পাতায় আজ এসে পৌঁছেছি। আজ যখন শেষ করেই ফেললাম তখন এ বই আর আমার রইল না, এটা আপনাদের সক্কলের। এই মুহূর্তে আমার অনুভূতিটা কী রকম জানেন? বিছানায় ভালোবাসাবাসির পর চিৎ হয়ে পড়ে থাকার সময় বা কোনও ফুটবল ম্যাচ শেষ হয়ে যাবার পর যে তীব্র বিষাদ আমাদের ঘিরে ধরে- ঠিক সেই রকম।