পূর্বপুরুষকে ক্রীতদাস করে রেখেছিল যারা, তাদের হয়েই ফুটবল খেলত কৃষ্ণাঙ্গরা...
Football World Cup 2010: এই বিশ্বকাপ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় মনীষীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর সুযোগ।
২০১০-এর বিশ্বকাপ
আন্তর্জাতিক স্তরে খবর রটে গেল ইরান নাকি পরমাণু বোমা বানাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই দুনিয়া জুড়ে প্রচার শুরু হলো এই মুহূর্তে মানবতার পক্ষে ইরানের মতো অমঙ্গলজনক আর কিছু নেই। কী কাণ্ড বুঝুন, যেন ইরানিরাই হিরোশিমা নাগাসাকির সাধারণ নাগরিকের ওপর একদিন পরমাণু বোমা মেরে এসেছিল।
আন্তর্জাতিক জলপথে যে জাহাজগুলো প্যালেস্তাইনে খাদ্য-ওষুধ আর শিশুদের জন্য খেলনা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, ইজ়রায়েল তার চিরকেলে বোম্বেটে স্বভাবে সেগুলোকে মেশিনগান চালিয়ে ধ্বংস করল। ফিলিস্তিনিদের ওরা এভাবেই শায়েস্তা করে অভ্যস্ত, যেন ইহুদি বিদ্বেষ আর সন্ত্রাসের যত দায় সবই ফিলিস্তিনিদের নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাঙ্ক আর ক্ষমতাবান অনেক দেশের সরকার মিলে গ্রিসকে লাঞ্ছনায় ভরিয়ে দিচ্ছিল। তাদের জোর করছিল অসম্মানজনক শর্তের সামনে মাথা নিচু করতে, যেন সেই ১৯২৯ সাল থেকে পৃথিবীর অর্থনৈতিক সংকটের জন্য ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাঙ্কগুলোর কোনও দায় নেই, যত দোষ গ্রিসের।
পেন্টাগন উল্লসিত হয়ে প্রচার করছিল তাদের বিশেষজ্ঞরা নাকি আফগানিস্তানে মাটির নীচে এক লক্ষ কোটি ডলারের খনিজ সম্পদ- সোনা, কোবাল্ট, তামা, লোহা, বিশেষ করে লিথিয়াম খুঁজে পেয়েছে। মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপের জন্য লিথিয়াম অত্যন্ত লোভনীয় এবং জরুরি উপাদান। মার্কিনিদের হালচাল দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন ন'বছর ধরে অন্য একটা দেশে ঢুকে, যুদ্ধ করে, হাজার হাজার মানুষকে মেরে, অবশেষে ঈপ্সিত বস্তুর সন্ধান পেয়েছে।
কলম্বিয়ায় একটি গণকবর আবিষ্কৃত হলো। সেই কবর থেকে দু'হাজার অজ্ঞাতপরিচয় মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেল। সেনাবাহিনী ওই দু'হাজার মানুষকে গণকবর দিয়েছিল। কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী বোঝাবার চেষ্টা করেছিল ওরা গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতেই যেন লোকগুলোকে মেরেছিল। কিন্তু আশপাশের এলাকার মানুষ জানে কবর দেওয়া লোকগুলোর একজনও গেরিলা নয়। ওরা কেউ নাগরিক সমিতির সদস্য, কেউ সামাজিক কাজে নিয়োজিত ছিল, কেউ-বা নেহাতই চাষাভুষো কিন্তু ওরা সবাই মাতৃভূমির জন্য লড়ছিল।
মেহিকো উপসাগর একটা তেলের ডোবায় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ায় আমাদের বাস্তুতন্ত্রে ভয়ংকর বিপর্যয় ঘনিয়ে এল। শুরুর দেড়মাস পরেও উপসাগরের তলায় পেট্রো-আগ্নেয়গিরির তেল উগরে যাওয়া এতটুকু কমল না। গোটা ঘটনাটার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যারা, সেই ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম দিব্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শিস দিতে দিতে ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। এত বড় দুর্ঘটনায় যেন ওদের কোনও ভূমিকাই নেই।
পৃথিবীর বহু দেশের ক্যাথলিক গির্জা থেকে যৌন নিপীড়ন আর শিশু ধর্ষণের খবর উপচে পড়ছিল। এতদিন রীতিমতো সন্ত্রস্ত করে যেসব খবর ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল, সেগুলো প্রকাশ্যে চলে এল। যদিও কায়েমি যাজকতন্ত্র নির্লজ্জের মতো বোঝাবার চেষ্টা করছিল যে এমন ঘটনা গির্জার বাইরেও আকছার ঘটে, সুতরাং এতে ক্যাথলিকদের দায়ী করাটা নেহাতই বাড়াবাড়ি হচ্ছে। যেন এইসব ছেলেভুলানো কথায় ওদের পাপস্খলন হবে। ওরা এটাও বলবার চেষ্টা করছিল যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাকি যাজকদের প্ররোচিত করা হয়েছে। যেন সব দায় যারা যৌন নিপীড়নের শিকার তাদেরই।
ফিদেল কাস্ত্রো যে দাপটের সঙ্গে বেঁচে আছে সেই সত্যটাও মিয়ামির সর্বজ্ঞ মাতব্বররা অস্বীকার করছিল। যেন কাস্ত্রো প্রতিদিন ওই মাতব্বরদের মুখ তেতো করে দেবার মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলছিল না।
আরও পড়ুন- “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি
দুই অতুলনীয় লেখক, হোসে সারামাগো আর কার্লোস মনসিভাইস চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন। আমরা এই ক্ষতিকে অপূরণীয় বলছি, যেন আমরা জানি না, ওঁরা কবরে শুয়েও দুনিয়ার হিংসুটে দৈত্যগুলোর রাতের ঘুম ছুটিয়ে দিতে পারেন।
জার্মানির সেন্ট পাউলি ক্লাব সেদেশের ফার্স্ট ডিভিশন লিগে ফিরে আসায় হামবুর্গ বন্দরে বিপুল জনতা উল্লাস করছিল। আর যেটা অবিশ্বাস্য, ওই ক্লাবের আদর্শ হলো, "বর্ণ বিদ্বেষ, পুরুষতন্ত্র, সমকামী বিদ্বেষ এবং নাৎসিবাদ খতম করা।" ভাবতে পারেন, জার্মানিতে এমন ক্লাবও আছে যারা এইসব কথা বলে! অথচ তাদের দু'কোটি সমর্থক !
ওদিকে জার্মানি থেকে বহুদূরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঊনবিংশতিতম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসল। দক্ষিণ আফ্রিকায় কাপটি মুড়ে রাখা হয়েছিল বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী স্লোগান লেখা ব্যানারে। সহজেই অনুমান করতে পারছেন, পরবর্তী এক মাস পৃথিবী লাটিমের মতো বনবন করে ঘোরা স্থগিত রেখেছিল। আর আমার মতোই, এই গ্রহের বেশ কিছু বাসিন্দা দমবন্ধ করে বসেছিল।
এবারেও সেই মাঝারিয়ানার চর্বিতচর্বণ চলল, কেবল আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই প্রথম আফ্রিকার মাটিতে ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসল।
ছায়াবৃতা, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকা, উপেক্ষিত-অবজ্ঞাত, চিরকাল যাদের নৈঃশব্দ্যের আবিল দৃষ্টিতে অবহেলা করা হয়েছে, মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে- সেই আফ্রিকাই দুনিয়ার মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যাবতীয় আলো নিজের মুখে টেনে নিল, অন্তত বিশ্বকাপের দিনগুলোতে তো বটেই।
কুবেরের ভাণ্ডার উজাড় করে বানানো দশটা স্টেডিয়ামে বত্রিশটা দেশ যুদ্ধ করতে নামল। কেউ জানে না, দক্ষিণ আফ্রিকা ইট-কাঠ-পাথরে বানানো এই বিপুল জলহস্তীগুলোকে কী করে পুষবে। বিশ্বকাপের জেল্লা বাড়াতে বহু কোটি টাকা খরচ করার মানে বুঝতে অসুবিধে হয় না, কিন্তু বৈষম্যে ভরা একটা দেশে এর যুক্তিগ্রাহ্যতা বুঝতে সত্যিই কষ্ট হয়।
নেলসন ম্যান্ডেলার স্মৃতিতে নামাঙ্কিত শহরে ফুলের মতো দেখতে স্টেডিয়ামের বিশাল পাপড়িগুলো ধীরে ধীরে উন্মোচিত হল।
এই বিশ্বকাপ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় মনীষীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর সুযোগ। ম্যান্ডেলা যে চারাগাছটি পুঁতেছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে সেই গাছের ফল ফলতে দেখেছি আমরা। যদিও ওদেশের কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও সবচেয়ে বেশি গরিব। এখনও পুলিশ আর প্লেগের মার তাদেরই বেশি সইতে হয়। ওরাই ভিখিরি আর বেশ্যার জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ পথশিশুরও গায়ের রং কালো। অবিশ্যি তাদের বিশ্বকাপের আগেই সাময়িকভাবে গায়েব করে দেওয়া হয়, যাতে বাইরের দেশের সামনে এসব জঘন্য ছবি না যায়।
গোটা টুর্নামেন্ট জুড়েই দেখা গেল আফ্রিকার ফুটবল নিজেদের সাবলীল সক্ষমতা ধরে রাখলেও উদ্ভাবনী শক্তি হারিয়েছে। ওদের খেলায় এখন দৌড় বেশি, নাচ কম। অনেকেই মনে করে আফ্রিকার দলগুলোর জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইওরোপ থেকে ম্যানেজার নিয়ে আসায় এই অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটেছে। ইওরোপিয় কোচেরা আফ্রিকার প্রাণবন্ত ফুটবলকে একেবারে হিমঘরে ঢুকিয়ে ছেড়েছে। যদি এই অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে ইওরোপের এইসব কোচ নামধারী লোকগুলো প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা ফুটবলের বারোটা বাজিয়ে দিল।
কেজো ফুটবলের নামে আফ্রিকা তাদের দুরন্ত ছন্দ বলি দিয়ে বসল। কেজো ফুটবলের কাছে তো আর কেউ সৌন্দর্য আশা করে না। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ঘানা প্রথম আটে উঠে এসেছিল। কিন্তু তারাও একসময় ছিটকে গেল। ঘানা চ্যাম্পিয়নশিপের বাইরে চলে যাওয়ায় আফ্রিকার আর কোনও প্রতিনিধি রইল না, এমনকী আয়োজক দেশও না।
অবিশ্যি বহু আফ্রো-বংশজাত খেলোয়াড় টুর্নামেন্টে টিকে রইল। যদিও তারা খেলছিল সেইসব দেশের হয়ে, যারা তাদের পূর্বপুরুষকে ক্রীতদাস করে রেখেছিল।
এবারের বিশ্বকাপে বোয়াটেং ভাইয়েরা একে অপরের বিরুদ্ধে খেলল। ওই দুই সহোদর ভাইয়ের বাপ ঘানার মানুষ। কিন্তু তারা একজন ঘানার, অন্যজন জার্মানির জার্সি পরে মাঠে নেমেছিল।
ঘানার জাতীয় দলে এমন কোনও খেলোয়াড় ছিল না যে সেদেশের ফুটবল লিগে খেলে।
জার্মানির জাতীয় দলের সব ফুটবলার দেশের মাটিতেই সারা বছর খেলে।
লাতিন আমেরিকার মতোই আফ্রিকাও কর্মক্ষম হাত-পা রফতানি করে আসছে বহুদিন থেকে।
এবারের বিশ্বকাপের আধপাগলা বলটার নাম ‘জাবুলানি’, সে ক্রমাগত খেলোয়াড়দের হাত-পা এড়িয়ে নিজের খেয়ালে চলছিল। খেলোয়াড়রা ব্যপারটা একটুও পছন্দ না করলেও অ্যাডিডাসের এই মহানুভবতা মেনে নিতে বিশ্বকাপ বাধ্য ছিল। জ়ুরিখের প্রাসাদ থেকে ফুটবলের প্রভুরা কক্ষনও প্রস্তাব করেন না, তারা নির্দেশ দেন। ওটাই তাদের কাজের ধরন।
আরও পড়ুন- ফাইনালে মাঠে ঢুকে পড়ল ষাঁড়! বিশ্বকাপের মোড় ঘুরিয়ে দিল জিদানের ঢুঁসো…
এবারের বিশ্বকাপে কিছু পদাধিকারীর বিতিকিচ্ছিরি ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ফুটবল প্রশাসনে সাধারণ জ্ঞানের কতটা অভাব।
সাধারণ জ্ঞান মাথা কুটে মরল। তবু রেফারিদের সন্দেহজনক ক্ষেত্রে ভিডিও দেখে সিদ্ধান্ত বদলের সুযোগ দেওয়া হলো না। প্রযুক্তি আজকাল এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে রেফারি চাইলে একনজরে ঘড়ি দেখে খেলার সময় নির্ধারণের মতোই অবলীলায় ভিডিও দেখে নিতে পারে।
সব খেলাতেই, বাস্কেটবল, টেনিস, বেসবল, সাঁতার, এমনকী তলোয়ার চালানো, কার রেসিংয়ের মতো খেলাতেও বৈদ্যুতিন যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ফুটবলের মোহন্তরা তা চায় না। তাদের জবাব শুনে হাসি পাবে, যদি না এর মধ্যেও তাদের গোপন কোনও অভিসন্ধি থাকে! ওরা বলে, "ভুল খেলারই অঙ্গ"। ভুল করা মানুষের লক্ষণ! ওদের মুখে এমন দার্শনিক কথা শুনে আমাদের মুখ তোম্বা করে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।
এবারের টুর্নামেন্টে সবচেয়ে ভালো গোলটা যে বাঁচিয়েছিল সে কিন্তু গোলকিপার নয়, একজন স্ট্রাইকার। উরুগুয়ের আক্রমণভাগের খেলোয়াড় লুইস সুয়ারেস একটা মরণ-বাঁচন ম্যাচের শেষ মিনিটে গোল লাইনে দাঁড়িয়ে পিছল ‘জাবুলানি’কে দু'হাত দিয়ে ঠেকায়। ওই গোলটা হজম করলে উরুগুয়ের দৌড় এবারের মতো থেমে যেত। কিন্তু সুয়ারেসের খ্যাপাটে দেশপ্রেম উরুগুয়েকে বাঁচিয়ে দিল। তাকে অবিশ্যি লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
উরুগুয়ে এবার নিঃশব্দে, সবার শেষে, যন্ত্রণাদায়ক যোগ্যতানির্ণায়ক পর্ব উৎরে বিশ্বকাপে এসেছিল। কিন্তু চ্যাম্পিয়নশিপের মূলপর্বে তারা কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়েনি। লাতিন আমেরিকা থেকে আসা দলগুলোর মধ্যে তারাই একমাত্র সেমিফাইনালে পৌঁছয়। উরুগুয়ের সংবাদমাধ্যমে দেশের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বারবার জানাচ্ছিল, "হার্টের ব্যামো থাকলে অতিরিক্ত আনন্দও চরম দুর্ভোগ ডেকে আনতে পারে।" কিন্তু কী জানেন, আমার মতো বহু উরুগুয়েবাসীর মনের কোণে একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। মরি তো মরব, কিন্তু এই একঘেয়ে জীবন আর সহ্য হচ্ছে না মাইরি! দেশের পথঘাটে তো রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর তা হবে নাই বা কেন, অন্য দলের হার দেখার চেয়ে নিজের দেশের জেতা দেখা তো যে কোনও অবস্থাতেই বাড়তি সুখ দেয়, না কি!
উরুগুয়ে শেষ পর্যন্ত চতুর্থ হয়েছিল। খুব খারাপ ফল বলা যাবে না। তাছাড়া উরুগুয়েই বিশ্বকাপ নামটাকে টিকিয়ে রেখেছিল, নইলে তো ওটা আবার একটা ইউরো কাপ হয়ে যেত।
আমাদের দেশের স্ট্রাইকার দিয়েগো ফোরলান বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হলো।
শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতল হিস্পানিরা। আগে কখনও বিশ্বকাপ না জেতা একটা দল, কিন্তু তাদের এগারোজন খেলোয়াড় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংহতির ফুটবল খেলল। ওদের মন্ত্র ছিল সবাই সবার জন্য খেলবে। আর ওদের দলের খুদে জাদুকর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার কথা তো আলাদা করে বলতেই হবে।
ফাইনালে নেদারল্যান্ডস নিজেদের চিরাচরিত অভ্যেস বজায় রেখে ফের পেছনে লাথি খেল।
গতবারের চ্যাম্পিয়ন আর রানার্স দল অবিশ্যি ভালো করে সুটকেস খোলার আগেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যায়। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আগেরবার ইতালি আর ফ্রান্স ফাইনাল খেলেছিল। এবার তাদের দেখা হলো বাড়ি ফেরার সময় বিমানবন্দরের চাতালে। ইতালিতে মানুষ সুর চড়াল তাদের নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের কৌশল নিয়ে। তারা এবারের বিশ্বকাপে নিজের খেলায় মন না দিয়ে অন্যের খেলা ভেস্তে দেবার চেষ্টা করছিল। আর ফ্রান্সে তো বর্ণবিদ্বেষ এমন জায়গায় পৌঁছল যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে নেমে ‘লা মার্সেইজ়’-এর সুরে যারা গলা মিলিয়েছিল তারা বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়।
সম্ভাব্য বিজয়ীদের মধ্যে ইংল্যান্ডও বেশিদূর এগুতে পারেনি।
আরহেন্তিনা আর ব্রাজ়িলকে খুবই হেনস্তা হতে হলো। ব্রাজ়িলকে তো মাঠে চেনাই যাচ্ছিল না। মাঝে মধ্যে যখন তারা রক্ষণশীলতার খাঁচা ছেড়ে সামান্য একটু বাইরে বেরুচ্ছিল, তখন তবুও খানিকটা তাকানো যাচ্ছিল। নইলে এই ব্রাজ়িলকে কেউ দেখতে চায় না। ওদের অসুখটা ঠিক কী? এমন দ্বিধাভরা সন্দেহজনক দাওয়াই দিতে হলো কেন?
আরহেন্তিনার শেষ ম্যাচে জার্মানি অঝোর বৃষ্টির মতো গোলের পর গোল করে গেল। পঞ্চাশ বছর আগে আরহেন্তিনা যখন হেরে বিপর্যস্ত অবস্থায় দেশে ফিরেছিল তখন দেশের মানুষ তাদের পয়সা ছুঁড়ে মেরেছিল। কিন্তু এবার জনতা তাদের সাদরেই বরণ করে নিল। এতেই ভরসা জন্মায় যে, এখনও এমন মানুষ আছে যারা হারা-জেতার ওপরে উঠেও ভাবতে জানে।
এই বিশ্বকাপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল পেশাদার ফুটবলের পাশবিক গতিতে দমছুট হয়ে গিয়ে খেলোয়াড়দের চোট পাবার প্রবণতা কী হারে বাড়ছে। আপনি বলতে পারেন খেলোয়াড়রা এতে বড়লোক হচ্ছে। কেউ কেউ ঈর্ষণীয় রকমের ধনী হয়ে উঠছে। কিন্তু আপনাদের মনে করিয়ে দিই, সেটা একেবারে মুষ্টিমেয় কিছু খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে সত্যি। কিন্তু অন্য দিকটা দেখুন, হপ্তায় দুটো বা তার চেয়েও বেশি ম্যাচ খেলে, দিনরাত যন্ত্রের মতো হাড়ভাঙা অনুশীলন করে তারা কার্যত পণ্যসংস্কৃতির জ্বালানির কাজ করছে। খেলার বাইরে তারা অকাতরে গেঞ্জি-জাঙিয়া, গাড়ি, সুগন্ধি কিংবা দাড়ি কামানোর সরঞ্জামের বিজ্ঞাপন করে চলেছে। কেউ আবার পত্রিকার চকচকে মলাটে ছাপার জন্য নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। দিনের শেষে ভালো করে ভাবলে বুঝতে পারবেন, আমরাও এমন দাস পুষি যারা বস্তুত কোটিপতি।
এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত ও অনুমিত তারকারা কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী জ্বলে উঠতে পারেনি। লিওনেল মেসি অবিশ্যি নিজের সর্বস্ব দিয়ে মাঠে টিকে থাকতে চেয়েছিল। কিছুটা ঝলকও দেখা গেছে তার পায়ে। ওদিকে সবাই বলছিল ক্রিশ্চিয়ানো হোনাল্দো (রোনাল্ডো) নাকি বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে! কিন্তু তাকে দেখা গেল কই? অবিশ্যি ও নিজেকে দেখতেই বেশি ব্যস্ত ছিল।
আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল
এবার বরং নতুন এক তারকার জন্ম হলো। সাগরের তলদেশ থেকে উঠে এসে সে অকস্মাৎ ফুটবলের আকাশে সবার চেয়ে উঁচু আসনে বসে পড়ল। জার্মানির এক অ্যাকোয়ারিয়ামে থাকা অক্টোপাসটির কথা বলছি। তার নাম দেওয়া হয়েছিল পল, যদিও আমার মনে হয় তার নাম হওয়া উচিত ছিল অক্টোদামুস।
এই অক্টোপাসের ভেল্কিতে ফুটবল জুয়াও নিয়ন্ত্রিত হতে থাকল। গোটা ফুটবল দুনিয়া ধর্মোপদেশ শোনার মতো শ্রদ্ধাবনত হয়ে তার ভবিষ্যৎবাণী শুনছিল। আমার মতো একরোখা লোকও, কখনও তাকে ভালোবাসছিলাম, কখনও ঘৃণা করছিলাম, তার নামে কটূক্তিও করেছি। সে যখন জানাল উরুগুয়ে জার্মানির কাছে হারবে, তখন আমি বলেছিলাম, "শালা, একেবারে বিক্রি হয়ে গেছে"।
বিশ্বকাপ শুরুর দিন আমি বাড়ির দরজায় একটা কাগজ সেঁটে তাতে লিখে দিয়েছিলাম, "বিশ্বকাপের জন্য দরজা বন্ধ থাকবে।"
এক মাস বাদে যখন কাগজটা দরজা থেকে ছিঁড়ে নিলাম, ততদিনে আমি নিজের প্রিয় চেয়ারে বসে, হাতে বিয়ার নিয়ে চৌষট্টিটা ম্যাচ খেলে ফেলেছি।
এই অত্যাচারে আমার শরীর ভেঙে গেছে। পেশিগুলো শক্ত হয়ে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। কিন্তু এখন কেমন যেন স্মৃতিকাতর লাগছে। ভুভুজ়েলার একটানা আওয়াজটা আর শুনব না ভেবে মন খারাপ করছে। কিংবা ধরুন, হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দেবার মতো গোলগুলোও তো আর দেখব না। কেউ অসামান্য খেললে যখন খেলার মাঝেই ধীর লয়ে ‘রিপ্লে’ দেখানো হয়, সেই আনন্দের তুলনা হয়! ফুটবলে আনন্দ-শোক দুটোই আমাকে টানে। বোঝেনই তো, কোনও কোনও সুখ যন্ত্রণাও দেয়। আমি হয়তো আর জেতার আনন্দে মানুষের গান শুনব না, যে গানের সুরে মরা মানুষও বেঁচে ওঠে। আমার অবস্থা এখন সমস্ত দিনের কোলাহল শেষে রাতের শূন্য স্টেডিয়ামের মতো, যেখানে একজন পরাজিত, যার নড়ারও ক্ষমতা নেই, ওই বিপুল গ্যালারিগুলোর সামনে মাঠের মধ্যিখানটিতে বসে আছে। একা।