চার বছরে ৪০টিরও বেশি মামলা! অবাক করবে শেখ শাহজাহানের 'অপরাধে'র ফিরিস্তি

Sheikh Shajahan Arrested: চার বছরে তার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে ৪২টি মামলা। এর মধ্যে ৪১টিরও বেশি ক্ষেত্রে চার্জশিট দাখিল হয়ে গিয়েছে। তবে পুলিশ নিরুত্তাপ।

প্রায় ৫৫ দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পরে অবশেষে ধরা পড়েছে সন্দেশখালির 'ত্রাস' শেখ শাহজাহান। সন্দেশখালি এলাকার তৃণমূলের নেতা, বিরাট তার প্রতাপ। তার ভয়ে থরোথরো কাঁপেন মানুষ। জমি জবরদখল থেকে নারী নির্যাতন, কী নেই অভিযোগের তালিকায়। তবে শাসক দল ঘনিষ্ঠ হওয়ার দৌলতে এতদিন তিনি ছিলেন সমস্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে। চার বছরে তার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে ৪২টি মামলা। এর মধ্যে ৪১টিরও বেশি ক্ষেত্রে চার্জশিট দাখিল হয়ে গিয়েছে।

তবে তার প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়নি এতদিন সন্দেশখালিতে। সেখানে কিন্তু বেশ বহাল তবিয়তেই ছিল শেখ শাহজাহান। দলবল সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দিব্যি অত্যাচার চালিয়ে গিয়েছে বাসিন্দাদের উপরে। রাতবিরেতে ডেকে পাঠিয়েছে গ্রামের মেয়ে বউকে। ইচ্ছা মতো আটকে রেখেছে। ইচ্ছে মতো খাটিয়েও নিয়েছে। আপত্তি জানালে পরিবারের পুরুষদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি, মার। তাতেও কাজ না হলে, দাও চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে। যাতে ফসল ফলানোর আর যোগ্য না থাকে সেই জমি। জবরদখল করে নাও গরিব মানুষগুলোর একখণ্ড জমি। দিব্যি চলছিল এভাবেই। গোল বাঁধল গত জানুয়ারি মাসে ইডি হানা দেওয়ার পরেই। গ্রেফতারি এড়াতে গা ঢাকা দিল শেখ শাহজাহান। বৃহস্পতিবার গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে শেখ শাহজাহান জবানবন্দি দিয়েছে, পরিকল্পনা করেই ইডি আধিকারিকদের উপরে হামলা চালানো হয়েছিল।

চার বছরে শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে এই যে রাশি রাশি মামলা, তার মধ্যে জামিন অযোগ্য মামলাও রয়েছে দু-একটি, তা সত্ত্বেও কিন্তু সন্দেশখালির তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। এমনকী তাকে 'পলাতক' তকমা দেওয়া পর্যন্ত নয়। শাহজাহান গ্রেফতার তো হয়ইনি বরং অভিযোগকারীকেই হেনস্থা হতে হয়েছে। এমনকী মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ভিটেমাটি খোয়ানোরও নজির রয়েছে। শাসক দলের দুষ্কৃতি, শাসক দলের পুলিশ। অতএব বহু ক্ষেত্রেই কৌশল করে শাহজাহানের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিতে তেমন অসুবিধা হয়নি মোটেই।

আরও পড়ুন: CID-র হাতে শাহজাহান-মামলার ভার , কোন পথে এগোবে সন্দেশখালি-তদন্ত?

একটা সময় বাধ্য হয়েই পথে নেমেছিল সন্দেশখালির মানুষ। শেখ শাহজাহানের গ্রেফতারির দাবিতে, এতদিন ধরে নানাপ্রকার হেনস্থা হওয়ার প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল তারা। শেখ শাহজাহানের প্রধান দুই সহকারী উত্তম ও শিবু গ্রেফতার হলেও টিকির দেখা মেলেনি শাহজাহানের। গোড়া থেকেই সন্দেশখালির আন্দোলনকারীদের একাংশ দাবি করে এসেছিল, পুলিশ সব জানে। শাসকদলের ছত্রছায়াতেই নিরাপদে রয়েছে শেখ শাহজাহান। বিরোধীরাও তেমনটাই দাবি করেছিলেন। দিন কয়েক ধরেই তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে ইঙ্গিত মিলছিল যে সময় হয়ে এসেছে শেখ শাহজাহানের। লোকসভা ভোটের আগে সন্দেশখালি যেন গলায় কাঁটা হয়ে ওঠে তৃণমূল সরকারের। ফলে তা উপড়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তাও বাড়তে থাকে।

অবশেষে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মিনাখাঁ থেকে গ্রেফতার হয় শেখ শাহজাহান। সেখান থেকে তাকে বসিরহাট আদালতে পেশ করা হয়। সেখানে দশ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ হয় শেখ শাহাজাহানের। এরপর বসিরহাট থেকেই গ্রিন করিডোর করে কলকাতার ভবানী ভবনে নিয়ে আসা হয় শেখ শাহজাহানকে। আপাতত সেখানেই রাখা হবে তাকে। ইতিমধ্যেই মামলায় ভার গিয়েছে সিআইডির হাতে। অবশ্য ভবানী ভবনে শাহজাহানকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে রাজ্যপুলিশও।

গ্রামবাসীরা বলেছেন, শেখ শাহজাহান কোথায় রয়েছে, তারা জানেন। পুলিশ তো বিলক্ষন জানেনই। বিরোধীরাও তেমনটাই বলেছেন। এদিকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বা কুণাল ঘোষের মুখ থেকে শব্দ খসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীঘরে শেখ শাহজাহান। তবে কি এতদিন জেনে-বুঝেই পুলিশ চুপ করেছিল। কেন সব জেনেও গ্রেফতার করা হয়নি শেখ শাহজাহানকে? কেন ৫৫ দিন সময় লাগল শেখ শাহাজাহানের মতো দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করতে? তার উত্তর অবশ্য মেলেনি পুলিশের তরফে। বরং সকাল থেকেই শেখ শাহজাহানেক গ্রেফতারি নিয়ে গোপনীয়তা, কৌশল ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে পুলিশকে। যেমন একটি সূত্র বলছে, সন্দেশখালি রাজবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল শাহজাহানকে। কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মিনাখাঁয়। পুলিশ সরকারি বিবৃতিতে জানায়, মিনাখার ভেড়ি এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় সে। এমনকী থানার বদলে সটান কোর্ট লকআপে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শাহজাহানকে। আদালতে বারোটায় শুনানির কথা থাকলে তা এগিয়ে দেওয়া হয় হঠাৎ করেই। আদালত থেকে বের করে কলকাতায় নিয়ে আসার পথেও কম কৌশল অবলম্বন করেনি পুলিশ।

প্রাথমিক ভাবে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের জন্যই দেরি হয়েছিল শাহজাহানের গ্রেফতারিতে। তবে সেই বাধাও কাটে। সোমবারই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাধা নেই শাহজাহানের গ্রেফতারিতে। তার পরেই বৃহস্পতিবার ধরা পড়ল সন্দেশখালির 'ত্রাস'। এদিনই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন শেখ শাহজাহানের আইনজীবী। এই মামলায় যুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয় হাইকোর্টের কাছে। তবে সেখানে খুব একটা সদুত্তর পাননি শাহজাহানের আইনজীবী। ইতিমধ্যেই ধৃত তৃণমূল নেতার আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে। ইডির উপরে হামলার সাম্প্রতিকতম মামলা তো রয়েইছে। এর সঙ্গেই শেখ শাহজাহানের মাথায় ঝুলছে আরও ৪২টি মামলার খাঁড়া। সেই প্রসঙ্গ তুলেই এদিন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহজাহানের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, "৪৩ টি মামলাও আছে। আগামী ১০ বছর আপনাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হবে। এই মক্কেলের অনেক কাজ করতে ব্যস্ত থাকতে হবে। ৪-৫ জন জুনিয়র রাখতে হবে।" পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি এ-ও সাফ জানিয়ে দেন, শেখ শাহজাহানের মতো দুষ্কৃতীর জন্য তাঁর কোনও সমবেদনা নেই।

আরও পড়ুন:কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কী কী জানালেন সন্দেশখালির ‘ত্রাস’ শেখ শাহজাহান?

শাহজাহানের গ্রেফতারির পর অকাল হোলিখেলা শুরু হয়েছে সন্দেশখালিতে। যেন একটা উৎসব। হবে না-ই বা কেন! কম নিগ্রহ, কম অত্যাচারের মুখোমুখী হতে হয়েছে সন্দেশখালিবাসীকে শাহজাহান ও তার দলবলের জন্য। সন্দেশখালির অসীমা দাস, নয়ন সর্দারদের কথায়, "আমাদের সব কিছুর বিচার এত দিন শাহজাহান করে এসেছে। ওর রক্তচক্ষুর রোষে কত মানুষ যে নিঃস্ব হয়েছে, তা শুধু এখানকার বাসিন্দারাই জানেন।" ন্যাজাট থানার ভাঙ্গিপাড়াতে ২০১৯ সালের ৮ জুন গুলিতে খুন হন প্রদীপ মণ্ডল, সুকান্ত মণ্ডল, দেবদাস মণ্ডলেরা। মৃতের পরিবারের তরফে ন্যাজাট থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়। নিহত প্রদীপের স্ত্রী পদ্মা বলেন, "শাহজাহানের নাম দিয়েই অভিযোগ করেছিলাম। সেই মামলা সিআইডি নিল। আদালতে চার্জশিট যখন পেশ করল, তখন জানলাম শাহজাহানের নামটিই বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা সিবিআই তদন্তের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।" ন্যাজাট থানার সুন্দরীখালি গ্রামের বাসিন্দা অরুণ লস্করের দাবি, ‘‘আমার সম্পত্তি নিয়ে ২০১৭ সালে বিবাদ চলাকালীন রাজবাড়ি ফাঁড়ির কাছে আমার স্ত্রীর প্রতি অশালীন ব্যবহার করে শেখ শাহজাহানের ঘনিষ্ঠ জিয়াউদ্দিন। প্রতিবাদ করায় স্ত্রীকে মারধর করা হয়।’’ এর প্রতিবাদে মিছিল হলে শাহজাহানের নেতৃত্বে গুলি চলে, এক মহিলা গুলিতে জখম হন বলে তাঁর দাবি। তাঁর আরও দাবি, শাহজাহানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও কোনও পদক্ষেপ করেনি পুলিশ। উল্টে অভিযোগকারীদেরই মামলায় জড়ানো হয়। ২০০৯ সালে বাম আমলেও শাহজাহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল সরবেড়িয়ায় একটি অনুষ্ঠানে হামলা ও মারধরের। তখনও শাহজাহানের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল এবং পুলিশ পদক্ষেপ করেনি, দাবি এলাকাবাসীর।

এমন অভিযোগ সন্দেশখালিতে ঝুড়ি ঝুড়ি। যার এতদিন বাদে প্রতিকার পেয়েছেন সন্দেশখালির মানুষ। শাসকঘনিষ্ঠ শেখ শাহজাহানের আদৌ শাস্তি হবে কিনা ওঁরা তা জানেন না। যদিও তৃণমূলের তরফে দোষীর সর্বোচ্চ সাজারই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই তৃণমূলের সমস্ত পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে শেখ শাহজাহানকে। দল থেকেও ৬ বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে শেখ শাহজাহানকে। তবে শাহজাহান সত্যিই শাস্তি পাবে রাজ্যপুলিশের হাতে, তেমন প্রত্যয় হয় না অধিকাংশ গ্রামবাসীরই। কিন্তু সন্দেশখালিকে যে শাহজাহানমুক্ত করা গিয়েছে, এটাই তাঁদের কাছে আপাতত বিরাট সাফল্য।

More Articles