পঞ্চাশ বছর আগে হারিয়েছিলেন পরিবার, আর এক গণঅভ্যুত্থানে দেশ হারালেন মুজিব-কন্যারা
Sheikh Hasina: সোমবার দুপুরে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে রইলেন তাঁর সেই চিরন্তন সঙ্গী শেখ রেহানা।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে একই রকম ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর পরিবার। তখন শেখ হাসিনা বোন রেহানার সঙ্গে জার্মানিতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট গণঅভ্যুত্থান হল বাংলাদেশে, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন নিম্নপদস্থ কর্তা। পদচ্যুত করা হল শেখ মুজিবুরকে। শুধু পদচ্যুতই করা হল না, সপরিবারে খুন পর্যন্ত করা হল তাঁকে। একই সঙ্গে হত্যা করা হল আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও দেশের মন্ত্রীদেরও। এক লহমায় মা-বাবা-ভাই, গোটা পরিবারকে হারিয়ে ফেললেন দুই বোন। অথচ যখন জার্মানি যাওয়ার জন্য বিমানে চেপে রওনা দিলেন তাঁরা, তখনও বিমানবন্দরে ছাড়তে এসেছিলেন মুজিবুররা। তখনও কি ঘুনাক্ষরে ভেবেছিলেন তাঁরা, এ দেখাই শেষ দেখা। বাবা-মা-ভাইয়ের সঙ্গে আর জীবনেও দেখা হবে না দুই মুজিব-কন্যার।
শেখ মুজিবুর ও বেগম ফজিলাতুন্নেসার পাঁচ সন্তান। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় শেখ হাসিনা, তার পরেই শেখ রেহানা। সব সময়েই দিদির সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি সফরে গিয়েছেন রেহানা। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদেও ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনার নিত্যসঙ্গী তো বটেই, ২০০৭-০৮ সালে দেশে যখন জরুরি অবস্থা জারি হয়, হাসিনাকে কারাবন্দি করা হয়, তখন হাসিনার হয়ে দলীয় সভাও করেছিলেন রেহানা। সেই শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন, তখনও তাঁর সঙ্গী হয়ে রইলেন সেই রেহানাই।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ইস্যুতে কোন পথে এগোবে ভারত? হাসিনাকে নিয়ে যা জানালেন জয়শঙ্কর
সোমবার দুপুরে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে রইলেন তাঁর সেই চিরন্তন সঙ্গী শেখ রেহানা। সেটা যেন ছিল রেহানার দ্বিতীয় দুর্ভাগ্যজনক উড়ান। ১৯৭৫ সালে যখন মুজিবরকে হত্যা করা হল, তখন দুই বোন জার্মানিতে। সেসময় জার্মানিতে ছিলেন হাসিনার স্বামী পদার্থবিদ এমএ ওয়াজেদ মিয়া। ওখানেই কাজ করতেন তিনি। যখন তাঁরা জার্মানির উদ্দেশে রওনা হলেন, বিমানবন্দরে তাঁদের বিদায় জানাতে এসেছিল গোটা পরিবার। তখনও কি হাসিনা-রেহানা জানতেন, বাবা মা, ভাইদের সঙ্গে আর কক্ষনও দেখা হবে না। তার পাঁচ দশক পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল শেখ হাসিনার সঙ্গেও। তবে মুজিবের মতো করুণ পরিণতি হয়নি হাসিনার। তিনি দেশ থেকে প্রাণ হাতে করে পালাতে পেরেছেন অন্তত। হাসিনার ছেলে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ছেড়ে আসার ইচ্ছা ছিল না তাঁর। একপ্রকার জোর করেই তাঁকে সরিয়ে আনা হয় হাসিনাকে। নাহলে হয়তো তাঁদের পরিণতিও হত বাবা-মা-ভাইদের মতোই।
১৯৭৫ সালে মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, তাঁদের তিন ছেলে ও দুই পুত্রবধূকে ধানমান্ডির বাড়িতে হত্যা করা হয়। গণঅভ্যুত্থানের নামে মুজিব-সহ মোট ৩৬ জনকে হত্যা করেছিল সেনাবাহিনী। সে সময়ও হাসিনা তাঁর স্বামী-সন্তান ও বোন রেহানাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। এবারও কপ্টার নিয়ে ভারতে উড়ে এসেছিলেন হাসিনারা। গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানবন্দরে এসে ভেড়ে তাঁদের কপ্টার। সেখান থেকে লন্ডন উড়ে যাওয়ার কথা ছিল হাসিনার। সেখানেই থাকেন হাসিনাপুত্র। তবে শেষ মুহূর্তে ব্রিটেন হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। দীর্ঘদিনের বন্ধু হাসিনাকে ফেরায়নি ভারত। দেশের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, নয়াদিল্লিতেই রয়েছেন হাসিনা। তবে তিনি মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। ফলে পরবর্তী পদক্ষেপ এখনই ভেবে উঠতে পারছেন না তিনি। তাঁকে সময় দেওয়ার পক্ষেই রয়েছে ভারত সরকার।
১৯৭৫ সালে মুজিবকে যখন হত্যা করা হল, তখনও বিয়ে হয়নি রেহানার। তার কয়েক বছর পর বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ শফিক আহমেদ সিদ্দিকীকে বিয়ে করেন রেহানা। লন্ডনেই বসেছিল সেই বিয়ের আসর। যেখানে অর্থাভাবে যোগ দিতে পারেননি শেখ হাসিনা। জীবন বদলেছে, সময়ও। তবে দিদির হাত ছাড়েননি রেহানা। তিন সন্তানের মা রেহানা। তাঁদের মধ্যে একজন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক স্ট্র্যাটেজি কনসাল্টেন্ট। শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের রিসার্চ শাখার ট্রাস্টিও তিনি। রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকি ব্রিটেনের লেবার পার্টির রাজনীতিবিদ এবং কেয়ার স্টারমার ডিসপেনসেশনে ট্রেজারি এবং সিটি মিনিস্টারের অর্থনৈতিক সচিবও বটে।
আরও পড়ুন: বারবার জেগেছে বাংলাদেশ! অবাক করবে সে দেশের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস
মুজিবকে যখন খুন করা হল, কাকতালীয় ভাবে হাসিনা-রেহানা তখন জার্মানিতে। নাহলে হয়তো পরিবারের বাকিদের মতোই পরিণতি হত তাঁদেরও। আর এবার যখন প্রাণ হাতে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন তাঁরা, তখন দরজায় দাঁড়িয়ে উন্মত্ত বিক্ষোভকারীরা। বুঝতে পারছিলেন, ক্রমশ সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন হাসিনা। কিছুতেই নিজের দেশ ছাড়বেন না তিনি। তাঁর উপদেষ্টারা বারবার তাঁকে বোঝান, যাতে প্রাণের ঝুঁকি তিনি না নেন। কিন্তু তা মানেননি হাসিনা। শেষমেশ রেহানা এসে বোঝান দিদিকে। তবে তাতেও কাজ হয়নি। শেষপর্যন্ত ছেলে সজীব ওয়াজেদের ফোন পেয়ে সিদ্ধান্ত বদলান হাসিনা। যখন দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে কপ্টারে উঠছেন তাঁরা, বিক্ষোভকারীরা তখন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মুজিবুরের মূর্তি। এক গনঅভ্যুত্থান কেড়েছিল পরিবার, দ্বিতীয় গণবিক্ষোভ কেড়ে নিল দেশ, জন্মভূমি। মুজিবের রক্তে ভেজা মাটিতে আর কি কখনও ফেরা হবে দুই কন্যার, তার উত্তর জানেন না এখনও কেউ-ই।