অক্সফোর্ডে ধুন্ধুমার! বিক্ষোভকারীদের টানা প্রশ্ন, কী উত্তর ফেরালেন মমতা?

Mamata Banerjee Oxford: বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে মমতা বলেন, “আমি আপনাদের মিষ্টি দেব, আমি আপনাদের চকলেট দেব।"

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাঁকে। বিশ্ববিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলগ কলেজের কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে বক্তব্য পেশ করছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তবে, বিশ্বের এই প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও যে সিঙ্গুর থেকে অভয়াকাণ্ড তাঁর পিছু ছাড়বে না, এমন অশনি সংকেত আঁচ করেছিলেন আগেই। ভাষণ দিতে দিতে যদি কেউ বা কারা আরজি কর প্রসঙ্গ তুলে ফেলেন, সেই আন্দাজ করে আনন্দবাজার পত্রিকাকে মমতা বলেওছিলেন, ‘‘ওরা বল করলে আমিও ব্যাটিং শুরু করব! ছক্কা মারব। ওরা কি ভেবেছে আমি তৈরি হয়ে আসিনি? নথি আমার কাছেও আছে। আমিও জবাব দিতে জানি।’’ আশঙ্কা যে ভুল ছিল না, তা প্রমাণও হয়ে গেল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে 'অপছন্দের' ইস্যুর মুখে পড়ে অস্বস্তিতে পড়ল তাঁর লন্ডন সফর।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজের প্রেসিডেন্ট তথা অধ্যাপক জোনাথন মিচি। তিনিই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর। জানা গেছে, এই আমন্ত্রিত বক্তব্যের কিছু দিন আগেই জোনাথন একটি লম্বা চিঠি পান যাতে লেখা ছিল কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানানো উচিত নয়। চিঠিটি আসে ইংল্যান্ডের আরজি করের প্রাক্তনীদের সংগঠনের তরফে। পরে অবশ্য যেমন সংগঠনের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। তবে বিপত্তি সামাল দেওয়া যায়নি। অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজে ‘সামাজিক উন্নয়ন: বালিকা, শিশু এবং মহিলা ক্ষমতায়ণ’ বিষয়ে বক্তৃতা চলাকালীন শুরু হয়ে যায় প্রতিবাদ। একের পর এক পোস্টারে ছেয়ে যায় সভাকক্ষ। বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে মমতা বলেন, “আমি আপনাদের মিষ্টি দেব, আমি আপনাদের চকলেট দেব।"

কী নিয়ে বিক্ষোভ? প্রথম ধাক্কাটি আসে রাজ্যে বিনিয়োগ প্রসঙ্গেই। বাংলায় কর্মসংস্থান প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার সময় হঠাৎই দর্শকাসন থেকে টাটা গোষ্ঠীকে নিয়ে প্রশ্ন ধেয়ে আসে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের জেরে টাটা গোষ্ঠীর ন্যানো প্রকল্প তুলে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে আবারও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, "গত কয়েক বছরে বেকারত্বের হার ৪৬ শতাংশ কমেছে।" বলেন, বহু শিল্প বাংলায় আসছে। বাংলায় ২৩ লক্ষ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব আসছে। এই সময়ই দর্শকাসন প্রশ্ন আসে টাটাকে নিয়ে, প্রশ্ন আসে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ নিয়েও। দর্শকাসন থেকে একজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি মিথ্যা বলছেন।’’

 

শিল্পের প্রসঙ্গ ধরেই আসে আরজি কর প্রসঙ্গ। অভয়ার নাম ওঠে। 'মিথ্যেবাদী' বলা হয় মুখ্যমন্ত্রীকে, অভয়াকে 'খুনের' জন্য দায়ী করা হয়। একের পর এক প্রশ্নের মুখে মমতা বলেন, "এটা গণতন্ত্র। সকলের প্রশ্ন করার অধিকার আছে। আপনাদের বিরোধিতায় আমি উৎসাহ পাই।" বিক্ষোভকারীদের স্লোগান এবং পোস্টারে যখন বক্তব্য সভা উত্তাল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও বলে যান, ‘‘আমি আপনাদের সকলকে খুব ভালবাসি। আপনারা আপনাদের পার্টিকে আরও মজবুত করুন। যাতে আমার সঙ্গে তারা লড়তে পারে!’’ বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘আমাকে অপমান করছেন করুন। দেশকে অপমান করবেন না।’’

আরজি কর প্রসঙ্গ উঠলে মমতা বলে ফেলেন, "আই লাভ ইউ অল। প্লিজ় শান্ত হন। আমি আপনাদের মিষ্টি দেব।’’ এরপরেই নিজের চেনা পিচে ব্যাটিং শুরু করেন মমতা। বলেন, ‘‘আমার বাম, অতিবাম, সাম্প্রদায়িক শক্তির বন্ধুদের বলব, আপনাদের আমি চকোলেট দেব। আপনাদের মতাদর্শকেও চকোলেট খাওয়াব।’’ অক্সফোর্ডে গিয়েও বামেদের ভূতই কেন তাড়া করল মুখ্যমন্ত্রীকে? তৃণমূলের একাংশ বলছে, টাটার নাম উচ্চারিত হতেই যেভাবে বিক্ষোভ শুরু হয়, তা পরিকল্পিত ছাড়া কিচ্ছু নয়। আর এই পরিকল্পনা বামেদেরই। একাংশ আবার বলছে, ‘ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস’ বিরোধী পোস্টার দেখা গেছে, ফলে এখানে গণ্ডগোলের নেপথ্যে বিজেপির হাতও থাকতে পারে। 'যাদবপুর' নামটি ওঠায় আবার অনেকে বলছেন, অতিবাম সদস্যরাই এই বিক্ষোভের মূলে। তাহলে বাম না বিজেপি নাকি অতিবাম? আসলে কারা অক্সফোর্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিক্ত প্রশ্নের মুখে ফেলল? সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের ব্রিটেন শাখা জানিয়েছে, তাদের সংগঠনের সদস্যরা বিক্ষোভে ছিলেন। নাম উঠে আসছে, সুচিন্তন দাসের।

কে সুচিন্তন দাস? রবীন্দ্র ভারতীর ইতিহাসের অধ্যাপক সুস্নাত দাসের পুত্র তিনি। তাঁর বাবা সুস্নাত দাস রাজ্যপাল নিযুক্ত অধ্যাপকের আমলেই ডিন হয়েছেন বলে জানা গেছে। তৃণমূলের একাংশের মত, এই সুচিন্তনই সামগ্রিক জমায়েত ও বিক্ষোভের পরিকল্পনা করেছিল। অক্সফোর্ডে এমন অপ্রীতিকর প্রশ্নের মুখে পড়েও আপাত সামাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন ঠিকই। তবে, বামেদের বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পিত হোক বা স্বতস্ফূর্ত, এই বিক্ষোভ প্রমাণ করে, বাংলার দুর্নীতি থেকে শুরু করে বেকারত্ম, শিক্ষার দুর্দশা থেকে শুরু করে ধর্ষণ, এ সমস্তটাই বহুল চর্চিত। কন্যাশ্রী বা যুবশ্রীর আড়ালে উন্নয়নের যে চিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চান, সেই উন্নয়নের চাদর সরিয়ে কেউ অন্তত প্রশ্ন করছে। আরজি কর বা সিঙ্গুর, বাংলায় তা মৃত ইস্যু হয়ে গেলেও, জবাব কেউ কেউ।

More Articles