'হামাস হঠাও'! কেন প্যালেস্টাইন জুড়ে ছড়াচ্ছে হামাসবিরোধী বিক্ষোভ?

Anti Hamas Protest in Gaza: হামাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাসেম নাইম বলছেন, হঠাৎ করে এই বিক্ষোভ শুরু হওয়া, এবং তা সারা বিশ্বে প্রচার হওয়া আসলে 'সন্দেহজনক রাজনৈতিক এজেন্ডা'।

গাজাকে স্বাধীন করতে চায় বলে দাবি হামাসের। প্রায় দেড় বছর ধরে হামাসের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে গাজাকেই কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে ইজরায়েল। এত মৃত্যু, এত লাশ, এত হাহাকার পার করে এবার শত শত ফিলিস্তিনি মানুষ উত্তর গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদে নেমেছেন। তাঁদের সমবেত দাবি "হামাস হাটাও"! গাজার জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসের বিরোধিতায় এমন বিরল প্রকাশ্য ক্ষোভ প্রদর্শন স্বাভাবিকভাবেই গাজার মুক্তি আর ইজরায়েলের আগ্রাসনের সমীকরণে এক নতুন বাঁক যোগ করেছে। উল্লেখ্য, উত্তর গাজা হচ্ছে গাজার সবচেয়ে বিধ্বস্ত এলাকাগুলোর একটি। ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকার বেশিরভাগ বাড়িই গুঁড়িয়ে গিয়েছে। মানুষজন প্রাণে বাঁচতে পালিয়েছেন, যারা পারেননি, শেষ হয়ে গিয়েছেন।

সম্প্রতি X-এ একাধিক পোস্টে দেখা গেছে, ২৫ মার্চ গাজার বেইট লাহিয়া অঞ্চল থেকে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর মধ্যে থেকে ধুলোময় রাস্তায় নেমে আসছেন সাধারণ মানুষ, তারা স্লোগান দিচ্ছেন "আউট, আউট, আউট, হামাস গেট আউট"। যুদ্ধের বিরুদ্ধে এমন স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ তাও এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে, সাম্প্রতিককালে গাজা প্রত্যক্ষ করেনি। অনেকেই বলেছেন, দেড় বছরে সব হারিয়ে এবার তারা ক্লান্ত, তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, হারানোরও কিছু বাকি নেই। হয় মৃত্যু বা শেষ প্রতিরোধ। বিক্ষোভের মধ্যে সকলে না হলেও অনেকেই হামাসের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ এখন হামাসবিহীন গাজায় নিরাপদে বাঁচতে চাইছে।

২৫ মার্চ থেকে এই বিক্ষোভের পোস্টগুলি ব্যাপকভাবে প্রচারে আসতে শুরু করে। রয়টার্স ওই অঞ্চলের রাস্তা, নানা খুঁটি এবং বাড়ির অবস্থান দেখে ওই এলাকার স্যাটেলাইট চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে বিক্ষোভের অবস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছে। উত্তর গাজার ওই এলাকা থেকে আসা নানা ভিডিওতে দেখা গেছে জনতার হাতে ব্যানারে লেখা ছিল "অনেক যুদ্ধ হলো”, এই মানুষরাই স্লোগান দিয়েছেন, "আমরা আর যুদ্ধ চাই না"। যে হামাস গাজার স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, যে হামাসের ইজরায়েল আক্রমণের ভিত্তিতেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় এত মানুষের মৃত্যু হলো, সমস্ত গাজাটাই মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার মুখে, হঠাৎ সেই হামাসকেই কেন গাজা থেকে উৎখাত করতে চাইছেন মানুষ?

আরও পড়ুন- লড়াইটা কি সত্যিই ইজরায়েল বনাম হামাস-এর?

হামাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাসেম নাইম বলছেন, যুদ্ধের কারণে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে মানুষকে তার প্রতিবাদ করার অধিকারও জনগণের আছে। তবে তাঁর সন্দেহ, হঠাৎ করে এই বিক্ষোভ শুরু হওয়া, এবং তা সারা বিশ্বে প্রচার হওয়া আসলে 'সন্দেহজনক রাজনৈতিক এজেন্ডা'। তাঁর সন্দেহ, যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে ইজরায়েল। বাসেম নাইমের প্রশ্ন, "তারা কোথা থেকে এসেছে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে কী হচ্ছে? কেন তারা সেখানে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন না? এই আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে জনগণ রাস্তায় নামছে না কেন?”

হামাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহ হামাসকে "গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি জনগণের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার" আহ্বান জানিয়েছে। ফাতাহ অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্যালেস্টাইন অথরিটির (পিএ) নেতৃত্বে রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস দক্ষিণ ইজরায়েলে হামলা চালিয়ে ১,২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে বন্দি হিসাবে অপহরণ করার পরই প্রতিশোধ নিতে ইজরায়েল গাজায় আক্রমণ শুরু করে। গাজায় ইজরায়েলি অভিযানে এখনও অবধি ৫০,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার বেশিরভাগ অংশই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন তাঁবুতে। সেখানেও বোমা হামলা চলেছে। যুদ্ধের সময় গাজার দক্ষিণে পালিয়ে আসা কয়েক লক্ষ বাসিন্দাদের অনেকেই জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর উত্তর গাজায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িতে ফিরে এসেছেন।

গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে আক্রমণ শুরু করে ইজরায়েল। যুদ্ধবিরতিকালে হামাস ইজরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে ইজরায়েলের বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য আধিকারিকদের মতে, ইজরায়েল গাজায় আবার হামলা শুরু করার পর থেকে প্রায় ৭০০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই মহিলা এবং শিশু। যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়াটিকে আবার বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ অব্যাহত থাকলেও, গাজায় ভবিষ্যতের শাসনক্ষমতা সহ কেন্দ্রীয় নানা বিষয়েই আসলে কোনও অগ্রগতি চোখে পড়েনি।

২০০৭ সালে হামাস ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ গোষ্ঠীকে পরাজিত করে নির্বাচনে জিতে গাজায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। ২০০৭ থেকেই গাজার শাসন হামাসের হাতে আর এখানে বিরোধীদের তেমন স্থানই নেই। হামাস এবং ফাতাহ-র মধ্যে বছরের পর বছর ধরেই মতপার্থক্যই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। গাজার যুদ্ধোত্তর ভবিষ্যতের বিষয়ে মতপার্থক্য দূর করতেও ব্যর্থ হয়েছে দুই গোষ্ঠী। হামাস স্পষ্ট জানিয়েছে, আগামীতে যে প্রশাসনই আসুক না কেন তা নির্বাচনের মাধ্যমেই আসবে।

আরও পড়ুন- দুর্নীতি ঢাকতেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার গাজায় আক্রমণ নেতানিয়াহুর?

এতকাল পরে হামাসের বিরুদ্ধে ভিন্নমতের প্রকাশ্য জমায়েত দেখা যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ বিক্ষোভই ছোট আকারের। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আঁচ ক্রমেই ছড়াচ্ছে। গত বুধবার গাজা শহরে, উত্তর এবং মধ্য গাজার অন্তত দু'টি স্থানে - নুসিরাত এবং দেইর আল-বালাহ-তে ছোট ছোট বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেইর আল-বালাহ-তে প্রায় ৩০০ জন বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, “আমাদের দাবিগুলো পরিষ্কার: যেকোনও মূল্যে যুদ্ধ বন্ধ করুন। ‘আমরা বাঁচতে চাই’ এটাই আমাদের স্লোগান। আমাদের আর হারানোর কিছুই নেই। আমরা ইতিমধ্যেই সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি, তাই আমরা আর ভয় পাই না।"

দক্ষিণ গাজার বিশিষ্ট ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী এবং হামাস বিরোধী নেতারাও হামাসের বিরোধিতা করে একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে ফিলিস্তিনিদেরকে "অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করার" এবং হামাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "হামাসকে অবিলম্বে গাজা থেকে হাত তুলে নিতে হবে। যে সিদ্ধান্ত আমাদের নয়ই, যে সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে আমরা ভুক্তভোগী, সেই অন্যায়ের অবসান ঘটাতে হবে। আমরা আপনাদের সকলকে রাস্তায় নামার এবং আওয়াজ তোলার আহ্বান জানাই। গাজা কারও কাছে বন্দি নয়। গাজা তার জনগণের ইচ্ছায় মুক্ত হবে।"

গাজায় ফাতাহ-র মুখপাত্র মুনথার আল-হায়েক, হামাসকে গাজায় সরকার থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বুধবার ফিলিস্তিনি রেডিওর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, হামাসের উচিত ফাতাহ-অধ্যুষিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। বলেছেন, হামাসের উপস্থিতিই ফিলিস্তিনিদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ইজরায়েলের শাসক নেতানিয়াহুও এই বিষয়ে বলেছেন, "সাম্প্রতিককালে আমরা এমন একটি নতুন পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছি - যা আমরা আগে কখনও দেখিনি। আমরা গাজা উপত্যকায় হামাসের শাসনের বিরুদ্ধে বড়, প্রকাশ্য বিক্ষোভ দেখেছি।"

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের ক্লান্তি, রাগ, প্রতিবাদ স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভঙ্গুর, নিঃস্ব মানুষদের ভয় ও বাঁচার মরিয়া ইচ্ছেকে ব্যবহার করে আখেরে ফাতাহ-র মাধ্যমে ইজরায়েল গাজা দখলই করতে চাইছে না তো? এই আন্দোলনগুলিকে ব্যবহার করে, হামাসকে সরিয়ে ফেলা যায় ঠিকই, তবে তাতে গাজা প্রকৃত স্বাধীন হবে তো?

More Articles