কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন দেবী, আজও জঙ্গলিকালীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে নশীপুর
Kali Puja 2023: যে দেবী কিনা বরাভয়দাত্রী, সেই মা কালীকেই কিনা আক্রমণ করে বসে তাঁরা সদলবদে। ডাকাতদের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে দেবী গিয়ে ঝাঁপ দেন পাশের একটি কুয়োতে।
রামের বনবাসকালে দাদা শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকাখানা সিংহাসনে রেখে রাজত্ব সামলেছিলেন দশরথপুত্র ভরত। এই দেবথানও যেন ঠিক তেমনই। এ মন্দিরে দেবী নেই, দেবীর বিগ্রহও নেই। কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন, ঈশ্বর রয়েছেন সবখানে। তা যে তাঁরা মিথ্যা বলেন না, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ মুর্শিদাবাদের নশীপুর। নশীপুরের এই জঙ্গলি কালীর মন্দিরে ভক্তের অভাব হয়নি কোনওদিন। দেবীর রেখে যাওয়া পদচিহ্নটুকুকেই দেবীভাবে পুজো করে চলেছেন মুর্শিদাবাদের নশীপুর এলাকার মানুষ। আজ থেকে নয়, ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুর্শিদাবাদের ওই নশীপুরে রয়েছে ডাকাতে কালী বা জঙ্গলি কালীর মন্দির। প্রতিবছর কালীপুজো উপলক্ষে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন পুজো চাক্ষুষ করতে।
মূর্তি নেই তো কী। স্থানীয় মানুষ মনে করেন, ওই পায়ের ছাপটুকু জুড়েই দেবীর অধিষ্ঠান। পুজোয় দেবী কালিকা তুষ্ট হলে কখনও না কখনও হয় তো মন্দিরে ফিরে আসবেন তিনি ফের। প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই দেবী কালিকার পায়ের ছাপকে পুজো করে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এতগুলো বছরের ইতিহাস। স্বাভাবিক ভাবেই জঙ্গলি কালীর ওই থানকে ঘিরে আষ্টেপৃষ্ঠে উঠেছে নানা লৌকিক গল্প, উপখ্যান। আর সেই উপখ্যান অনুযায়ী, বরাবর এমন দেবীশূন্য ছিল না নশীপুরের ওই মন্দিরতলা। জানা যায়, এক সময় নশিপুরের ওই এলাকা ছিল জঙ্গসে পরিপূর্ণ। আর সেই জঙ্গলেই ছিল কুখ্যাত সব ডাকাতদের ডেরা। যাদের ভয়ে কাঁপত গোটা এলাকা। তা সেই ডাকাতদল নাকি ডাকাতিতে বেরনোর আগে শরণ নিতেন সেই জঙ্গলি কালীর।
আরও পড়ুন: কুখ্যাত মিহির সর্দারের ডেরা থেকে ‘দুর্গেশনন্দিনী’র মন্দির, কেন এত জাগ্রত হুগলির সিদ্ধেশ্বরী কালী?
কথিত আছে, তেমনই একদিন মায়ের পুজো শেষে ডাকাতির উদ্দেশে রওনা দেয় ডাকাতদল। তবে সেদিন তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। ফলে সেদিনটা ফাঁকা হাতেই ফিরতে হয়েছিল ডাকাত দলকে। সারাদিনের ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ডাকাতদলের কিছু না-পাওয়ার রাগ গিয়ে পড়েছিল দেবী কালীর উপরে। যে দেবী কিনা বরাভয়দাত্রী, সেই মা কালীকেই কিনা আক্রমণ করে বসে তাঁরা সদলবদে। ডাকাতদের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে দেবী গিয়ে ঝাঁপ দেন পাশের একটি কুয়োতে। সেই কুয়োর পাড়ে পড়ে থাকে দেবীর ছাপ। মন্দির থেকে অন্তর্হিত হয় দেবীর বিগ্রহ। বেদি জুড়ে থেকে যায় তাঁর পদযুগলের ছাপটুকু। মন্দিরের বেদি ও কুয়োর পাশে, সেই দু'জায়গার ছাপকেই বড় মানে নশীপুরের মানুষ।
পাঁচশো বছর ধরে সেই পদযুগলকেই পুজো করে আসছেন স্থানীয় মানুষ। কালীপুজোর সময় ভিড় বাড়ে। অন্যান্য জেলা থেকেও আসেন ভক্তেরা। দেবীর থানের পাশেই রয়েছে বহুপ্রাচীন একটি নিমগাছ। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, ওই গাছটিতে দেবীর সহচরীরা থাকেন। কেউ কেউ বলেন, মাঝেমধ্যেই সেই গাছ থেকে বিভিন্ন রকম আওয়াজ ভেসে ওঠে। পরবর্তীকালে মন্দিরটি সংস্কার হলেও গাছটি কাটা হয়নি। কালীপুজোর দিন যত্ন করে সাজিয়ে তোলা হয় ওই নিমগাছের চারপাশও।
আরও পড়ুন: খোদ কালীঘাটে কালীপুজোয় পুজো পান না দেবী কালিকা! কেন এই রীতি জানেন?
এ রাজ্যে ডাকাতকালীর মন্দির কম নেই। তবু বিগ্রহহীন মুর্শিদাবাদের এই মন্দির যে ভাবে পাঁচশো বছরের বেশি সময় ধরে কথকথা বয়ে নিয়ে চলেছে, তার খোঁজেই বোধহয় প্রতিবছর কালীপুজোর সময় ভক্তদের ভিড়ে তিল ধারনের জায়গা থাকে না মন্দির চত্বরে।