সিরিয়ায় চরমপন্থীদের উত্থান! কোন বিপদের মুখে ভারত?

Syria-India Relation: গৃহযুদ্ধের চরম পর্যায়ে যখন বেশ কয়েকটি দেশ দামাস্কাসের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আরব লীগ থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কৃত করে তখনও ভারত কিন্তু সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।

১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে থেমেছিলেন। ভারত ও সিরিয়া সাত বছর আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সেই বন্ধুত্বকে চিহ্নিত করার জন্য দামাস্কাসের ঐতিহাসিক উমাইয়াদ স্কোয়ারের একটি রাস্তার নাম রাখা হয় 'জওহরলাল নেহেরু স্ট্রিট'। বেশ কয়েক দশক ধরেই ভারত ও সিরিয়ার এই সম্পর্কটি বহু রাজনৈতিক ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে। তবে, বাশার আল-আসাদের শাসনের পতনের পর ভারত-সিরিয়া সম্পর্কের নতুন সমীকরণ কেমন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারের পতন হয়েছে, দাবি করেছে সেখানকার বিদ্রোহী বাহিনী। সিরিয়ার সরকার পতনের প্রভাব সরাসরি পড়বে কি ভারতের উপর? এমনিতেই চিন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে বেশ দোলাচলে রয়েছে ভারতবর্ষ। এরই মধ্যে মধ্য-প্রাচ্যের দেশে ক্ষমতার পরিবর্তনে কি ভারত বিপদে পড়বে?

বাশার আল-আসাদের পতনের ফলে সিরিয়ায় চরমপন্থী গোষ্ঠীর পুনরুত্থান নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। আইএসআইএস যখন ক্ষমতার শীর্ষে, ঠিক সেই সময় রাশিয়া এবং ইরানের সমর্থনে শক্তিশালী সিরিয়া সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর প্রভাবকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। সিরিয়ার নেতৃত্বে এই শূন্যতা মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলির প্রভাব বাড়াবে বলেই আশঙ্কা।

কূটনীতির বাইরেও, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় ভারত-সিরিয়া সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী সিরিয়া সফর করেন এবং জৈবপ্রযুক্তি, ক্ষুদ্র শিল্প এবং শিক্ষা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। ভারত দামাস্কাসকে একটি বায়োটেকনোলজি সেন্টারের জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলার ধার এবং ১ মিলিয়ন ডলার অনুদানও দিয়েছে।

২০০৮ সালে বাশার আল-আসাদ ভারত সফরে আসেন। সিরিয়ার ফসফেট সম্পদ বিষয়ে কৃষি সহযোগিতা এবং গবেষণার পরিকল্পনা জানান। ভারত সিরিয়ায় একটি আইটি সেন্টার অফ এক্সিলেন্স প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয়। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যও বেড়েছে। সিরিয়ায় ভারত টেক্সটাইল, যন্ত্রপাতি এবং ফার্মাসিউটিক্যালস রফতানি করে। আমদানি করে রক ফসফেট এবং তুলার মতো কাঁচামাল।

ভারতের বিদেশ মন্ত্রক বলছে, “আমরা সিরিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা সিরিয়ার ঐক্য, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে সব পক্ষের কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছি। আমরা সিরিয়ার সমাজের সকল শ্রেণির স্বার্থ ও আকাঙ্খাকে সম্মান করে একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পক্ষে। দামাস্কাসে আমাদের দূতাবাস ভারতীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য।”

আসাদ সরকারের অধীনে সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল দুই দেশেরই। তবে আসাদ সরকারের পতনের ফলে দুই দেশের মধ্যে এই কূটনৈতিক সম্পর্ক কোনদিকে বাঁক নেবে তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন- পাঁচ দশকের শাসনের অবসান! কীভাবে সিরিয়ায় পতন হলো আসাদ সরকারের?

ভারত ও সিরিয়ার সম্পর্কের ইতিহাস

আসাদ ২০০০ সাল থেকে সিরিয়া শাসন করছেন। তাঁর বাবা হাফেজ আল-আসাদ ১৯৭১ সাল থেকে এই দেশে ক্ষমতায় ছিলেন। ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধের সময়, সংঘাত সমাধানের পক্ষে অবস্থান করে ভারত। সেই সময় ভারত একটি অ-সামরিক এবং সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পক্ষেই সওয়াল করেছিল। গৃহযুদ্ধের চরম পর্যায়ে যখন বেশ কয়েকটি দেশ দামাস্কাসের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আরব লীগ থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কৃত করে তখনও ভারত কিন্তু সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।

ভারত সিরিয়াকে মূল কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে সাহায্য করেছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সিরিয়াকে ২৪০ মিলিয়ন ডলার ধার দিয়েছে ভারত, পাশাপাশি আইটি পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ, স্টিল প্ল্যান্টের আধুনিকীকরণ, তেল, চাল, ওষুধ ও বস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রেও সিরিয়াকে ব্যাপক সাহায্য করেছে ভারত। মানবিক কারণ দেখিয়ে ভারত কোভিড -১৯ মহামারীর সময় সিরিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করতেও অস্বীকার করেছিল। নয়াদিল্লিও অন্য দেশগুলিকে এতে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানিয়েছিল।

নরেন্দ্র মোদি সরকারের অধীনে, ২০২৩ সালে সিরিয়া আবারও আরব লীগে যুক্ত হয়। ভারত সিরিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটিও নতুন গতি পায়। তৎকালীন বিদেশ প্রতিমন্ত্রী ভি মুরলিধরন ২০২৩ সালের জুলাই মাসে দামাস্কাস সফরেও যান।

সিরিয়া কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে সমর্থন করেছিল

প্যালেস্তাইন এবং গোলান হাইটস নিয়ে সিরিয়ার দাবি সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ভারত সিরিয়াকে সমর্থন করেছিল। অন্যদিকে কাশ্মীর নিয়ে নয়াদিল্লির অবস্থানকেও সমর্থন করেছিল দামাস্কাস। বলেছিল, "এটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা"।

২০১৬ সালে ভারতে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত রিয়াদ আব্বাস বলেছিলেন, কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। দ্য হিন্দু লিখেছিল, আব্বাস বলেছেন "সরকারের বিরুদ্ধে যে-ই অস্ত্র তুলবে, আমরা তাদের সন্ত্রাসবাদীই বলব এবং সরকারকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।” তিনি আরও বলেছিলেন যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া নতুন ভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে ভারতের সাহায্যের প্রত্যাশী।

আরও পড়ুন- ভয়াবহ হামলায় নিহত অন্তত ১৬, গাজার পর কেন ইজরায়েলের নিশানায় এবার সিরিয়া?

এই মুহূর্তে কেন ভারতকে সতর্ক হতে হবে?

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিরিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে এই দেশের সম্পর্ককে আরও পোক্ত করতে সাহায্য করবে। কিন্তু সিরিয়ার এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী, অর্থাৎ তুরস্ক সমর্থিত হায়াত তাহরির আল-শাম যারা সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছে বলে দাবি করছে, এই গোষ্ঠীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে ভারতকে।

সম্প্রতি, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যুর উল্লেখ করেননি। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, হয়তো ভারত-তুরস্ক সম্পর্কের উন্নতির লক্ষণ হতে পারে এই বিষয়টি।

তবে এই মুহূর্তে ভারতীয়দের সিরিয়ায় যেতে নিষেধ করে একটি পরামর্শ জারি করেছে ভারত। সিরিয়ায় যে ভারতীয়রা ইতিমধ্যেই আছেন, তাঁদের 'সর্বোচ্চ সতর্কতা' মেনে চলার এবং যেখানে সেখানে যা যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ভারত৷ বিদেশমন্ত্রক বলছে, "সিরিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি জারি না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় নাগরিকদের সিরিয়ায় সমস্ত সফর এড়িয়ে চলার পরামর্শই দেওয়া হয়েছে৷ যাদের পক্ষে সম্ভব, দ্রুততম বিমান ধরে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে এবং অন্যদের নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে এবং যাতায়াত কমাতে অনুরোধ করা হচ্ছে।"

ইসলামিক স্টেট ফিরছে?

সিরিয়ায় এইচটিএস-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির উত্থানের শিকড় লুকিয়ে আছে আল-কায়দায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে এদের। যদিও এইচটিএস নেতা আবু মহম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এবং তাঁর দলটির লক্ষ্যই ছিল আসাদ সরকারকে উৎখাত করা। পশ্চিমের দেশগুলিতে আক্রমণ শুরু না করাই তাঁদের লক্ষ্য। তবে এই ভরসায় আস্থা রাখতে পারছে না পশ্চিমের দেশগুলি, ভারতও। তাই সতর্ক থাকতেই হচ্ছে।

তুরস্ক সমর্থিত এইচটিএস মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর উত্তর সিরিয়ার অঞ্চলগুলি দাবি করেছিল। এইচটিএস আসলে ইসলামিক স্টেট অফ ইরাকের একটি শাখা হিসাবেই যাত্রা শুরু করেছিল। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে জাভাত আল-নুসরাহ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই গোষ্ঠী। আবু বকর আল-বাগদাদি ২০১৩ সালের এপ্রিলে ইরাক থেকে সিরিয়ায় এই সংগঠনটিকে নিয়ে আসেন। জোলানি বাগদাদিকে প্রত্যাখ্যান করে আল-কায়দার তৎকালীন নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেন। পরে, জোলানি আল-কায়দা ত্যাগ করেন এবং এইচটিএসের সম্প্রসারণের দিকে মন দেন।

সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা ছিল, এই পদক্ষেপের ফলে ইসলামিক স্টেটের উত্থানের সুযোগ ঘটবে আবার। সম্প্রতি, আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর মার্কিন সেনাবাহিনী ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বিমান হামলা চালায়। পেন্টাগন বলছে, নির্ভুল বিমান হামলা ছিল এবং এতে কোনও নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে বা আহত হয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করে না।

More Articles