ভিডিওতে ভাইরাল! অস্ত্র হাতে সত্যিই বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান? জানুন আসল সত্য
Bangladesh Video Fact Check: সোশ্যাল মিডিয়াতে ইতিমধ্যেই ভিডিওটি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে যে, যশোরে জঙ্গিদের উত্থান হয়েছে। সেখানে জিহাদের ডাক দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিতাড়িত লেখিকা তসলিমা নাসরিন একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু অত্যাচারের ঘটনা, বাংলাদেশে আবারও ইসলাম মৌলবাদের মাথাচাড়া দেওয়ার যে যে ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসছে, ভিডিওটি তেমনই খানিক। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভুয়ো খবরে ভরে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপ। ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমজুড়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে 'উস্কানিমূলক' খণ্ড সত্য, বিকৃত তথ্য পরিবেশনের অভিযোগ উঠছে। এরই মাঝে তসলিমার এই পোস্ট। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ খোদ এই পোস্টটি 'ফ্যাক্ট-চেক' করে ভুয়ো বলে প্রমাণ করেছে। ভিডিওটি যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার। কী বলা হয়েছে তাতে, কেনই বা ভুয়ো প্রমাণিত হলো সেটি?
যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, মুখ ঢাকা একজন আরবি ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন। এই বক্তার পাশে দু'জন কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে আছেন। তারা সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীদের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। মঞ্চের আশপাশে বেশ কয়েকজন বসে আছেন, যারা এই বক্তব্য শুনছেন।
যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও শিক্ষা সচিব জানিয়েছেন, ভিডিওটি আসলে একটি প্রতিযোগিতার! মাদ্রাসার বার্ষিক আঞ্জুমানের (প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান) সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পড়ুয়ারা প্যালেস্তাইনের মুক্তিকামী মানুষের লড়াইয়ের বিষয়টিই অভিনয় করিয়ে দেখিয়েছে।
সেদেশের সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন জানিয়েছে, যশোর শহরতলির রাজারহাট বিহারি কলোনি এলাকায় ২০১২ সালে এই যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদ্রাসায় প্রায় ৫০০ পড়ুয়া পড়াশোনা করেন। এখান থেকে মূলত হাফেজ, মাওলানা ও মুফতি ডিগ্রি দেওয়া হয়।
বাংলা ট্রিবিউন অনুযায়ী, মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মাকফুর রহমান বলছেন, "এই মাদ্রাসায় প্রতি বছর পড়ুয়াদের নিয়ে বার্ষিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে যারা উপস্থিত বক্তৃতা, হামদ-নাত, গজল ও অভিনয়ে ভালো করে তাদের পুরস্কৃত করা হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর এই মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছাত্ররা ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে অভিনয় করে দেখান।" তাহলে হাতে যে অস্ত্র দেখা গেছে ভিডিওতে? যা নিয়ে এত শোরগোল? মাকফুর রহমান জানিয়েছেন, অস্ত্রগুলি কাঠ ও শোলা দিয়ে তৈরি। পুরো বিষয়টিই আসলে অভিনয়।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকী জানিয়েছেন, গত ১৬ ডিসেম্বর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণেই আজীবন সদস্যদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই মঞ্চেই বার্ষিক আঞ্জুমানের আয়োজনও করা হয়। সেখানেই এই অভিনয়টি মঞ্চস্থ হয়। বিষয়টি কোনও খারাপ উদ্দেশে নিয়ে করা হয়নি বলেই তাঁর দাবি।
তবে ইসলামিক চিন্তাবিদদের কেউ কেউ বলছেন, অনুষ্ঠানের ওই ভিডিওতে কোরআনের দু'টি আয়াত বলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কতল আরেকটি জিহাদ সংক্রান্ত। অনেকেই বলছেন, সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীদের মতো দাঁড়িয়ে এভাবে মাদ্রাসার অনুষ্ঠান করা ঠিক হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে মাদ্রাসা এবং আলেমদের সম্পর্কে তাতে নেতিবাচক ধারণাই আরও ছড়িয়ে পড়বে বলে মত তাঁদের।
সোশ্যাল মিডিয়াতে ইতিমধ্যেই ভিডিওটি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে যে, যশোরে জঙ্গিদের উত্থান হয়েছে। সেখানে জিহাদের ডাক দেওয়া হয়েছে। সারা বাংলাদেশজুড়ে জঙ্গিদের উত্থান নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের একটি স্বাধীন ফ্যাক্টচেকার সংস্থা বুম বাংলাদেশও যাচাই করে দেখেছে, এই দাবি মোটেও সত্য নয়। ভিডিওটি প্রথম গত ১৭ ডিসেম্বর দুপুর ১২:৫৪ মিনিটে পোস্ট করা হয়েছিল যাতে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। পোস্টটিতে উল্লেখ করা ছিল, “যশোর জামিয়া ইসলামিয়া। বার্ষিক প্রতিযোগিতা ও পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান-২০২৪। আরবি বক্তৃতা। সবাইকে দেখার অনুরোধ রইলো।” যাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে এটি পোস্ট হয়, তিনি যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের একজন শিক্ষক।
বুম বাংলাদেশ ওই ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে সেই প্রতিযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। কালো পোশাক পরিহিত তিনজনের একজন শোয়াইব আহমেদ জানিয়েছেন, প্রতিযোগিতায় আরবি বক্তব্য বিভাগে অংশ নিয়েছিলেন তারা। প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে তাঁরা তিনজন এই ব্যতিক্রমী সাজে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। অস্ত্রগুলিও কাঠ ও শোলা দিয়ে নিজেরাই তৈরি করেছেন।
তসলিমা নাসরিনের ফেসবুক এই ভিডিওটি পোস্ট হওয়ার পর তা 'ফেক' বলে 'রিপোর্ট' হয়। এরপর আরেকটি পোস্ট লেখেন তসলিমা। তিনি লিখেছেন, "খবর হলো, যশোরের রামনগরের এক মাদ্রাসায় যেমন খুশি তেমন সাজো অনুষ্ঠানে তিন ইসলামি সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অভিনয় করেছে তিন মাদ্রাসার ছাত্র। যেহেতু বন্দুকে লেখা ছিল না খেলনা বন্দুক, যেহেতু সন্ত্রাসীদের পোশাকে লেখা ছিল না অভিনয়ের পোশাক, তাই অনেকেই বুঝতে পারেনি যে অভিনয় চলছে। আমিও বুঝতে পারিনি। নাটিকাটিতে কোরানের যে সুরা উচ্চস্বরে পড়া হয়েছে, সে সুরা জিহাদের পক্ষের সুরা। ছাত্ররা নাকি হামাসের ভূমিকায় অভিনয় করেছে। প্রশ্ন হলো, এরা কি জিহাদের বা সন্ত্রাসের পক্ষে মেসেজ দিচ্ছে, নাকি বিপক্ষে? ধামাচাপাবাজেরা বলবেন, সন্ত্রাসের বিপক্ষে। সন্ত্রাসের বিপক্ষে কি না, তা ফ্যাক্টচেক করায় পারদর্শিরা একবার চেক করুন তো! মাদ্রাসার শত শত ছাত্র কী শিখলো, জিহাদে যেতে হবে, নাকি জিহাদকে বর্জন করতে হবে, ফ্যাক্টচেক করে জানান। দ্রুত।"