পাঁচ দশকের শাসনের অবসান! কীভাবে সিরিয়ায় পতন হলো আসাদ সরকারের?
Syria Al-Assad Govt: আসাদ এবং তাঁর পিতা হাফিজ আল-আসাদের শাসনকালে মানবধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। এখন রাজধানী দামাস্কাস সহ একাধিক শহর চলে গিয়েছে বিদ্রোহীদের দখলে।
রবিবার সকালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারের পতন হয়েছে। দেশ ছেড়েছেন আসাদ। সিরিয়ায় পাঁচ দশক বাদে অবসান হয়েছে আসাদ পরিবারের শাসনের। আসাদ এবং তাঁর পিতা হাফিজ আল-আসাদের শাসনকালে মানবধিকার লঙ্ঘন নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। এখন রাজধানী দামাস্কাস সহ একাধিক শহর চলে গিয়েছে বিদ্রোহীদের দখলে। আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, দামাস্কাসে ইতালির রাষ্ট্রদূতের বাসভবনেও ঢুকে পড়েছেন একদল সশস্ত্র মানুষ। পর্যবেক্ষকদের মত, একপ্রকার বিনা বাধাতেই রাজধানী দখল হয়ে গিয়েছে। তেমন কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি সরকার। কারা সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উৎখাত করল? পতনের অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বিরোধীরা কারা?
রবিবার ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী 'হায়াত তাহরির আল-শাম' (এইচটিএস) এক বিবৃতিতে সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের কথা জানিয়েছে। বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, বাশার আল-আসাদ দেশ থেকে পালিয়েছেন। সিরিয়া এখন মুক্ত। এর মধ্যে দিয়ে দেশে অন্ধকার যুগের সমাপ্তি হলো এবং নতুন যুগের সূচনা হলো। ইসলামপন্থী সশস্ত্র দুই গোষ্ঠী 'হায়াত তাহরির আল-শাম' (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী 'জইশ আল-ইজ্জা'-র যৌথবাহিনী উৎখাত করেছে আসাদ সরকারকে। আবু মহম্মদ আল-জুলানির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল এই অভিযান। নভেম্বরের শেষদিকে বিদ্রোহীরা হঠাৎ আলেপ্পা দখল করে নেয়। তারপরই সিরিয়ায় সরকারের পতন হলো। হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিল এইচটিএস। যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক সহ একাধিক দেশে এইচটিএস সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবেই তালিকাভুক্ত।
আরও পড়ুন- হিজবুল্লাহকে চাপে রাখতেই লেবাননে স্থল আক্রমণ! ইজরায়েলে পাল্টা পরমাণু হামলার ফন্দি আঁটছে ইরান?
২০১১ সালে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়। সূচনালগ্নে সংগঠনের নাম ছিল জাবাত আল নুসরা। সেই সময় এটি আল-কায়দা জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সংগঠনটি গঠনের সময় আইএস গোষ্ঠীর নেতা আবু বকর আল বাগদাদিও ছিলেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইএস আসাদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, এই গোষ্ঠী বিপ্লবের চেয়ে জিহাদি আদর্শকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিদ্রোহীরা 'ফ্রি সিরিয়া' নামে একটি জোট করেছিল। পরে এই জোটে মতের ভিন্নতা দেখা যায়। ২০১৬ সালে এইচটিএসের নেতা আবু মহম্মদ আল-জুলানি নতুন সংগঠন তৈরি করেন এবং জাবাত আল নুসরাকে বিলুপ্ত করেন। নতুন সংগঠনের নাম হয় তাহরির আল-শাম। পরে এর সঙ্গে আরও ছোট সংগঠন যুক্ত হয়েছিল। মাঝে বেশ কিছুদিন এইচটিএস সিরিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশকে ক্ষমতার কেন্দ্র করেছিল। সংগঠনটি ওই এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনও চালু করে। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে মানবধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। অন্যদিকে বেশ কিছু সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল এইচটিএসের। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আল কায়দার সঙ্গে জোট ভাঙার পর তারা খিলাফতের চেয়ে সিরিয়ায় ইসলামি শাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২০১১ সালে দাদরা শহরে গণতন্ত্র রক্ষার বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। সিরিয়া সরকার তখন আন্দোলনকারীদের উপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছিল। আসাদ এই আন্দোলনকে 'বিদেশি সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ' বলেছিলেন। এতে আন্দোলন আরও তীব্র হয় এবং আসাদ সরকারের পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। সেই সময় থেকেই সিরিয়ায় বহু বিদ্রোহী দল তৈরি হয়। এবং দিন দিন হিংসা বাড়তে থাকে। দেশে কার্যত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আইএস ও আল-কায়দার মতো উগ্রপন্থী গোষ্ঠীরাও সিরিয়ায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
আরও পড়ুন- মৃত্যু উপত্যকা গাজা | এত লাশ রাখব কোথায়?
অনেক আন্তজার্তিক সংবাদমাধ্যম গত চার বছর ধরে লিখতে শুরু করেছিল সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষের দিকে। বলে রাখা ভালো, দেশের শুধুমাত্র বড় শহরগুলিতেই আসাদের শাসন ছিল। সংঘাতের শুরু থেকেই সিরিয়ার পূর্ব দিকের কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলি আসাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। উত্তর পশ্চিমের ইদলিব প্রদেশ এবং মরুভূমি এলাকাগুলিতে জঙ্গি সংগঠনগুলি শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। ইদলিব মূলত এইচটিএস নিয়ন্ত্রণ করত। কয়েক বছর ধরেই এই এলকা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। কারণ সরকার বাহিনীও ইদলিবকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছিল।
বিশেষজ্ঞদের মত, সিরিয়ায় ইরানের সামরিক কমান্ডোদের উপর ইসরায়েলের আক্রমণ বিদ্রোহীদের হঠাৎ আলোপ্পার দিকে যেতে উস্কেছে। আরও একটি কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননে ইজরায়েলের আক্রমণে হিজাবুল্লাহর যে পরিণতি হয়েছে তার কথাও। বলে রাখা ভালো, গত কয়েক মাসে ইসরায়েল ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে জোরদার হামলা হচ্ছিল। এতে সিরিয়ার হিজাবুল্লাহ নেটওয়ার্কও দুর্বল হয়েছে। রাশিয়া বহুদিন ধরেই আসাদ সরকারকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। অন্যদিকে, বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছে তুরস্ক। আসাদ যুদ্ধক্ষেত্রে আস্থা রেখেছিলেন রাশিয়ার বিমানশক্তি, ইরানের সামরিক সহায়তা এবং হিজাবুল্লাহর উপর। বিশেষজ্ঞদের মত, এই সমর্থন না থাকলে অনেক আগেই আসাদ সরকারের পতন হতো।