হাত বাড়িয়েছিল রাশিয়া ইরান, তবু কেন সিরিয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ল আসাদ সরকার?

Syria Bashar Al Assad Govt: ২০১১ সালে দাদরা শহরে গণতন্ত্র রক্ষার বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। প্রথম থেকেই বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছিল আমেরিকা।

রবিবার সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতন হয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে গৃহযুদ্ধ চলছিল। এখন রাজধানী দামাস্কাস সহ একাধিক শহর চলে গিয়েছে বিদ্রোহীদের দখলে। রবিবারই দেশ ছাড়েন বাশার। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, পরিবার নিয়ে তিনি মস্কোয় থাকছেন। রাশিয়া বহুদিন ধরেই আসাদ সরকারকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। অন্যদিকে, বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছে তুরস্ক। যদিও তুরস্ক বিদ্রোহীদের সমর্থন জানালেও, এইচটিএস-কে (হায়াত তাহরির আল-শাম) সমর্থনের দাবি প্রত্যাখান করেছিল। আসাদের সরকার যুদ্ধক্ষেত্রে আস্থা রেখেছিল রাশিয়ার বিমানশক্তি, ইরানের সামরিক সহায়তা এবং হিজাবুল্লাহর উপর। কেন ইরান ও রাশিয়ার সহযোগিতা পেয়েও ক্ষমতা হারালেন আসাদ?

ইসলামপন্থী সশস্ত্র দুই গোষ্ঠী 'হায়াত তাহরির আল-শাম' (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী 'জইশ আল-ইজ্জা'-র যৌথবাহিনী উৎখাত করেছে আসাদ সরকারকে। হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিল এইচটিএস। আবু মহম্মদ আল-জুলানির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল এই অভিযান। নভেম্বরের শেষ দিকে বিদ্রোহীরা প্রথমে আলেপ্পো দখল করে নেয়। এটি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এর কয়েক দিনের মধ্যেই হামা, হোমসের মতো শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিদ্রোহীরা দখলে নিয়ে নেয়। পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকেও এগিয়ে আসছিল তারা। একটা সময়ে দামাস্কাসকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে তারা। তার পরই সিরিয়ায় সরকারের পতন হলো।

আরও পড়ুন- চক্ষু চিকিৎসক থেকে স্বৈরশাসক! অবাক করবে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের উত্থান

২০১১ সালে দাদরা শহরে গণতন্ত্র রক্ষার বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। প্রথম থেকেই বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছিল আমেরিকা। সেই সময় থেকেই সিরিয়ায় বহু বিদ্রোহী দলও তৈরি হয় এবং দিন দিন হিংসা বাড়তে থাকে। দেশে কার্যত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আইএস ও আল-কায়দার মতো উগ্রপন্থী গোষ্ঠীরাও সিরিয়ায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সিরিয়া সরকার তখন আন্দোলনকারীদের উপর ব্যাপক দমনপীড়ন চালিয়েছিল। এই আন্দোলন নৃশংসভাবে দমন করার জন্য আসাদের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। অথচ এবার একপ্রকার বিনা বাধাতেই রাজধানী দখল হয়ে গিয়েছে। তেমন কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি আসাদের সরকার। কেন?

২০১১ সালে আসাদ এই আন্দোলনকে 'বিদেশ সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ' বলেছিলেন। এতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়েছিল এবং তখন থেকেই এই আন্দোলন আসাদ সরকারের পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। অন্যদিকে, ২০১১ সালে আসাদ রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতা নিয়ে আন্দোলন দমন করে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন। সেই সময় আসাদ সরকার রাশিয়ার বিমান শক্তি ব্যবহার করেছিল, ইরান সিরিয়ায় তাদের সামরিক উপদেষ্টাকে পাঠিয়েছিল, হিজবুল্লাহ তাদের প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের মোতায়েন করেছিল। এরকম পূর্ণ সমর্থন এবার আসাদ পাননি। সহযোগীরা নিজেদের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত ছিল। পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ চলছে। আর তাতে আসাদের দুই সমর্থকই ব্যস্ত। ইরান ইজরায়েলের সঙ্গে এবং রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। তারা আসাদকে একপ্রকার পরিত্যাগ করেছিল বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞদের একাংশ। যদিও ইরানের বিদেশমন্ত্রী আব্বাস আরাগাছি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বিদ্রোহীরা যখন রাজধানী দখলের জন্য এগোচ্ছিল তখনও নাকি ইরান কোনও হস্তক্ষেপের আহ্বান পায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আসাদ সরকারের পতনের কারণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ইরান। তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন, আসাদের আমলে সিরিয়াই ইরানিদের সঙ্গে হিজবুল্লাহর যোগাযোগের মূল পথ ছিল। আসাদ সরকারের পতনের পর হিজবুল্লাহকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠাতে সমস্যা হতে পারে। উল্লেখ্য, গত কয়েক মাসে ইজরায়েলে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে জোরদার হামলা হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলিতে লেখা শুরু হয়েছিল, হিজবুল্লাহ নাকি ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে অনেকটাই শক্তি হারিয়েছে। এতে সিরিয়ায় হিজাবুল্লাহর নেটওয়ার্ক অনেকটাই দুর্বল হয়েছে। ইরান সমর্থিত গোষ্ঠী- ইয়েমেনের হুথি, ইরাকের মিলিশিয়া এবং গাজার হামাস গোষ্ঠীগুলিও এখন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, সিরিয়ায় ইরানের সামরিক কমান্ডোদের উপর ইজরায়েলের আক্রমণ বিদ্রোহীদের হঠাৎ আলেপ্পো দিকে যেতে বাধ্য করেছে। আরও একটি কারণ হিসাবে বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননে ইজরায়েলের আক্রমণে হিজাবুল্লাহর যে পরিণতি হয়েছে তার কথাও।

বোঝাই যাচ্ছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনে ইজরায়েল খুশি হবে। সিরিয়ার গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ইজরায়েলের যুদ্ধবিমান রাজধানী দামাস্কাস সহ শত শত জায়গায় হামলা চালিয়েছে। তার মধ্যে রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন সংক্রান্ত একটি গবেষণা কেন্দ্র, দামাস্কাসের একটি অঞ্চল যেখানে ইরানের বিজ্ঞানীরা রকেট উৎক্ষেপণের কাজ করতেন সেখানেও হামলা হয়েছে। বলে রাখা দরকার, এই হামলা এমন সময় হয়েছে যখন জাতিসংঘের রাসায়নিক অস্ত্র সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ সংস্থা সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র থাকলেও তা সুরক্ষিত রাখার বিষয় সতর্কবার্তা দিয়েছে। ইজরায়েল জানিয়েছে, আসাদের পতনের পর অস্ত্র, গোলাবারুদ যাতে 'উগ্রপন্থীদের হাতে চলে না যায়' সে জন্যই তারা এই পদক্ষেপ করেছে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে। আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আসাদ সরকারের পতনের পর এবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের দ্রুত ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যদিও একাধিক আন্তজার্তিক সংবাদমাধ্যম বলছে, রাশিয়া ইউক্রেন আগ্রাসনে শক্তি বাড়িয়েছে।

আরও পড়ুন- সিরিয়ায় চরমপন্থীদের উত্থান! কোন বিপদের মুখে ভারত?

প্রসঙ্গত, ২০০০ সাল থেকে আসাদ ক্ষমতায়। গত ২৭ নভেম্বর তাঁর পতনের সূচনা হয় এবং মাত্র ১২ দিনেই দেশের সরকারের পতন হয়। ইসলামপন্থী সশস্ত্র দুই গোষ্ঠী 'হায়াত তাহরির আল-শাম' (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী 'জইশ আল-ইজ্জা'-র যৌথবাহিনী আসাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছে। এইচটিএস-এর লক্ষ্যই ছিল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা। ২০১১ সালে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়। সূচনালগ্নে সংগঠনের নাম ছিল জাবাত আল নুসরা। সেই সময় এটি আল-কায়দা জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সংগঠনটি গঠনের সময় আইএস গোষ্ঠীর নেতা আবু বকর আল বাগদাদিও ছিলেন। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই গোষ্ঠী বিপ্লবের চেয়ে জিহাদি আদর্শকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক সহ একাধিক দেশে এইচটিএস সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত।

আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিদ্রোহীরা 'ফ্রি সিরিয়া' নামে একটি জোট করেছিল। পরে এই জোটে মতের ভিন্নতা দেখা যায়। ২০১৬ সালে এইচটিএসের নেতা আবু মহম্মদ আল-জুলানি নতুন সংগঠন তৈরি করেন এবং জাবাত আল নুসরাকে বিলুপ্ত করেন। নতুন সংগঠনেরই নাম হয় তাহরির আল-শাম। মাঝে বেশ কিছুদিন এইচটিএস সিরিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশকে ক্ষমতার কেন্দ্র করেছিল। সংগঠনটি ওই এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনও চালু করে। সেখানে তাদের বিরুদ্ধে মানবধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল।বিশ্লেষকরা মনে করেন, আল কায়দার সঙ্গে জোট ভাঙার পর তারা খিলাফতের চেয়ে সিরিয়ায় ইসলামি শাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

উল্লেখ্য, সিরিয়া এখন এমন সংগঠনের হাতে যাদের অতীত হিংসার, যাদের উৎপত্তিই হয়েছে আল-কায়দার মতো সহিংস গোষ্ঠী থেকে। দেশে বহু মানুষই আছেন যাঁরা এই সংগঠনগুলি নিয়ে আশ্বস্ত নন। এর পরিণতি কী হবে? ক্ষমতার পরিবর্তন কি আরও বিপজ্জনক শূন্যতার মুখে ঠেলে দেবে? দেশটিতে কি আরও হিংসা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে? এই প্রশ্ন থাকছেই।

More Articles