চক্ষু চিকিৎসক থেকে স্বৈরশাসক! অবাক করবে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের উত্থান

Bashar Al-Assad: ২০০০ সালে হাফেজ মারা গেলে সংসদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার বয়স ৪০ থেকে কমিয়ে করে দেয় ৩৪ এবং দেশব্যাপী গণভোটের মাধ্যমে বাশার একমাত্র প্রার্থী হয়ে রাষ্ট্রপতি হয়ে যান

বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন হয়েছে সিরিয়ায়, বিদ্রোহীদের হাতে। ২০০০ সাল থেকে সিংহাসন সামলাচ্ছেন তিনি। বাবা হাফেজ আল-আসাদ ১৯৭১ সাল থেকে সিরিয়ার শাসনভার দখলে রেখেছিলেন। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেই বাশার আসেন ক্ষমতায়। হাফেজ ছিলেন নৃশংসতার অন্য এক নাম! বাশার যে সেই পথেই হাঁটবেন না, এমন আশা অবশ্য করেছিল সিরিয়াবাসী। তবে ক্ষমতার কাছাকাছি গেলে সব পাল্টেই যায় শেষমেশ।

চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিছুকাল কাজ করেছেন বাশার আল-আসাদ। লন্ডনে চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। পরে ব্রিটিশ-সিরিয়ান পাত্রী আসমাকে বিয়ে করেন। আসমা ছিলেন জেপি মরগানের একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। সিরিয়া যে তাঁর নেতৃত্বে ভিন্ন পথ অনুসরণ করতে পারে, বিশ্বকে তা দেখাতে চেয়েছিলেন বাশার আল-আসাদ। দমন-পীড়নের দীর্ঘ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও নতুন আসাদ পরিবার যে আসলে সাধারণ, তা দেখানোর জন্য ব্যাপক জনসংযোগ প্রচারও চালিয়েছিলেন বাশার। বলেছিলেন, বিশ্বের জানা উচিত যে তাঁর বাবা হাফেজ ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের নির্মম নিধনে 'সঠিক' সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন।

দুই দশকের পর সেই বাশার ক্ষমতাচ্যুত হলেন। আল-কায়দার একটি শাখাই তাঁর সরকারের পতন ঘটাল। আসাদ শাসনের অর্ধশতকের নাটকীয় সমাপ্তি ঘটল। সিরিয়ায় উপযুক্ত গণতন্ত্র চায়নি আসাদ পরিবার। আসলে বাবার থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না বাশারের ক্ষমতার দর্শনও। অত্যন্ত ব্যক্তিগতকৃত একনায়কত্বে বিশ্বাসী বাশারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুই ছিল সশস্ত্র বাহিনী, বিমান বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলি।

আরও পড়ুন- সিরিয়ায় চরমপন্থীদের উত্থান! কোন বিপদের মুখে ভারত?

যদিও বাশার ২০০১ সালে বেশ কিছু রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেন - প্রধানত কমিউনিস্টদের। আসলে পশ্চিমের দেশগুলিকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে তাঁর শাসনে সিরিয়ায় পরিবর্তন হচ্ছে। আড়ালে কিন্তু গ্রেফতারি কখনও থামেনি। সেদনায়া কারাগারকে বলা হতো ‘মানব বধ্যভূমি’, ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৩,০০০ মানুষ নিহত হয়েছেন সেখানে। প্রকৃতপক্ষে বাশারের শাসন তাঁর বাবার চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল।

হাফেজ ছিলেন বিমান বাহিনীর একজন কর্মকর্তা এবং বাথবাদী সংগঠক। প্রথম ১৯৬৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রবল। সেই অভ্যুত্থানেই বাথ পার্টির সিরিয়ান শাখা ক্ষমতায় আসে। আসাদের বাবা হাফেজ আসাদ বাশারের বড় ভাই বাসিলকেই তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে সামনে আনতে চেয়েছিলেন কিন্তু ১৯৯৪ সালে, দামাস্কাসে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় বাসিল নিহত হন। বাশার তখল লন্ডনে চক্ষু চিকিৎসক হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন। বাশারকে ডেকে পাঠানো হয় সিরিয়ায়। সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেখানে কর্নেল পদে উন্নীত হন বাশা যাতে তাঁকে একদিন সিরিয়া শাসন করার ছাড়পত্র দেওয়া যায়।

হাফেজ প্রায় ৩০ বছর সিরিয়া শাসন করেছিলেন। সেই সময় তিনি সোভিয়েত-ঘরানার কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ইরানে শিয়া ধর্মযাজকদের নেতৃত্বের সঙ্গে একটি জোট গঠন করেন, লেবাননের উপর সিরিয়ার আধিপত্য বন্ধ করে দেন এবং ফিলিস্তিনি ও লেবাননের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করেন।

২০০০ সালে হাফেজ মারা গেলে সংসদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার বয়স ৪০ থেকে কমিয়ে করে দেয় ৩৪ এবং দেশব্যাপী গণভোটের মাধ্যমে বাশার একমাত্র প্রার্থী হয়ে রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। প্রথম প্রথম সবাই ভেবেছিলেন বাশার তাঁর বাবার ঠিক বিপরীত। বাশার যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন তিনি নরম করে কথা বলতেন, দীর্ঘদেহী, ক্ষীণ, শান্ত এবং ভদ্র আচরণে সবার মনে অন্য আসাদ পরিবারের খোয়াব দেখিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি ছিলেন সিরিয়ান কম্পিউটার সোসাইটির প্রধান। তাই মানুষজনও বিশ্বাস করত, বাশার নেহাতই ভদ্র একজন টেক-স্যাভি মানুষ। বাশার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেন। আরও খোলামেলা আলোচনার পরিসর গড়েন।

আরও পড়ুন- পাঁচ দশকের শাসনের অবসান! কীভাবে সিরিয়ায় পতন হলো আসাদ সরকারের?

দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পর, বাশার ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আসমা আল-আখরাসকে বিয়ে করেন। তিনটি সন্তান হয় তাঁদের। অন্যান্য আরব নেতাদের মতো প্রাসাদের থাকতেন না। দামাস্কাসের আবু রুম্মানেহের হাই-প্রোফাইল একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন তাঁরা। আসমা ক্রমেই সিরিয়ার রাজকুমারী ডায়ানা নামে পরিচিত হয়ে যান। কুইন্স কলেজ লন্ডনে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং ফরাসি সাহিত্যে ডিগ্রিধারী ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার আসমা বাশারকে ২০০০ সালে গোপনে বিয়ে করেন। বাশারের তখন বয়স ৩৫ এবং আশমার মাত্র ২৫।

বাশারের শাসন যত এগোয়, তাঁর প্রকৃত চেহারাও সামনে আসে। ২০০৫ সালে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির হত্যার পর প্রতিবেশী লেবাননের উপর সিরিয়ার কয়েক দশকের নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসে। লেবাননে অনেকেই বাশারকে এই হত্যার পেছনে দায়ী করেছিলেন। সিরিয়া লেবানন থেকে নিজের সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং সেখানে আমেরিকাপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসে।

এই একই সময়ে, আরব বিশ্ব দু'টি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি পক্ষ ছিল আমেরিকার বন্ধু এবং মিশর আর সৌদি আরবের মতো সুন্নি-নেতৃত্বাধীন দেশগুলি ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। অন্যপক্ষে ছিল হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনি জঙ্গিদের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলা সিরিয়া এবং ইরান। ২০১১ সালে তিউনিসিয়া এবং মিশরের শাসকদের পতন ঘটে বিক্ষোভকারী হাতে। তখনই প্রশ্ন ওঠে, সরিয়াতেও কি এমনই হবে? যদিও বাশার সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেন। তবে অঘটন ঘটেই। বিদ্রোহ শুরু হয়। অভুত্থান গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয় এবং লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান জর্ডান, তুরস্ক, ইরাক, লেবানন এবং ইউরোপে পালিয়ে যান।

More Articles