ঘৃণাপ্রচারেই এদেশে আরও পিছিয়ে পড়ছেন সংখ্যালঘু মুসলিমরা?
Bangladesh-India Minority: অনেকেই বলেন, মুসলিমদের সাক্ষরতা বা পড়াশোনায় অবহেলার জন্য তাদের ধর্মের নিজস্ব গোঁড়ামি দায়ী।
বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে খুব ছক কষেই এগোচ্ছে বিজেপি। আমাদের নিজেদের দেশের সংখ্যালঘুদের উপর রোজ আক্রমণ নামিয়ে আনছে যারা, ভারতের সেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ইস্যুকে হাতিয়ার করে আসলে নিজেদেরই আকগের গোছাচ্ছে। আমাদের দেশের ঘৃণার আবহ গত দশ বছরে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একজন মুসলিম নাগরিক নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁর নিজের ধর্ম পালনের অধিকার নেই, তাঁর নিজের বাসস্থানের অঞ্চল পছন্দ করার অধিকারও নেই। তাঁর কিংবা তাঁর পরিবারের সদস্যরা, কী খাবেন, কী পরবেন সেটাও ভারতের সংখ্যাগুরুরা ঠিক করে দেন। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চলের এক মুসলিম চিকিৎসককে একটি আবাসনে ফ্ল্যাট বিক্রি নিয়ে চূড়ান্ত গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। ওই আবাসনের হিন্দু বাসিন্দাদের মনে হয়েছে, তাঁদের আবাসনে মুসলিম চিকিৎসক দম্পতি পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করলে তাঁদের মহিলাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা আবাসনে ধর্না অবধি দিয়েছেন। খবরে প্রকাশ, আবাসনটিতে প্রায় ৪০০ পরিবারের বাস। তাঁদের মধ্যে একটি পরিবারের থেকেও এই বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কোনও আওয়াজ শোনা যায়নি।
বাসিন্দাদের ক্ষোভ, জনৈক অশোক বাজাজের বিরুদ্ধে। তিনি নিজেও একজন চিকিৎসক। তিনিই ওই দম্পতিকে ফ্ল্যাটটি বিক্রি করেছেন। অরবিন্দ আগরওয়াল বলে এক বিক্ষোভকারীর বক্তব্য, যখন আবাসনটি তৈরি হয়েছিল, তখনই নাকি অলিখিতভাবে
ঠিক হয়েছিল, যদি ভবিষ্যতে কোনও বাসিন্দা, নিজেরা আবাসন ছেড়ে চলে যান তাহলে কোনও ‘অহিন্দু’ মানুষকে তা বিক্রি করতে পারবেন না। কোন আইনে তাঁরা এমন অলিখিত নিয়ম করেছেন? অশোক বাজাজ যাতে ওই ফ্ল্যাটটি ইক্রা এবং ইউনূস জাহানের থেকে আবার কিনে নেন, সেই সংক্রান্ত ব্যানার পড়েছে আবাসনের দরজায়। মোরাদাবাদের পুলিশ-প্রশাসন বিষয়টির দিকে নজর রাখছে এবং দু-পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে বলে খবর।
আরও পড়ুন- ভারত বাংলাদেশের সুসম্পর্ক ফেরাতেই হবে! পদক্ষেপ শুরু হলো দুই তরফেই
মধ্যপ্রদেশের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এক যুবক তিনটি বাচ্চাকে জুতো দিয়ে মারছে আর ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বলছে। কলকাতার বেশ কিছু চিকিৎসক বলছেন তাঁরা আর বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা করবেন না। কোনও চিকিৎসক এমন বলতে পারেন কি?
কোনও মানুষ বলতে পারেন কি যে তিনি কোনও মুসলিমকে প্রতিবেশী হিসেবে চান না? এই হিংসা-দ্বেষ কি আমাদের মধ্যে নিহিতই ছিল, যা গত দশ বছরে আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে? নাহলে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩২ বছর পরে কোনও মানুষ যদি মনে করেন, এই ঘটনা জাতীয় লজ্জা, তখন ঘৃণার কারবারিরা একযোগে সেই মানুষটিকে হেনস্থা করতে চলে আসেন কেন সামাজিক মাধ্যমে?
সামাজিক মাধ্যম না থাকলে কি ঘৃণার প্রচারকারীরা এইরকম আস্ফালন করতে সাহস পেত না? এই ঘৃণা-বিদ্বেষ শুধু গোবলয়ের? এর কোনও প্রভাব কি বাংলায় নেই? এখানেও কি মুসলমান মানুষেরা তাঁদের সম্প্রদায়ের বাইরে পছন্দমতো জায়গায়, ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করতে পারেন? এই বাংলার মুসলমানদের নিয়ে বিশদে কাজ করেছে স্ন্যাপ সংস্থা এবং অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট। যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে তার নাম- ‘লিভিং রিয়ালিটি অফ মুসলিমস ইন বেঙ্গল’। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ সালে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্টের পরে, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের অবস্থান এতটুকুও বদলায়নি। যে রাজ্যে প্রায় ২৭ শতাংশ মুসলমান মানুষ বসবাস করেন, সেই রাজ্যে এই ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে মুসলিম জনসংখ্যা রোজ দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একদিন তারা হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবেন। ২০১১ সালে শেষ যে জনগণনা হয়, তাতে বলা হয়েছিল, সমস্ত ধর্মের মানুষদের জন্মহার বৃদ্ধির হার দেখে মনে করা হচ্ছে, ‘হিন্দু, মুসলমান এবং ক্রিশ্চানদের বৃদ্ধির হার ২০২১ সালের জনগণনায় আরও কমবে বলে আশা করা যায়…’। লিভিং
রিয়ালিটি যে কতটা জীবন্ত, তা ওই প্রতিবেদনের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে আছে। গ্রামীণ অঞ্চলে মুসলমানদের সাক্ষরতার হার ৬৮.৩ শতাংশ, যা অন্য ধর্মের মানুষদের তুলনায় অন্তত ৪ শতাংশ কম। ২০১১ সালের জনগণনাতেও একইরকম তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। অর্থাৎ বাম জমানা থেকে আজকের তৃণমূল জমানায় এই বিষয়ে অন্তত খুব বেশি তফাত হয়নি। উচ্চশিক্ষাতেও মুসলিমদের অবস্থা হিন্দুদের তুলনায় বেশ খারাপ। মাত্র ২.৭ শতাংশ মুসলমান মানুষ স্নাতক।
অমর্ত্য সেন ওই প্রতিবেদন প্রকাশের সময়ে যে কথাগুলো লিখেছেন ভূমিকায়, তা আজও প্রাসঙ্গিক। ২০১৬ সালে এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরে আরও অন্তত ৮ বছর পেরিয়েছে। এই প্রতিবেদন যাঁরা তৈরি করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন গবেষক সাবির আহমেদ সম্প্রতি কলকাতার মেডিকেল কলেজে আরটিআইয়ের আবেদন করেন। তাঁকে উল্টে বলা হয়, আগে তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে, তবে তাঁকে উত্তর দেওয়া হবে। দেশে কোথাও এমন কোনও আইন নেই। যে তথ্য সাবির জানতে চেয়েছেন, তা এমন কিছু গোপনীয়ও নয়। তাও একজন জাতীয় স্তরের গবেষককে এই অপমান করা হলো। সাবির নিজের আধারের প্রতিলিপি পাঠালে তাঁকে বলা হয়, আধার নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় (যদিও এটা ঠিকই বলা হয়েছে)। তাহলে কেন এই হেনস্থা?
আরও পড়ুন- বাংলাদেশিদের চিকিৎসা না করার হুমকি ভারতের ডাক্তাররা দিতে পারেন?
এই ঘটনা দেখিয়ে দেয়, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের জন্য এই দেশ আরও কঠিন ঠাঁই হয়ে উঠেছে। অনেকেই বলেন, মুসলিমদের সাক্ষরতা বা পড়াশোনায় অবহেলার জন্য তাদের ধর্মের নিজস্ব গোঁড়ামি দায়ী। কিন্তু সাবির আহমেদের উদাহরণ কী বলে? শুধু সাবির আহমেদ কেন, এইরকম অজস্র উদাহরণ আছে। মফসসল শহর থেকে যাঁরা কলকাতায় পড়তে আসেন, তাঁদের বাড়িভাড়া পেতে অভাবনীয় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যদি বা পান, তাঁদের ধর্ম পরিচয় গোপন রাখতে হয়, সমস্ত ধরনের পরিচয়পত্র জমা রাখতে হয়। আসলে আমাদের সমাজে সংখ্যালঘুদের ‘অপর’ বানানোর এই প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে ছিলই। প্রচলিত গণমাধ্যমের কল্যাণে তা শুধু বেড়েছে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন নিয়ে গণমাধ্যমগুলি যে অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করছে, এতে ওই দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের কোনও উপকার হচ্ছে না। একমাত্র ভারতের বিজেপির উদ্দেশ্য সাধন হচ্ছে। যাতে ২০২৬ সালের বাংলার নির্বাচনে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করা যায় সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের বা যে কোনও প্রতিবেশি দেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের নিয়ে আরও হিংস্র গল্প তৈরি করা হচ্ছে। এই কি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা? বাংলাদেশের অধ্যাপক আনু মহম্মদ, সলিমুল্লা খান সহ ১৪৫ জন বিশিষ্ট মানুষজন বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, “আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক প্রবণতা আর শক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়ব, আপনারাও আপনাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। আপনাদের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, গণ অভ্যুত্থানে যাঁরা জীবন দিয়েছেন তাঁদের আকাঙ্খার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে আপনারা এই চক্রান্ত প্রতিহত করবেন। এ লড়াই ভারতের বৃহৎ পুঁজির শোষণ-লুণ্ঠন আর নিপীড়ন-নির্যাতন-আধিপত্যের বিরুদ্ধে উভয় দেশের জনগণের নিরন্তর লড়াই। বিভেদ, বিদ্বেষ আর ধর্মকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই। এই লড়াই এগিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশা আমরা করি। এই লড়াইয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত জয়ী হব।" এই বিবৃতি জন্মসূত্রে এদেশের একজন সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধি হিসেবে লজ্জায় মাথা নিচু করে দেয়। এই বক্তব্যকে সমর্থন করা ছাড়া কোনও উপায়ও থাকে না।