নদীর গর্ভে পাঁচশো বছরেরও পুরনো মন্দির, যেভাবে আবিষ্কার হয়েছিল এই প্রাচীন স্থাপত্য

মানুষও আস্তে আস্তে ভুলে গিয়েছিল এই মন্দিরের কথা। শুধু মাঝে মাঝে বন্যায় ওপরের বালু সরে গেলে মন্দিরের চূড়ার মতো কিছু একটা দেখা যেত। পুরাতত্ত্ব বিভাগের এই নিয়ে তেমন খোঁজখবর ছিল না। বছরদুয়েক আগে সম্ভবত বন্যার কারণেই চূড়াটি ব...

বছরদুয়েক আগে এই জুন মাসেই পাওয়া গিয়েছিল ৫০০ বছর পুরনো একটি মন্দিরের খোঁজ। মহানদীর বুকে বহুদিন ধরেই খোঁজ চলছিল এই মন্দিরের। শেষে উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরের নয়াগড় জেলায় মাথা তুলল এই মন্দির। এই প্রাচীন মন্দির দর্শন করতে দূরদূরান্ত থেকে বহু ভক্ত এসে উপস্থিত হন পদ্মাবতী গ্রামে।

অনেকদিন আগে সাতোপাতোনা নামে একটি অঞ্চল ছিল। কটকের বৈদেশ্বর থেকে সাত কিলোমিটার দূরত্ব তার। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে মহানদী। সেসময় মহানদীতে জল ছিল না তেমন। কাছেই লোকজন সুখে-শান্তিতে বসত করত সেখানে। কথিত ছিল, সাতোপাতোনার গোপীনাথ মন্দির ছিল অত্যন্ত জাগ্রত। সাত-সাতখানা অঞ্চল নিয়ে তৈরি, তাই নাম হয়ে গিয়েছিল সাতোপাতোনা। কিন্তু গ্রামবাসীদের সেই সুখ খুব বেশিদিন সইল না। হঠাৎ করে বান এল মহানদীতে। উচ্ছ্বসিত জলরাশি তীরের বেশ কিছু বাড়িঘর ভেঙে, ডুবিয়ে দিয়ে গেল। এরপরই নদীর গতিপথ বদলাতে থাকত ধীরে ধীরে। একটু একটু করে লোকালয় গিলতে শুরু করল সে। রাস্তা, ঘরবাড়ি, দোকান-হাট চলে গেল নদীগর্ভে। সাতোপাতোনার মানুষ অত্যন্ত ত্রাসে সেই জায়গা ছেড়ে সরে যেতে থাকল আশেপাশের উঁচু জমির দিকে। মন্দিরের প্রদীপ নিভল। সরিয়ে আনা হল সমস্ত বিগ্রহ। তৈরি হলো নতুন সমস্ত মন্দির। শোনা যায়, সেসময় বৈদেশ্বর থেকে কান্তিল পর্যন্ত প্রায় বিশটিরও বেশি মন্দির ছিল। সব নদীর গর্ভে চলে যায়। এদের মধ্যে সবথেকে উঁচু মন্দিরটিই পদ্মাবতী গ্রামের গোপীনাথ দেবের মন্দির। পদ্মাবতী গ্রামটি নয়াগড়ের ভাপুর মহকুমার মধ্যে পড়ে। ধীরে ধীরে নদীর বালিতে ঢেকে গেল যেটুকু চিহ্ন বাকি ছিল। মানুষও আস্তে আস্তে ভুলে গিয়েছিল এই মন্দিরের কথা। শুধু মাঝে মাঝে বন্যায় ওপরের বালু সরে গেলে মন্দিরের চূড়ার মতো কিছু একটা দেখা যেত। পুরাতত্ত্ব বিভাগের এই নিয়ে তেমন খোঁজখবর ছিল না। বছরদুয়েক আগে সম্ভবত বন্যার কারণেই চূড়াটি বেরিয়ে আসে নদীর গর্ভ থেকে অনেকখানি।

‘মহানদী ভ্যালি হেরিটেজ সাইট ডকুমেন্টেশন’ নামে INTACH-এর একটি প্রোজেক্ট রয়েছে ভারতে। যাদের কাজ এই মহানদীর গর্ভে থাকা প্রাচীন স্থাপত্যের খোঁজখবর রাখা, সেগুলি নথিবদ্ধ করা। প্রোজেক্ট অ্যাসিস্টেন্ট দীপক নায়কের কাছে খবরটা ফোন করে জানান তাঁর বন্ধু রবীন্দ্র রানা। হীরাকুদ ড্যামের কাছে ইতিউতি ডুবে থাকা কয়েকটি মন্দিরের কথা জানতেন দীপক। কিন্তু রবীন্দ্র যে মন্দিরের কথা জানাল, তা একেবারেই নতুন। এর কোনও রেকর্ডই ছিল না দীপকদের কাছে। বিশেষত মহানদী উপত্যকার নিম্ন-মধ্য অঞ্চলে এমন এক স্থাপত্যের খোঁজ পেয়ে দীপক সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর অনিল ধরকে। বললেন, তাঁদের প্রোজেক্টের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে এই সাইটটিকে নথিবদ্ধ করা হোক, এখনই, কোনও সময় নষ্ট না করে।

আরও পড়ুন: নদীর অতলে তলিয়ে গেছে একের পর এক মন্দির, পুরুলিয়ার যে ইতিহাস চলে গেছে আড়ালে

দিনতিনেকের মাথায় সাইটে যাওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি নিলেন অনিল এবং দীপক। কিন্তু যাত্রা সফল হলো না। ইতিমধ্যে কোভিডের চক্করে লকডাউনের ঘোষণা হয়ে গেল। লকডাউনের বিধিনিষেধ একটু হালকা হতেই রানার সঙ্গে তাঁরা দৌড়লেন পদ্মাবতী। কিন্তু এবারেও ভাগ্য প্রসন্ন হল না। তিন-তিনবার গেলেন, কিন্তু জল কমে না। মন্দির সম্পূর্ণ জলের তলায়। এই অবস্থায় স্থাপত্য খুঁটিয়ে দেখা অসম্ভব। আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন দীপক, এমন সময় জুন মাসের এক সন্ধ্যায় আকস্মিকভাবেই খবর এল, মন্দিরের সামান্য একটু অংশ মাথা তুলেছে। অনিল ধরের অনুমতি নিয়ে পরদিন সকাল সাতটা নাগাদ বৈদেশ্বর বাজারে পৌঁছলেন দীপক। সেখানে রতনবাবু তাঁর অপেক্ষা করছিলেন। দু'জনে পদ্মাবতী গ্রামের বালুঙ্কেশ্বর মন্দিরে গিয়ে হাজির হলেন। সেখান থেকে নদীপথ। জেলেদের একটা নৌকো ভাড়া করে এগনোও গেল। এক পুরোহিত তাঁদের জায়গাটা দেখিয়ে দিতে রাজি হলেন। তখনও অবধি মন্দিরটা ঠিক কোন জায়গায়, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল না।

মিনিটখানেকের মধ্যেই মন্দিরের চূড়া দেখা যেতে লাগল। রানা এবং দীপক– দু'জনেই বেশ উত্তেজিত। ছবি তোলা দরকার। ওই ছোট বোট, তার দুলুনি তো আছেই, স্রোতেরও বেগ রয়েছে। এই অবস্থায় ফটো তোলা তো দূর ক্যামেরা হাতে রাখাই মুশকিল। নৌকোর সেই পুরোহিত তখন এক আশ্চর্য কাণ্ড করলেন। নৌকা থেকে নেমে তিনি মন্দিরের দধিনৌতি অঞ্চলে চেপে বসলেন। তারপরে হাত দিয়ে চেপে ধরতেই নৌকা খানিক স্থির হল। কয়েক মুহূর্ত। তার মধ্যেই ছবি তুলে নিয়েছেন দীপকরা।

এবার ফেরার পালা। এতক্ষণে বোঝা গেল, কেন মন্দিরের চূড়াটি ভেসে ওঠে। বিশালাকৃতি এই চূড়া দেখেই বোঝা যায়, মন্দিরটি কত বড়। মন্দিরে বিমন এবং জগমোহন দুইই থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিমন রেখা দেউলা ধাঁচের। আর জগমোহন পিড়া ধাঁচের। মন্দিরগাত্রের পাথর দেখে বোঝা যায়, এটি পঞ্চদশ কি ষোড়শ শতকের মন্দির। যখন এলাকা ডুবে যায়, তখন এই মন্দিরের অনেকগুলি বিগ্রহ সরিয়ে নেওয়া হয়। তার মধ্যে গোপীনাথ, নৃসিংহ, রাসবিহারী, কামনা দেবী এবং দধিবামন উল্লেখযোগ্য। এই বিগ্রহগুলি এখনও পদ্মাবতী গ্রামে পূজিত হয়। দধিবামন পূজিত হন পাশের টিকিরিপাদ গ্রামে।

এরপর দীপক এবং রানা পদ্মাবতীর বর্তমান গোপীনাথ মন্দিরে যান। মন্দিরগাত্রে একটি পাতে লেখা রয়েছে, ১৮৫০ নাগাদ বেবর্ত কেশব পট্টনায়ক এই মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরে গোপীনাথ, রাসবিহারী, মদনমোহন, নিকুঞ্জবিহারী প্রভৃতি রূপে পূজিত হন কৃষ্ণ। গজপতি যুগে রাজা পুরুষোত্তম দেব কাঞ্চি থেকে একটি সুন্দর সখী গোপীনাথ বিগ্রহ নিয়ে আসেন কটকে। এরপরেই এই বিগ্রহগুলি নির্মিত হয়। গজপতি যুগের বংশীবাদনরত কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গে এই বিগ্রহের মিল প্রচুর, যদিও আকার একটু ছোট। পাঁচশো বছরের এই মন্দির দেখতে পদ্মাবতীতে প্রায়শই জড়ো হন ভক্তরা। ভবিষ্যতে নদীখাত পরিবর্তিত হলে হয়তো বা খোঁজ পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ মন্দিরগুলিরই। কে বলতে পারে!

 

 

More Articles