ঘুমোতে দেয় না যুদ্ধের স্মৃতি, বিরল রোগে দীর্ঘ ৬০ বছর একটানা জেগে ভিয়েতনামের বৃদ্ধ

Sleepless man of Vietnam: একটানা ৬০ বছর ঘুমোননি থাই নক। অথচ শরীরে কোনও ক্লান্তি নেই... কেন জেগে থাকেন তিনি?

কুম্ভকর্ণ ৬ মাস ঘুমোতেন। মানুষ দিনে অন্তত সাত-আট ঘণ্টা। সরিসৃপেরা গোটা শীতকাল। অন্ন-জল ছাড়া যেমন জীবনধারণ সম্ভব নয়, তেমনই ঘুম। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক শর্তের একটি ঘুম।

সারারাত ধরে তারা দেখা যাঁদের নিয়তি, তাঁরাই জানেন তা কতটা যন্ত্রণার। তা সে শারীরিক কারণে হোক বা পেশাগত কারণে। নাইট ডিউটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে ভুক্তভোগী মাত্রেই সচেতন। যাঁরা দীর্ঘকালীন অনিদ্রা কিংবা ইনসমনিয়ার শিকার, প্রতিটা রাত তাঁদের কাছে কী মারাত্মক রকমের দুঃসহ, তা বলে বোঝানো কঠিন।

আরও শুনুন: দু’চোখের পাতা এক করলেই বিপদ! কখনওই নিশ্চিন্তে ঘুমায় না যেসব প্রাণী

আমাদের মস্তিস্ক, স্নায়ু সারাদিন ধরে নানাবিধ কাজ করে চলে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের কাছে পৌঁছে দেয় নানা নির্দেশ। সারাদিন আমরা যা যা কাজ করি, সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের মস্তিষ্কের মাধ্যমে। ঘুমের সময়টুকুই তার বিশ্রামের সময়। তা-ও ঘুমোনোর সময়েও যে আমাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিরাম পায়, তা কিন্তু নয়। তখনও কাজ করতে থাকে ব্রেনের কিছু অংশ। তবে কিছুটা অংশ বিশ্রাম পায় তো বটেই। সাময়িক বিশ্রাম পায় শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও। তাই শরীরকে সুস্থ রাখতে ঘুমের কোনও বিকল্প নেই।

তবে ভিয়েতনামের এই বৃদ্ধ যেন সেই সব অঙ্কের বাইরে। একটানা ৬০ বছর ঘুমোননি তিনি। শরীরে রয়েছে তাঁর কোনও রোগ নেই, কোনও অসুবিধা নেই। দিব্যি সুস্থ শরীরে ঘুরে বেড়ান অশীতিপর এই ব্যক্তি। কিন্তু ভিতরে কাটতে থাকে কোন বিষপোকা অহরহ। কেন জেগে থাকেন তিনি?

ভিয়েতনামের বাসিন্দা থাই নক। সম্প্রতি সামনে এসেছে থাই নকের এই অবিশ্বাস্য জীবনের কথা। এই আশি বছরে ৬০ বছরই নাকি তিনি না-ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। আজ থেকে নয়, প্রায় ১৯৬২ সাল থেকেই এই পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন তিনি। পরিবার-পরিজন থেকে বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী কেউ তাঁকে কস্মিনকালেও ঘুমোতে দেখেননি। চিকিৎসকের পরামর্শও কম নেননি নক। সকলেই তাঁকে নানবিধ পরীক্ষা করেছেন, তাঁদের মত, স্থায়ী ইনসমনিয়ার শিকার ওই বৃদ্ধ। তবে এই যে দীর্ঘকালীন বিশ্রামহীন অবস্থা, তার কোনও প্রভাব তাঁর শরীরে পড়ে না। আর তাতেই অবাক চিকিৎসকেরা। এমন অসুখ নাকি বেশ বিরল। নক লাখে একজন, যিনি এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার।

বেশ কয়েক বছর আগে প্রথম বার সামনে আসে নকের এই অসুস্থতার কথা। তবে এ শুধু রোগ নয়। এর শিকড় পোঁতা আরও গভীরে। অনেকেই মনে করেন, আদতে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্জারের শিকার বৃদ্ধ নক। যার কারণ হতে পারে যুদ্ধ। নক জানিয়েছেন, ১৯৬২ সাল থেকে আর ঘুমোতে পারেননি তিনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ের দিকে তাকালে কিন্তু সেই সম্ভাবনা মিথ্যে মনে হয় না। ১৯৫৫ সালের নভেম্বরে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ভিয়েতনামে, চলে ১৯৭৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। এর মাঝেই এই ভয়াবহ রোগের মুখোমুখি হন নক। ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুধু রাতের ঘুম নয়, কেড়ে নিয়েছিল নকের হাতের অনেকটাই। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না চিকিৎসকেরাও।

যুদ্ধ আসে, যুদ্ধ যায়। উলুখাগড়ারা জেগে থাকে সেই যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে। যেমনটা জেগে আছেন নক। হাতহীন, ঘুমহীন। খুব ক্লান্ত লাগলে গ্রিন টি আর ভাত থেকে তৈরি মদে গলা ভেজান। কেউ কেউ বলেন, বিশ্বের অন্যতম ভাগ্যবান ব্যক্তি নক। কারণ তিনি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বৃদ্ধ ব্যক্তি, যিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বেঁচেছেন। কারণ তাঁর ঘুমিয়ে সময় অপচয় করতে হয়নি। পৃথিবীকে সব চেয়ে বেশি দেখেছেন তিনি।

আরও শুনুন: রাতের পর রাত ঘুম নেই, জানেন আপনার সামান্য গাফিলতিই ডেকে আনতে পারে যে মারণ ঝুঁকি

কিন্তু সত্যিই কি তাই! যুদ্ধের স্মৃতি মাথায় ঠেসে এই জেগে থাকা কি ভালো? বিশেষত এই বয়সে পৌঁছে যখন ঘুমের দরকার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আজও নিজের যন্ত্রণার কথা তেমন করে কাউকে জানাতে পারেন না নক। বরং তা বুকে চেপে তিনি জেগে থাকেন বছরের পর বছর, জীবনের পরে জীবন। তাঁকে নিয়ে খবর হয়, ইউটিউবাররা ক্যামেরা কাঁধে ছুটে যান তাঁর কাছে। হাসিমুখে তিনি নিজের নির্ঘুম বেঁচে থাকা তুলে ধরেন সকলের সামনে। আর প্রতিবার জেগে ওঠে যুদ্ধের স্মৃতিরা, মগজে কার্ফু আনে। জেগে থাকেন নক।

More Articles