নগর শেখায় আত্মনির্মাণের চাকচিক্য, আত্মগোপনের কৌশল

মেট্রো রেলের ভাড়া যতই কম হোক তাতে নিম্নবর্গ যাত্রী তেমনভাবে দেখতে পান? শহরই একমাত্র জায়গা যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী কেবল ইংরেজি ভাষাতেই দেওয়া থাকে।

শুরু করেছিলাম পূর্ণচন্দ্র দে উদ্ভটসাগরের ইতিহাস চিন্তা নিয়ে দু-কথা বলব বলে, এপাশ-ওপাশ বকর বকর করতে গিয়ে শেষ হলো নামদেও ধসালের প্রসঙ্গে! এজন্যই বড়রা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা বারংবার সাবধান করতেন, বেশি এলোমেলো কথা বলা বন্ধ করো! কে শোনে সেসব!

বলতে চাই যে, বিশ্বজুড়ে ইতিহাস বিষয়ে চিন্তা চেতনার নানা নতুন নতুন মুখ খুলে গেছে। দীপায়ন যুগ (Enlightenment)-কে কেন্দ্রে রেখে সরল-সিধা প্রগতি আর প্রগতি বিরোধিতার (পড়ুন ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’র) ছকে ইতিহাসের ঘটনাবলিকে সাজিয়ে তোলার সরলরৈখিক লিখন থেকে অনেকদূর সরে এসেছি আমরা। ‘বিকল্প’ ইতিহাস রচনার নানা পদ্ধতির কথা ভাবছি। এই সন্ধানে ইতিহাসের এক গতিময় প্রবাহের অবয়ব দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ যা স্থাণু এবং কাঠামোবদ্ধ নয়। বরং এই ইতিহাসে বহুস্বর এবং বহুশরিক। এমন এক ইতিহাসচিন্তা, যা জায়মান। ‘জায়মান’ বলতে বোঝানো হচ্ছে, যে ইতিহাসে নানা উপাদান এবং অবলোকন নতুন জানলা-দরজা খুলে দেবে। অসংগঠিত, অবহেলিত, বহু ঘটনার টানাপড়েনজাত তথ্য থেকে ইতিহাসের চেহারা গড়ে উঠবে। আগে থেকে নির্ধারিত কোনও সিদ্ধান্তের দিকে জোর-জবরদস্তি ‘ইতিহাস’-কে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে না। উপনিবেশের প্রভুরা বহুলাংশে আমাদের ইতিহাসবোধকে তাঁদের দৃষ্টির কর্তৃত্বে নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন। আমরা সেই জাবর কেটেই চলেছি। সেই চর্বিতচর্বণকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নতুন ঐতিহাসিকেরা বেশ কয়েক দশক ধরে বিশ্বের নানা কোণে সক্রিয়। সেখানে স্থাণু স্বরলিপি আর নির্ধারিত সমাজ নির্মাণের খাঁচা আঁটা ব্লু প্রিন্ট নেই।

যেমন ধরা যাক, আফ্রিকার ‘ইবাদান স্কুল অফ হিস্ট্রি’র কথা। নাইজেরিয়ার ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিশেষ ইতিহাস সন্ধানের ধারা ১৯৫০-এর দশক থেকে গতি পেয়েছিল। সত্তরের বছরগুলিতে এই ইতিহাস বিভাগ আন্তর্জাতিক খ্যাতিতে ভাস্বর হয়। পরে অবশ্য নানা কারণে এর অবলুপ্তি ঘটে। কিন্তু ইতিহাসবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে ‘ইবাদান স্কুল’ একটা স্থায়ী গুরুত্ব এবং প্রভাব রেখে যায়। নাইজেরিয়া এবং সেই সূত্রে আফ্রিকার ইতিহাস পুনর্বার নিরীক্ষণের সূত্রে এই ঐতিহাসিকরা ঔপনিবেশিক প্রভুদের তৈরি করা আর শেখানো ইতিহাসের রূপরেখাটাই বাতিল করে দিতে চান। তারা ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন মৌখিকতা (Orality), মৌখিক সাহিত্য (Orature), এবং দেশজ গোষ্ঠী পরম্পরায় বহমান ঐশ্বর্যশালী নানা কাহিনি, কিংবদন্তি, গাল-গল্প এমনকী প্রচলিত গাথা বা পার্বণের আচার। উপনিবেশের প্রভুদের ইতিহাস এবং ইতিহাস কথনকে সরিয়ে একটা বিকল্প ইতিহাস সন্ধানের প্রক্রিয়া ইবাদান স্কুলের স্বপ্নময় ঐতিহাসিকদের হাতে তৈরি হয়েছিল। আমরা একথাও জানি যে, আর্কাইভ, অভিলেখ্যাগার, সংরক্ষণাগার, দলিল দস্তাবেজ, এমনকী জাদুঘরে রাখা সামগ্রী – সবেরই একটা ঔপনিবেশিক আমলের পরিকল্পনা বা অভিসন্ধি আছে। দখলদারদের ইতিহাস সেখানে গরিমা পায়। পরাজিত জনবৃত্তকে নিজেদের আধিপত্যে আনার সেই ইতিহাসই আজ মূলধারার নিশান কাঁধে ব্যক্ত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া, লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকায়। ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহি বিদ্রোহ’-কে এই সুচতুর ইতিহাস নির্মাণে সামান্য ‘Mutiny’-তে পরিণত করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় শিক্ষাগ্রন্থে এবং ইতিহাসের সিংহদরবারে। ওই ১৮৫৭ হলো সেই সাল যখন একদিকে বিদ্রোহী সিপাহি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে লড়াই করতে আসা কৃষকদের পরিবারসহ গাছের ডালে হত্যা করে লটকে দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বড় সংখ্যক বাঙালি অর্থাৎ বাদামি মানুষকে মনে মনে চিন্তাশিক্ষার সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গিতে আচ্ছন্ন করার ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়া। লুই আলথুসের এই দুই প্রক্রিয়াকে স্পষ্ট করেছেন। এ হলো ক্ষমতার এক দুর্দান্ত কৌশল। একটির নাম রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস বা দমনমূলক রাষ্ট্রিক বল – যা বিদ্রোহীকে অথবা ভিন্ন মতাবলম্বীকে ‘অস্বাভাবিক’-কে নিপীড়ন এবং হত্যা করে, আর দ্বিতীয়টি মতাদর্শগত রাষ্ট্রিক বল – ইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটাস যা বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, সংশোধনাগার, পাগলা গারদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নাগরিককে চিন্তার সীমাবদ্ধতায় ক্ষমতার দাসত্ব করায়। এই সাঁড়াশি কৌশল ঔপনিবেশিক শাসনেরও পরিচিত প্রয়োগ। ফলে, উপনিবেশের প্রজার লেখাও বহুলাংশে এই প্রভুবর্গের শেখানো বুলি। হুতোম প্যাঁচার নকশায় (১৮৬০) আমরা প্রথমে দেখতে পাই একটা বিকল্প ইতিহাসের ব্যবহার। তৎকালীন নানা ঘটনায় নিম্নবর্গের প্রতিক্রিয়া, প্রচলিত গান, জনশ্রুতি, হুজুগ কিংবা ব্যঙ্গবিদ্রূপ, গালগল্প, ছড়া। যেন ইতিহাস নিষ্কাশনের সমান্তরাল বিকল্প পদ্ধতি। ইতিহাস যেন প্রশ্ন করছে, কার ইতিহাস? কোন দিক থেকে দেখা ইতিহাস? প্রতিরোধ বা বিদ্রোহে লিপ্ত দেশিয় কৃষক এবং তার চৈতন্যকে বারংবার ইংরেজি এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতি-দর্শনের অপরিবর্তনীয় দমবন্ধ কাঠামোয় ফেলে মূল্যায়ন করার প্রবণতা ইতিহাস সন্ধানের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।

পূর্ণচন্দ্রের লেখালেখি, তাঁর নিজস্ব শিথিল কথাপটে ব্রিটিশ ইতিহাসের স্বার্থকর্তৃত্বের বাইরে থাকা উপাদানের ব্যবহার করে। জনপরিসরে কীভাবে ব্রিটিশ শাসনের পরিব্যাপ্ত কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ক্রোধ এবং ভয়, বিকর্ষণ এবং সংঘর্ষ বহমান ছিল, দৃশ্যমানতার তলায় তলায় জনগণমনের ইশারা, মতামত, বিতৃষ্ণা, অবিশ্বাস কাজ করে যেত – তার চিহ্নগুলি খুঁজতে চেষ্টা করা যায়।

যে কোনও মহানগর মানেই এই বহুস্বর বহুবিচিত্র সুরসঞ্চার। ছোট টাউন বা সদর শহর বা নগর বলতে যা বোঝায়, মহানগর তার থেকে ঢের অতিকায়। মহানগর মানে শুধু জনসংখ্যা, জনবসতির ঘনত্ব বা এলাকার বিশালতাই নয়, মহানগর আমাদের সামনে নিয়ে আসে বহুবিধ মানুষের বহুপ্রকারের দৃষ্টিকোণ, বহুমাত্রিক জীবনচর্যা, নতুন নতুন অবস্থান-বাস্তবতা-মগ্নচৈতন্য। বহু ধর্ম, শ্রেণি, বর্গ, বর্ণ, অর্থনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্য, পালাপার্বণ এবং বহুরূপের গোষ্ঠী প্রথা – এ সব মিলে তৈরি মহানগরের আত্মা। আকাশচুম্বী বহুতল, বিলাসব্যসন থেকে টিমটিমে আলোর জরাজীর্ণ ঘিঞ্জি বস্তি দৈনন্দিন মিলেমিশে এই বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। কলকাতার নানা এলাকায় হেঁটে বেড়ানোর নেশা যদি আপনাকে একবার পেয়ে বসে, আপনি দেখতে দেখতে একেবারে বুঁদ হয়ে যাবেন। উদ্ভট সব গলিঘুঁজি, প্রশস্ত আধুনিক রাস্তা, ময়দানের জগৎ, বইয়ের পাতা, গণিকালয়, স্টেশনচত্বর, হাসপাতাল, স্টিমার ঘাট, কবরখানা, শ্মশান, পার্সি সম্প্রদায়ের টাওয়ার অব সাইলেন্স থেকে বিমানবন্দর, যাত্রাপাড়া, সেলুন-বিউটি পার্লার, চক্ররেল, আদালত, ব্যান্ড পার্টি, পার্ক, কুমোরটুলি, কলেজ বিদ্যালয় চত্বর, চিড়িয়াখানা, স্টেডিয়াম, তারামণ্ডল, আর্ট গ্যালারি, অরোসিটি ক্লিনিক, গৌণ ধর্মের গোষ্ঠীচর্যা কতরকমের শব্দ আর গান!

আরও পড়ুন- বাবা কসাই, জন্ম যৌনপল্লী! কবি নামদেও ধসাল এক বেপরোয়া বিস্ফোরণ

আসুন আমরা তিনটে গানের দিকে তাকাই। তিনটি গানই মোটামুটি বিশ শতকের শেষদিকে তৈরি হয়েছিল। নগর বাস্তবতা থেকে দগদগে চিহ্ন নিয়ে উঠে আসছে তিনটে গান। পাঠক, আসুন প্রথমে গান তিনটি আমরা শুনে নিই। বিদেশে এসব ক্ষেত্রে হাইপার লিঙ্কের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। লিঙ্কে গিয়ে ক্লিক করলে গান শোনা যায় এক পলকে। প্রথমটি কবীর সুমনের গান, ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্‌গা’, দ্বিতীয়টি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘ছোটো ছোটো দু'টি পা ছোটো দুই হাত’, তৃতীয়টি অঞ্জন দত্তের ‘নাম আমার আলিবাবা বয়স আমার দশ’। আমি গানগুলিকে সাজালাম কালানুক্রম অনুযায়ী নয়, আমার ব্যক্তিগত শোনার ক্রমে। তিনটি গানের প্রসঙ্গ আমি এখানে আনলাম কেন? তিনটি গানই শিশু শ্রমিকের দিনানুদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে গড়া। সুমনের ক্ষেত্রে যে সাইকেল রিকশার চালক, প্রতুলের ক্ষেত্রে ছেলেটি (নাকি মেয়েটি?) চায়ের দোকানের কর্মচারী সম্ভবত, আর অঞ্জনের গানের শিশু শ্রমিক বড়দিনের জন্য মুরগি কেটে ড্রামে ফেলে দেয়, মাংস ছাড়াবার কাজ করে। এই শিশু শ্রমিকদের আমরা আকছার দেখতে পাচ্ছি শহরের নানা প্রান্তে। এইসব গানও আমরা শুনি, আবার সেই শিশুটির শ্রমকে দেখেও দেখি না। শহরের এটাই চরিত্র। একদিকে সচেতনতার তীব্র ভাব আর অন্যদিকে অসাড় হয়ে ব্যক্তিবৃত্তে মৌজমস্তিতে বুঁদ হয়ে থাকা। এরকম বেতনভুক, বেতননিষ্ঠ, বেতনাহ্লাদিত নিষ্ঠুর উচ্চবর্গ শহরের আরেক অবদান। গানগুলির মাধ্যমে এই কলকাতা অথবা যেকোনও নগরের নির্মম মনগুলো, তার চিহ্নগুলো ফুটে উঠল। শহরে এই দম্ভের কোনও সীমা পরিসীমা নেই। অলিখিত সব নিয়ম, অলিখিত সব আচার-ব্যবহারের অভ্যাস, আশ্চর্য সব স্ববিরোধে শহরের নিয়ম আর আলো-ঝলসানি পণ্যসম্ভার ঝলমল করছে। এই যে ধরুন, পার্কস্ট্রিটে গিয়ে বাঙালি ওয়েটারকে আমরা ইংরেজিতে অর্ডার দিই, তিনি অনেক সময় নেপালি বা ভুটানিও হতে পারেন। কুকুরকে বিলিতি নাম দিয়ে ‘কাম টমি কাম’ বলি, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় চলা শহরে ক্যালকাটা ক্লাবে নাগরিক হিসেবে নিজের রুচির পোশাকে ঢুকতে পারি না, ‘ফর্মাল’ ড্রেস হিসেবে পাশ্চাত্য পোশাককেই কায়মনোবাক্যে মেনে নিই। অথবা শহরের তৈরি দেশি পোশাক। ধরা যাক, আরও দু-একটি দৃষ্টান্ত। মেট্রো রেলের ভাড়া যতই কম হোক তাতে নিম্নবর্গ যাত্রী তেমনভাবে দেখতে পান? শহরই একমাত্র জায়গা যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী কেবল ইংরেজি ভাষাতেই দেওয়া থাকে। হয়তো এরই সম্প্রসারণে বিমানে বা ফার্স্ট ক্লাস এসি, টু এসিতেও কেউ বাংলা বই পড়েন না। নগর শেখায় আত্মনির্মাণের চাকচিক্য। আত্মগোপন করা। ছদ্ম পরিচয়ের জৌলুস ঘোষণা। কে যেন একবার বলেছিলেন, আমাদের দেশের দু'টি তল। একটা ‘ভারত’, আর অন্যটা ‘ইন্ডিয়া’। কসমোপলিটন, উচ্চমন্য শহর হলো সেই ‘ইন্ডিয়া’। অর্থ, প্রতিপত্তি আর আভিজাত্য দিয়ে সেখানে মাপা হয় মানুষ। সেই জাঁদরেল দাপটে আর হুংকারে ‘ভারত’ জড়োসড়ো, এককোণে কুণ্ঠিত। হুতোম প্যাঁচার নকশার গোড়ায় উদ্ধৃতি ছিল টুনোয়ার টম্পার একটি লাইন – ‘শহর শিখাওয়ে কোতোয়ালি’। কোতোয়ালি মানে কী? কোটালের কেন্দ্রীয় দপ্তর হল ‘কোতোয়ালি’। ফারসি শব্দ। অন্যের ওপর ছড়ি ঘোরানো, রক্তচক্ষু দেখিয়ে চারপাশের সাদাসিধে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখার সেই শিক্ষা দেয় নগরসংস্কৃতি।

‘আজব শহর কলকেতা’। / রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।/ হেতা ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐক্যতা/ যত বক বিড়াল ব্রহ্মজ্ঞানী, বদমাইশির ফাঁদ পাতা।’

– এসব কথা কি সাধে বলা হয়েছিল?

একটু আগেই বলেছি নগর প্রসঙ্গে একটি শব্দ ‘কসমোপলিটন’। এর অভিধান নির্দিষ্ট প্রতিশব্দ হল ‘বিশ্বজনীন’। খুব স্পষ্ট হল না কথাটা। শহর মানে এক আন্তর্জাতিক পরিসর। অন্তত মহানগরের সঙ্গে এই বৈশিষ্ট্য ওতপ্রোত। নানা ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে শহর কলকাতায় বা যে কোনও মহানগরে জড়ো হয় নানা রঙের মানুষ। এই বিচিত্রের সমাহারে তৈরি হয় নানা সংস্কৃতি। এই যে কলকাতার সঙ্গেই জুড়ে আছে ‘চায়না টাউন’, কিংবা সহজপাঠের ভাষায় ‘আর্মানি গির্জা’ (আর্মেনিয়ান) অথবা ইহুদিদের সিনাগগ (যার থেকে সিনাগগ স্ট্রিট) – সবই সেই চিহ্ন। বড়বাজার থেকে লেক মার্কেট, কোথাও রাজস্থানি মাড়ওয়ারি, কোথাও তামিল জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য। বিহারি, ওড়িশা বা শিখ, পাঞ্জাবিদের আলাদা আলাদা এলাকাও আছে। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ বা টিপু সুলতানের সঙ্গে কলকাতার নাম জড়িত। টিপু সুলতানের পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ-র উদযোগে বানানো মসজিদ আজও কলকাতার শোভা। শোনা যায়, তাঁর চল্লিশজন বংশধর এ শহরেই রিকশা চালায়, সাইকেল সারায় বা দর্জির দোকানে ফতুয়া পাঞ্জাবি বানায়। সুভো আত্মজীবনীর নাম মনে পড়ে – নীল রক্ত লাল হয়ে গেছে। এইসব আশ্চর্য জাতি বর্গ ভবঘুরে শ্রেষ্ঠী শিক্ষক অপরাধীদের কথাও কলকাতার সঙ্গে মিশে আছে। প্রবাসী থেকে মাটি রক্তে মিশে আমাদের স্বজন হয়েছেন তাঁরা। কলকাতায় তাদের কাহিনি ঘুরে বেড়ায় পথে-বাগানে-সৌধে-ফুটপাতে। কান পেতে শুনতে হবে সেই নানা আনাচকানাচের গল্প। ইতিহাসের নেহাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বর, ছোটখাটো সব ফিসফিসানি। অবিস্মরণীয় ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহমশায়ের কাছে ঋণ স্বীকার করেই বলি, এই ইতিহাসে লুকিয়ে আছে ‘দারুণ মর্মব্যথা’! তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে কবীর সুমনের ‘সব আমাদের জন্য’ গানটি এখানে নিবেদন করলাম। পাঠক/পাঠিকা আপনারাও একবার শুনে দেখুন। রংদার এইসব দেশি-বিদেশি সম্প্রদায় নিয়ে কথা বলব পরের কিস্তিতে। আপাতত এ পর্যন্তই।

More Articles